রাজধানীতে বেড়েই চলেছে বায়ু দূষণ। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে গড় বায়ুদূষণের পরিমাণ বেড়েছে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ২৫ দিনের গড় বায়ুমান সূচক ২১৯ দশমিক ৫২তে এসে দাঁড়িয়েছে, যা খুবই অস্বাস্থ্যকর। চলতি মাসে ঢাকার লোকজন একদিনও নির্মল বাতাস সেবনের সৌভাগ্য হয়নি বলে তথ্য জানিয়েছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)।
বৃহস্পতিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়। রাতে ঢাকা শহরের বাতাসের মান সবচেয়ে খারাপ থাকে। রাত ১০টার পর মালবাহী ট্রাকের প্রবেশকে এর জন্য দায়ী করা হচ্ছে।
বিপজ্জনক মাত্রায় ঢাকার বায়ুদূষণ : জনস্বাস্থ্য ও দুর্যোগ মোকাবেলায় জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি সামনে রেখে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন, স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়নকেন্দ্রের (ক্যাপস) পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার।
অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, নগর পরিকল্পনায় ঘাটতি, আইনের দুর্বলতা, আইন প্রয়োগের সীমাবদ্ধতা ঢাকার বায়ু দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের অর্থাৎ গত ৬ বছরের জানুয়ারি মাসের বায়ুমান সূচকের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে গড় বায়ু দূষণের পরিমাণ বেড়েছে ৯.৮ শতাংশ। জানুয়ারিতে এখন পর্যন্ত গড় হিসাবে বায়ুমান সূচক ছিলো ২১৯.৫২। যা খুবই অস্বাস্থ্যকর। এমন পরিস্থিতি টানা ৩ দিন থাকলে বিশ্বের যে কোনো দেশ স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা জারি করে। অথচ টানা ২৫ দিন এই অবস্থা থাকলেও নগরবাসীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সরকার। এর প্রেক্ষিতে দ্রুত বায়ু দূষণের ক্ষতি মোকাবিলায় স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা জারি করা জরুরি।
ঢাকা শহরের ১০টি স্থানের গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, ২০২১ সালে ঢাকা শহরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূষিত ছিল তেজগাঁও এলাকা (প্রতি ঘনমিটারে ৭০ মাইক্রোগ্রাম) এবং পরের অবস্থানে রয়েছে শাহবাগ এলাকা (প্রতি ঘনমিটারে ৬৮ মাইক্রোগ্রাম)। তথ্য-উপাত্ত থেকে দেখা যায়, প্রতিটি স্থানের গড় বস্তুকণা ২ দশমিক ৫ ছিল নির্ধারিত মানমাত্রার কয়েক গুণ বেশি।
গবেষণা অনুযায়ী, আহসান মঞ্জিল, আবদুল্লাহপুর, মতিঝিল, ধানমন্ডি ৩২, সংসদ ভবন, আগারগাঁও, মিরপুর-১০ এবং গুলশান-২ এই এলাকাগুলোতে গড় বস্তুকণা ২ দশমিক ৫ ছিল প্রতি ঘনমিটারে যথাক্রমে ৫৭,৬২, ৬০,৬৩, ৫৯,৬১, ৬৬ এবং ৬৫ মাইক্রোগ্রাম এবং যা নির্ধারিত মানমাত্রার প্রায় ৪-৫ গুণ বেশি।
সংবাদ সম্মেলনে সভাপতির বক্তব্যে বাপা‘র সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, নগরের বায়ুর মান ক্রমান্বয়ে বিপজ্জনক পর্যায়ে যাওয়ার পরও নাগরিকদের অবগত না করায় সরকারের বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তিনি অবিলম্বে সরকারকে ঢাকার বায়ু সম্পর্কে যথাযথ তথ্য দেয়ার দাবি জানান। জীবন হুমকির মুখে ফেলা উন্নয়ন চান না বলেও উল্লেখ করেন।
