ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
চিকিৎসাসেবা দুর্বলতা

বিদেশে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা

প্রকাশনার সময়: ২২ জানুয়ারি ২০২২, ০৯:১৩

উন্নত স্বাস্থ্যসেবা পেতে ও অবকাশযাপনের জন্য বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। আর এতেই প্রতি বছর দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। দেশে নেই বিশ্বমানের চেইন হাসপাতাল। অনেকে বাধ্য হয়েই বিদেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন। ভ্রমণ করছেন বিভিন্ন দেশ। বাংলাদেশে নামে গুটিকয়েক অভিজাত হাসপাতাল থাকলেও সেগুলো নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই রোগীদের। সেবার মান ও আকাশচুম্বী ব্যয়ের ওপর সরকারের তদারকিও নেই বললেই চলে। পাশাপাশি সরকারি হাসপাতালগুলোতেও রয়েছে চরম অব্যবস্থাপনা। চিকিৎসা ব্যবস্থার এমন আস্থা সংকটের কারণেই বিপুল পরিমাণ এই অর্থ বাইরের দেশে চলে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারাচ্ছেন সাধারণ মানুষ। উন্নত চিকিৎসায় করতে প্রতি বছর দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। তবে বিদেশে চিকিৎসা বাবদ প্রকৃত ব্যয় আরো বেশি, অন্তত ৫০ হাজার কোটি টাকা হবে দাবি বিশেষজ্ঞদের। তারা বলছেন, কেবল স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন করেই বিপুল এই অর্থ দেশেই রাখা সম্ভব।

চিকিৎসা খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশে চিকিৎসার প্রতি মানুষের আস্থা বেশি। খরচও হয় তুলনামূলক কম। তাই ভালো চিকিৎসার আশায় মানুষ ছুটছেন বিদেশে। চিকিৎসা নিতে উচ্চবিত্তরা প্রধানত সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে যায়। মধ্যবিত্তরা যায় ভারতে। তবে গত বছর থেকে তুরস্ক ও দুবাইয়ে চিকিৎসা নিতে যাওয়া বাংলাদেশির সংখ্যা বাড়ছে। স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টদের দাবি, অতিরিক্ত চিকিৎসা ব্যয় ও চিকিৎসকদের আন্তরিকতার অভাবে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা বেশি। আর্থিকভাবে সচ্ছল মানুষগুলো চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাচ্ছে। বিশেষ করে ভারতেই যাচ্ছেন বেশির রোগী। ভারতের অনেক হাসপাতাল আছে যারা বাংলাদেশ রোগীদের ওপর নির্ভরশীল। এদেশ থেকে যাওয়া কয়েক লাখ রোগীর ওপর নির্ভর করে চুটিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। আর আর্থিক খাতের বিশ্লেষকরা বলছেন, দেশের স্বাস্থ্য এবং পর্যটন খাত আরো যুগোপযোগী ও আধুনিক করতে না পারলে এই খাতে ব্যয় বেড়েই চলবে। রোগীদের বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা রুখতে হলে দেশে হাসপাতালের অবকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে চিকিৎসা সেবাদানকারীর সংখ্যাও আন্তর্জাতিক মানণ্ড অনুযায়ী বাড়াতে হবে। একই সাথে দেশের পর্যটন খাতে আরো অনেক উন্নয়নের সুযোগ আছে। অর্থনীতিবিদ ড. বজলুল হক খন্দকার নয়া শতাব্দীকে বলেন, বাইরের দেশে ভ্রমণে ও চিকিৎসা খাতে যা খরচ হচ্ছে তার মানে এগুলো আমাদের দেশের অর্থনীতিতে কোন কিছু যোগ হচ্ছে না। এই জায়গাটাতে আমাদের জোর দেয়া লাগবে। এ জন্য সরকারি-বেসরকারি খাত এক সাথে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে বলেও মনে করেন তিনি।

