দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা দেখভাল করে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)। শিক্ষক-কর্মচারীদের বদলি, পদোন্নতিসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসংক্রান্ত সব কাজ দেখভালের দায়িত্ব অধিদফতরটির। তবে অভিযোগ রয়েছে, মাউশি সংশ্লিষ্টরা এসব নিয়মিত কাজ করতে সময়ক্ষেপণ করেন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। নানা ছুঁতোয় হাতিয়ে নেন অর্থ। এ রকম অন্তত ১৮৪টি অভিযোগ আমলে নিয়ে দুদক তদন্তের জন্য মাউশি ডিজিকে ২৪০ বার চিঠি দেয়। এতেও তদন্ত কাজ প্রত্যাশিত ধারা না এগোনোয় দুদক তলব করে মাউশি ডিজিকে। এর অংশ হিসেবে গতকাল বুধবার দুদক সচিবসহ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন মাউশি মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক ও মাউশির পরিচালক অধ্যাপক মো. শাহেদুল খবির চৌধুরী।
প্রায় ৩ ঘণ্টা বৈঠক শেষে সেগুনবাগিচায় দুদক কার্যালয়ে দুদক সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, মাউশির নেটওয়ার্ক অনেক বিস্তৃত। সেখানে কর্মকর্তা-কর্মচারীরদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ থাকে। সব আমাদের তদন্তের পর্যায়ে পড়ে না। বেশিরভাগের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। কিছু অভিযোগ আছে তদন্তের অংশ হিসেবে মাউশিতে পাঠানো হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করে এ পর্যন্ত মাউশি মহাপরিচালকের (ডিজি) কাছে ২৪০টি চিঠি পাঠিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তদন্ত ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে দুদককে অবহিত করার কথাও বলা হয়েছিল ওইসব চিঠিতে।
দুদক সচিব বলেন, মাউশির বেশ কিছু অভিযোগ পেন্ডিং ছিল সেগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ১৮৪টি অভিযোগের মধ্যে কিছুর বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, কিছু উনারা তদন্ত করছেন। আবার কতগুলো মাউশি ট্রেস করতে পারছে না। আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, মাউশিতে একজন ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা থাকবেন। যিনি অভিযোগ সংগ্রহ করবেন। তিনি মহাপরিচালকের নির্দেশক্রমে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে— তা আমাদের জানাবেন। আবার তদন্ত করা বা কার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হলো— সেটিও দুদককে জানাবেন।
সচিব আরো বলেন, অন্য আরেকটি সিদ্ধান্ত হলো— যতগুলো নিষ্পত্তিহীন অভিযোগ আছে, সেগুলো নিষ্পত্তি করতে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাউশিকে সময় দেয়া হয়েছে। তারা কমিটমেন্ট করেছেন— পেন্ডিং কাজগুলো শেষ করে আমাদের জানাবেন। দুদক সচিব বলেন, মাউশির অভিযোগের বেশিরভাগই নিয়োগ ও প্রকল্পসংক্রান্ত। তবে সব অভিযোগের সত্যতা থাকে না। একজন নিয়োগ না পেলে সে আরেকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। তিনি আরো বলেন, অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে দুদক চিঠি পাঠিয়েছে। প্রতিষ্ঠান প্রধানকেও আগামীতে তলব করা হবে।