বাপা’র নির্বাহী কমিটির সদস্য এম এস সিদ্দিকী বলেন, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণ কাজের ফলে ঢাকার দূষণ বেশি হচ্ছে। এই দূষণ কমাতে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার ব্যবহারের পরামর্শ দেন তিনি। সরকার পরিকল্পনা ও বাজেট যথাযথ ব্যয় করলে নির্মাণ দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বাপার নির্বাহী কমিটির সদস্য ইবনুল সাঈদ রানা বলেন, গত এক দশক ধরে ব্যবহৃত সকল প্রকার মোবাইল এবং ইলেক্ট্রনিকস সামগ্রীর ব্যাটারিগুলো কিভাবে ব্যবস্থাপনা করা হয় এবং সেগুলো থেকে কী পরিমান দূষণ হয় তার সঠিক হিসাব বের করতে তিনি সরকারের দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোকে অনুরোধ জানান।
ক্যাপসের গবেষণা শাখার প্রধান আব্দুল্লাহ আল নাঈম বলেন, ধূলা দূষণের পাশাপাশি ঢাকা শহরে গ্যাসীয় দূষণ এবং বাতাসে ভারী ধাতু বিশেষ করে সীসা দূষণের পরিমাণও বেড়ে চলেছে। এই ক্ষেত্রে সীসা দূষণের অন্যতম উৎস ব্যবহৃত ব্যাটারি এবং সালফার যুক্ত গ্যাসোলিনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে তিনি জোর দাবি জানান।
সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব ও সঞ্চালনা করেন বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল। বায়ু দূষণের ভয়াবহতা থেকে উত্তরণের জন্য ১৫টি সুপারিশও এতে তুলে ধরে বাপা। সুপারিশগুলো হলো-
১. শুষ্ক মৌসুমে সিটি কর্পোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, ওয়াসা এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের সমন্বয়ে ঢাকা শহরে প্রতি দিন দুই থেকে তিন ঘণ্টা পর পর পানি ছেটানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
২. নির্মাণ কাজের সময় নির্মাণ স্থান ঘেরাও দিয়ে রাখতে হবে ও নির্মাণ সামগ্রী পরিবহনের সময় ঢেকে নিতে হবে।
৩. রাস্তায় ধূলা সংগ্রহের জন্য সাকশন ট্রাকের ব্যবহার করা যেতে পারে।
৪. অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার এবং বিকল্প ইটের প্রচলন বাড়াতে হবে।
৫. ব্যক্তিগত গাড়ি এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। প্রয়োজনে নম্বর প্লেট অনুযায়ী জোড়-বিজোড় পদ্ধতিতে গাড়ি চলাচলের প্রচলন করা যেতে পারে।
৬. সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রচুর পরিমাণ গাছ লাগাতে হবে এবং ছাদ বাগান করার জন্য সকলকে উৎসাহিত করতে হবে।
৭. ঢাকার আশপাশে জলাধার সংরক্ষণ করতে হবে।
৮. আলাদা সাইকেল লেনের ব্যবস্থা করতে হবে।
৯. আগুনে পোড়ানো ইটের বিকল্প হিসাবে স্যান্ড ব্লক-এর ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বাড়াতে হবে।
১০. সিটি গভর্নেন্সের প্রচলনের মাধ্যমে উন্নয়নমূলক কার্যকলাপের সমন্বয় সাধন করতে হবে। সেবা সংস্থার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড স্বল্প সময়ে সম্পন্ন করতে হবে।
১১. নির্মল বায়ু আইন-২০১৯ যতদ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করতে হবে।
১২. পরিবেশ সংরক্ষণ ও সচেতনতা তৈরির জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। নিয়মিত বায়ু পর্যবেক্ষণ স্টেশনের (ক্যামস) ব্যাপ্তি বাড়িয়ে ঢাকা শহরের সব এলাকাকে এর আওতাধীন করতে হবে। এছাড়াও বায়ু দূষণের পূর্বাভাস দেওয়ার প্রচলন করতে হবে।
১৩. সর্বোপরি সচেতনতা তৈরির জন্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে বায়ু দূষণ সম্পর্কে আরও বেশি তথ্যনির্ভর অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে ঢাকাসহ সারা দেশের বায়ু দূষণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
১৪. ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়ন করা।
১৫. পরিবেশ ক্যাডার সার্ভিস এবং পরিবেশ আদালত চালু ও কার্যকর করতে হবে।
নয়া শতাব্দী/এসএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