জানা যায়, বেসরকারি হাসপাতালে অতিরিক্ত চিকিৎসা ব্যয়, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকদের আন্তরিকতার অভাব, চিকিৎসার নামে বাণিজ্য, সঠিক রোগ নির্ণয়ে ব্যর্থতা, চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্টদের অবহেলা, রোগ নির্ণয় পরীক্ষার উচ্চমূল্য, রাজনৈতিক নেতাদের বাইরে চিকিৎসা নেয়ার প্রবণতাসহ নানা কারণেই বিদেশে চিকিৎসা নেয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এসব কারণেই দেশে চিকিৎসা নেন না বেশিরভাগ রোগী। বিদেশগামী রোগীদের প্রায় ৬০-৬৫ শতাংশই যান ভারতে। অন্যরা যান, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ইউরোপসহ অন্যান্য দেশে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে লাখো মানুষ চিকিৎসা নিতে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে যায়। পর্যটক হিসেবে বিদেশগামীদের একটা বড় অংশের উদ্দেশ্য থাকে উন্নত চিকিৎসা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিদেশগামী বাংলাদেশির ৬০ দশমিক ৪১ শতাংশ ভারতে প্রধান গন্তব্য হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এর পরের স্থানে রয়েছে সৌদি আরব- ৮ দশমিক ১২ শতাংশ এবং মালয়েশিয়া ৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে দেখা যায়, দেশের মানুষ বিদেশ যাত্রায় ব্যয় করেছেন ৩৩ হাজার ৬৮৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। সবচেয়ে বেশি ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে চিকিৎসা খাতে। শতাংশের হারে যা ২৯.৪৯। এরপর পরিবহণ খাতে মোট ব্যয়ের ২৫.২৮ শতাংশ। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে এ তথ্য প্রকাশ করে ‘ট্যুরিজম স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট-২০২০’।

জানতে চাইলে ওই জরিপ প্রকল্পের পরিচালক তোফায়েল আহমেদ বলেন, ২০২০ সালের মার্চে শেষ হওয়া এই জরিপটি একটি পূর্ণাঙ্গ জরিপ। এই জরিপের মূল উদ্দেশ্য ছিল সামগ্রিক অর্থে দেশের মানুষের ভ্রমণের গতিবিধি বোঝা। শুধুমাত্র চিকিৎসাসেবা উদ্দেশ্য বিদেশভ্রমণ ছিল চোখে পড়ার মতো। যা শতাংশের হারে যা ১৫.৭৬।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিদেশে চিকিৎসা বাবদ প্রকৃত ব্যয় আরো বেশি। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর নয়া শতাব্দীকে বলেন, চিকিৎসা বাবদ দেশের বাইরে প্রতিবছর অন্তত ৫০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়। বেনাপোল দিয়ে ভারতে চিকিৎসার জন্য যায় কয়েক লাখ মানুষ। সব হিসাব কাগজপত্রে নেই।

তিনি বলেন, দেশে চিকিৎসাসেবার দুর্বলতার কারণেই মানুষ বাইরে চিকিৎসার জন্য যাচ্ছে। অথচ বিশ্বের নামকরা হাসপাতালগুলোকে এ দেশে বিনিয়োগে বাধা দেয়া হচ্ছে। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথের নাম উল্লেখ করে ড. মনসুর বলেন, তারা অনেক আগে থেকেই এ দেশে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। তবে বিদেশি চিকিৎসক ও নার্স আনার ক্ষেত্রে শর্ত দিয়ে রাখা হয়েছে। মানের প্রশ্নে এই শর্তে মাউন্ট এলিজাবেথ রাজি নয়।

বাংলাদেশ আউটবাউন্ড ট্যুর অপারেটরস ফোরাম (বিওটিওএফ) সূত্র জানায়, প্রতি বছর গড়ে আট লাখ মানুষ বিদেশে চিকিৎসা নিতে যায়। এর বড় অংশই যায় ভারতে। দ্বিতীয় প্রধান গন্তব্য থাইল্যান্ড। তৃতীয় স্থানে আছে সিঙ্গাপুর।

সংগঠনটির সভাপতি চৌধুরী হাসানুজ্জামান নয়া শতাব্দীকে বলেন, অনেকে পর্যটক হিসেবে বিদেশে যান। তবে পাশাপাশি তারা চিকিৎসাও করিয়ে থাকেন। ফলে প্রকৃত সংখ্যা কারো কাছে থাকার সুযোগ নেই। এ নিয়ে বিভিন্ন ফোরামে আলোচনা আছে যে, চিকিৎসা ভিসায় না গেলে কেউ চিকিৎসা নিতে পারবে না। তাতে নিয়ন্ত্রণের একটা সুযোগ তৈরি হয়েছিল। ভারতে কিছুদিন সেভাবে চিকিৎসা ও পর্যটন আলাদা ছিল। এখন আর নেই।

