ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মর্জিমতো কেস-জরিমানা, ব্যবহার হয় না ‘বডি অন ক্যামেরা’

প্রকাশনার সময়: ৩০ ডিসেম্বর ২০২১, ০৬:৩০ | আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০২১, ০৬:৩২
সংগৃহীত ছবি

রাজধানী ঢাকার অন্যতম প্রবেশদ্বার গাবতলী। ছোট-বড় কয়েক লাখ যানবাহন প্রতিদিন চলাচল করে ঢাকার উত্তরের এই প্রবেশদ্বার দিয়ে। যানবাহনের সুশৃঙ্খল চলাচল নিশ্চিতে এ প্রবেশদ্বারে দায়িত্ব পালন করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক (মিরপুর) বিভাগ। অভিযোগ রয়েছে, এ স্পটে দায়িত্বরত সার্জেন্টরা বাহন চালকদের সঙ্গে করেন স্বেচ্ছাচারিতা। মর্জিমতো দেন মামলা, বড় অঙ্কের জরিমানার ভয় দেখিয়ে আদায় করেন ঘুষ। যদিও দায়িত্ব পালনের সময় সব ধরনের অনিয়ম ক্যামেরাবন্দি করার অংশ হিসেবে সার্জেন্টদের ‘বডি অন ক্যামেরা’ ব্যবহার বাধ্যতামূলক। প্রায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা স্পটটিতে সরেজমিন পর্যবেক্ষণের সময় ঘুষ নেয়াসহ নানা অনিয়মের ঘটনা চোখে পড়লেও কোনো সার্জেন্টকেই ‘বডি অন ক্যামেরা’ ব্যবহার করতে দেখা যায়নি।

জানা যায়, সড়কে পুলিশি ঝামেলা এড়াতে আন্তঃজেলা ও সিটি পরিবহনের বাসগুলো প্রতিমাসেই একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের বরাদ্দ রাখে পুলিশের জন্য। প্রধান সড়কের পাশে কাউন্টারের সামনে বাস রাখা, যাত্রী ও মালামাল উঠানো ইত্যাদি কারণে জরিমানা বা আইনানুগ ব্যবস্থা থেকে বাঁচার জন্য সংশ্লিষ্ট বাসের মালিক ও কোম্পানিগুলো এই টাকা বরাদ্দ দেন। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম মালবাহী ট্রাক। তাই ‘তথাকথিত অপরাধের’ তাৎক্ষণিক সমাধান দিতে ট্রাকচালকদের কাছ থেকে নিয়মিতই উৎকোচ গ্রহণ করেন অসাধু ট্রাফিক সার্জেন্টরা।

ট্রাকচালকদের অভিযোগ, ঘুষের টাকা না দিলে মর্জিমতো মামলা করেন সার্জেন্টরা। সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮-তে, যে কোনো ধারায় জরিমানার টাকা বেশি হওয়ায় চালকরা মামলা থেকে বাঁচতে নীরবেই চাহিদা অনুযায়ী, টাকা তুলে দেন ট্রাফিক সদস্যদের হাতে।

রাত ৮টার সময় আরিচা মহাসড়ক ধরে হেমায়েতপুরের দিক থেকে এসে আমিনবাজার ব্রিজ পার হওয়া একটি কাভার্ডভ্যানকে (ঢাকা মেট্রো-ম ৫১-২৯৬৫) থামার ইশারা দেন ট্রাফিক (মিরপুর) বিভাগের কনস্টেবল নজরুল ইসলাম। প্রায় ২ মিনিটের বাকবিতণ্ডার পর ড্রাইভার মাসুদকে নিয়ে যান রাস্তার বিপরীত পাশের একটি চায়ের দোকানে। সেখানে মোবাইল ফোনে কথা বলছিলেন কর্তব্যরত এক ট্রাফিক সার্জেন্ট। কাভার্ডভ্যানের চালকসহ গাড়ির কাগজপত্র সার্জেন্টের জিম্মায় দিয়ে কনস্টেবল ফিরে যান তার আগের জায়গায়। ইউনিফর্মের ওপরে হলুদ ভেস্ট পরে থাকায় সার্জেন্টের নাম দেখা সম্ভব হয়নি। ওই সার্জেন্টের সঙ্গে প্রায় ১৫ মিনিট দরকষাকষি করেন চালক মাসুদ। একাধিকবার মোবাইল ফোনে কথা বলেন ট্রাকের মালিকের সঙ্গে। যোগাযোগ করিয়ে দেন কর্তব্যরত সার্জেন্টের সঙ্গেও। অবশেষে চাহিদামতো টাকা হাতবদলের পর চলে যাওয়ার অনুমতি!