জানা যায়, বর্তমানে সারাদেশে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ই আছে ১৮ হাজার ৫৯৮টি। এগুলোতে শিক্ষক আছেন আড়াই লাখের মতো। এছাড়া কলেজ আছে সাড়ে চার হাজারের মতো। এগুলোতে শিক্ষক আছেন প্রায় এক লাখ ২৮ হাজার। কর্মচারী আছেন কয়েক লাখ। এই বিপুলসংখ্যক শিক্ষক-কর্মচারীদের বিভিন্ন সেবার দেয়ার বিপরীতে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী ‘চক্র’ তৈরি করে দুর্নীতি ও ঘুষবাণিজ্য করেন বলেও অভিযোগ। তাদের অনেকেই আবার বছরের পর বছর ধরে শিক্ষা ভবনে চাকরি করছেন। কখনো কখনো দূর-দূরান্ত থেকে আসা শিক্ষক-কর্মচারীরা হয়রানিরও শিকার হন। এ রকম অভিযোগের মধ্যেই বেরিয়ে এসেছে— প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালকের দফতরের অফিস সহায়ক মো. জুয়েল সম্প্রতি ঢাকার আজিমপুর গভ. গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের গণিতের সহকারী শিক্ষক কে এম মাহমুদুল হাসানকে ঢাকার গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলে এবং কুমিল্লার দাউদকান্দির বেগম আমেনা সুলতান সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের ইংরেজির সহকারী শিক্ষক ফাতেমা আক্তারকে ঢাকার শেরেবাংলা নগর এলাকার একটি বিদ্যালয়ে বদলির ‘ব্যবস্থা’ করতে যাচ্ছিলেন।
আর এই কাজে তিনি জালিয়াতির আশ্রয় নেন। আবেদনে শিক্ষা উপমন্ত্রীর সই জাল করে সুপারিশ লিখে সেটি নিয়ে মাউশির মাধ্যমিক শাখায় যান জুয়েল। এর আগেও তিনি এ ধরনের কাজ করেছেন বলে অভিযোগ ওঠে। কিন্তু মহাপরিচালকের দফতরের অফিস সহায়ক হওয়ায় সন্দেহ হলেও প্রথম দিকে তেমন একটা কিছু বলতেন না মাধ্যমিক শাখার কর্মকর্তারা। কিন্তু এবার একজন কর্মকর্তার কাছে বিষয়টি বেশি সন্দেহ হলে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে অবহিত করেন। এরপর সেটি শিক্ষা উপমন্ত্রীকে অবহিত করা হলে সই জালিয়াতির জন্য ব্যবস্থা নিতে বলেন উপমন্ত্রী। তারই ধারাবাহিকতায় অফিস সহায়ক মো. জুয়েলকে চাকরির শৃঙ্খলা পরিপন্থি কাজে লিপ্ত হওয়ায় সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা অনুযায়ী সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) বিভিন্ন পর্যায়ে প্রায় চার হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন আছে। সংস্থাটির প্রশাসন শাখার অধীনে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে। এরই মধ্যে কয়েকটি পদের পরীক্ষা হয়েছে। গত ১০ ডিসেম্বর ‘ক্যাশিয়ার ও স্টোরকিপার পদের লিখিত পরীক্ষা হয়েছে। তবে এরই মধ্যে বিভিন্ন সরকারি কলেজে দশটি পদে প্রদর্শক নিয়োগে কয়েক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। এ অভিযোগ তদন্তে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতর (ডিআইএ) উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠন করা হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, যেসব পদের নিয়োগ কার্যক্রম চলছে তার প্রতিটি বিষয়েই মূলত কম-বেশি অভিযোগ আছে। একটি শ্রেণি নিয়োগ পাইয়ে দিতে মাউশির কর্মকর্তাদের নাম কথা বলে বিভিন্ন প্রার্থীর কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। যেসব নাম আলোচিত হচ্ছে তার মধ্যে উল্লিখিত দুটি নাম ছাড়াও মাউশির কলেজ, প্রশাসন এবং মাধ্যমিক শাখায় কর্মরত আরো চার-পাঁচজনের নামও আসছে।
মাউশির মহাপরিচালক বলেন, পেন্ডিং অভিযোগ নিষ্পত্তি করতে দুদক আমাদের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় দিয়েছে। মাউশিতে আসা দুর্নীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রত্যেকটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কোনোটি দুদক তদন্ত করেছে, কোনোটি মন্ত্রণালয় করেছে। ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই।
মাউশি পরিচালক মো. শাহেদুল খবির চৌধুরী নয়া শতাব্দীকে বলেন, করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) কারণে অনেক অভিযোগ তদন্ত করা যায়নি। সব অভিযোগ তদন্ত চলছে, বছর শেষে আমরা দুদকে আপডেট দিয়েছি। অনিয়মকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
নয়া শতাব্দী/এমআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