দ্য প্যাসিফিক এশিয়া ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশনের বাংলাদেশ শাখার তথ্যমতে, বছরে গড়ে ৩৫ লাখ মানুষ বিদেশ ভ্রমণে যায়। এর মধ্যে শুধু ভারতেই যায় ২০ লাখ। তাদের বড় অংশই যায় চিকিৎসার জন্য। তবে বিবিএসের জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশ থেকে বছরে চার লাখ ৬০ হাজার মানুষ দেশের বাইরে চিকিৎসার জন্য যায়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব বলেন, বাংলাদেশ থেকে একসময়ে চিকিৎসার জন্য অনেকে বিদেশে যেতেন। তখন দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা ততটা উন্নত ছিল না। হার্টের রিং পরানো, বাইপাস সার্জারি, কিডনি ট্রান্সপ্লান্টসহ জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীরা চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতেন। সে অবস্থা কিছুটা পাল্টালেও সামর্থ্যবান ব্যক্তিরা এখনো চিকিৎসার জন্য বিদেশমুখী রয়ে গেছেন। এর পেছনে মূল কারণ দেশের চিকিৎসার প্রতি আস্থাহীনতা।

তিনি বলেন, ভারতের অনেক হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয় বাংলাদেশের কাছাকাছি কিংবা কম হওয়ায় অনেকেই সে দেশে চলে যাচ্ছে। এর জন্য দায়ী দেশের চিকিৎসার ব্যবস্থাপনা। কারণ, সরকারি হাসপাতালে মানুষ চিকিৎসা নিতে গিয়ে ভোগান্তির শিকার হন। আবার যে ক’টি বেসরকারি হাসপাতালে মানসম্পন্ন চিকিৎসা পাওয়া যায়, সেগুলোর ব্যয় অনেক বেশি। এ কারণে চিকিৎসার জন্য বিদেশমুখী হচ্ছে মানুষ।

জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. লেলিন চৌধুরী নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘বাংলাদেশে কিছু রোগের চিকিৎসা হয় না। সেইসব রোগের চিকিৎসা জন্য দেশের বাইরে যেতে হয়। এর জন্য প্রতি বছর কিছু মানুষ বিদেশে যায়। এটাও একটা ব্যাপার। আরেকটা ব্যাপার- কিছু মানুষ চিকিৎসা ও বেড়াতে একসাথে যায়। ভারতে যায় এদের বেশিরভাগই। ভারতে এক শ্রেণীর হাসপাতাল রয়েছে যারা বাংলাদেশী রোগীদের সাথে এমন আচার-আচরণ করে মনে হয় বড় ধরনের রোগ হয়েছে। অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা মাধ্যমে প্রচুর টাকার বিল ধরিয়ে দেয়। সবশেষ আরেকটি ব্যাপার হল- বাংলাদেশে কলকাতা-ভারতের নামি-দামি কিছু প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিং এর জন্য দালাল নিয়োগ করেছে। তাদের মাধ্যমেই দেশ থেকে রোগী সংগ্রহ করে তারা। দালালরা রোগীদের প্রথমে বোঝায় বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা খুবই খারাপ। এখানে চিকিৎসা করলে মরে যাবেন। আর ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থা স্বর্গের কাছাকাছি। তবে ইদানীং চিকিৎসা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছে ভারতের নাগরিকরাও’।

তিনি বলেন, ‘এই সব দালালরা নানা প্ররোচনা-সুবিধার কথা বলে বিদেশে রোগী নিয়ে যায়। প্রধান অংশ যায় ভারতে। আর কিছু বিত্তবান প্রভাব দেখানোর জন্য সামান্য গলায় ব্যথা হলেও চলে যায় সিঙ্গাপুর বা ব্যাংকক। এদের দ্বারাও দেশের টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। সবমিলিয়ে কিছুটা প্রয়োজনে, তবে বেশিরভাগ অপ্রয়োজনে ও দালালদের প্ররোচনার কারণে চিকিৎসা খাতের বড় একটি টাকা দেশের বাইরে যাচ্ছে। পাশাপাশি দেশের বড় চিকিৎসকদের একটি অংশের ব্যবহারে রোগীরা বিব্রতবোধ করে। তারা মনে করে, ডাক্তার তাদের মূল্যায়ন করছে না। এটাও অন্যতম কারণ’।

লেলিন চৌধুরী আরো বলেন, ‘এখন সবচেয়ে জরুরি হল দেশের চিকিৎসা খাতকে আরো বেশি মানবমুখিতা করা। চিকিৎসক, নার্স ও টেকনিশিয়ানদের রোগীদের প্রতি মানবিক আচরণ করতে হবে। রোগীকে আরো সময় দিতে হবে, রোগের ব্যাখ্যা ভালোভাবে করতে হবে। সেবার মান উন্নত করলে আধুনিক চিকিৎসা পাবে, যা রোগীদের বিদেশগামিতা কমাতে সহায়তা করবে’।

নয়া শতাব্দী/এস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