টাকা নেয়ার বিষয়ে কথা বলতে চাইলে ওই সার্জেন্ট ব্যস্ততা দেখিয়ে দ্রুত মোটরসাইকেল চালিয়ে স্থান ত্যাগ করেন। ট্রাকের বডিতে মুদ্রিত থাকা নম্বরে ফোন দিলে কথা হয় ট্রাকটির মালিক দুলাল হোসেনের সঙ্গে। তিনি নয়া শতাব্দীকে বলেন, উত্তরার একটি তৈরি পোশাক কারখানাতে যাচ্ছিল কাভার্ডভ্যানটি। নিয়ম অনুযায়ী, রাত ৯টার আগে রাজধানীতে ট্রাক প্রবেশ নিষিদ্ধ। বিকল্প হিসেবে আশুলিয়ামুখী বেড়িবাঁধ সংযোগ সড়ক ধরে উত্তরার দিকে যাচ্ছিলেন চালক। কত টাকা ঘুষ দিয়েছেন— এমন প্রশ্নের জবাব অবশ্য তিনি দেননি। বলেন, অহেতুক ৫-৬ হাজার টাকার মামলা থেকে বাঁচতে কিছু তো দিতেই হয়।

সরেজমিন গাবতলী আন্তঃজেলা ট্রাক টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায়, বেড়িবাঁধ হয়ে বাবুবাজারমুখী সংযোগ সড়কটি পশ্চিম দিকে চলে গেছে। ব্যস্ত এই সড়কটি শুরুর একশ’ গজেই কিছুটা বাঁয়ে বাঁক নিয়েছে। গাবতলী থেকে কামরাঙ্গীরচরে যাতায়াতকারী যাত্রীদের জন্য এখানে রয়েছে একটি লেগুনা স্ট্যান্ড। তিন রাস্তার সংযোগ সড়কের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে রয়েছে গাবতলী ট্রাফিক পুলিশ বক্স। এ মোড়ে রাত ৯টার দিকে কর্তব্যরত ছিলেন সার্জেন্ট হাফিজ, কনস্টেবল মাহবুব, কনস্টেবল জলিলসহ নেমপ্লেট ছাড়া আরো ৪-৫ জন আনসার সদস্য।

সাভারমুখী প্রধান সড়কটির রোড ডিভাইডারের ওপর একটি চতুর্মুখী ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা থাকলেও, রাস্তার বাঁক এবং কিছুটা অন্ধকারাচ্ছন্ন হওয়ায় লেগুনা স্ট্যান্ডের জায়গাটি প্রধান সড়কে বসানো ক্যামেরার আওতার বাইরে। এখানে লাইন ধরে দাঁড়িয়েছিল পণ্যবাহী ৭টি ছোট ও মাঝারি আকারের ট্রাক। কর্তব্যরত ট্রাফিক সদস্যদের নির্দেশে থামানো এসব ট্রাক থেকে কাগজপত্র সংগ্রহ করছিলেন আনসার সদস্যরা। নির্দেশ অমান্য করে কোনো যানবাহন যেন চলে না যায় সেটা নিশ্চিত করছিলেন লেগুনা স্ট্যান্ডের কিছু লাইনম্যান। চাহিদা অনুযায়ী, টাকার জোগান দেয়া ছাড়া, সঠিক কাগজপত্রসহ অনেক চালকও এ সময় রেহাই পাননি।

আনুমানিক ২০ বস্তা পোলট্রি ফিড বোঝাই একটি দেড় টনের ট্রাক (ঢাকা মেট্রো-ম ১৩-১৬৮৪) দাঁড়িয়েছিল লাইনে। পরিচয় গোপন করে কথা হয় ট্রাকটির চালক রিপনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ সব কাগজপত্র ঠিক আছে আমার। তারপরও ‘গাড়ি ওভারলোডের’ অভিযোগে মামলা দিতে চাইছেন কর্তব্যরত সার্জেন্ট। অধিক জরিমানা এড়াতে চালক রিপন এক হাজার টাকা তুলে দেন এক আনসার সদস্যের হাতে। একই সময়ে সাভারগামী ঠিকানা, মৌমিতা, লাব্বাইক, সাভার পরিবহনসহ একাধিক বাস রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল। এলোমেলো দাঁড়িয়ে যাত্রী ওঠালেও সেদিকে ভ্রূক্ষেপহীন ছিলেন কর্তব্যরত ট্রাফিক সদস্যরা।

বিষয়টি নজরে আনলে ট্রাকচালক রিপন বলেন, ‘ভাই হ্যাগো লগে স্যারেগো মানতি কন্টাক। সব জ্বালা ট্রাক ডাইভারগো’। চালক রিপনের অভিযোগের বিষয়ে কথা হয় সার্জেন্ট ফাহিদের সঙ্গে। টাকা নেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, মেয়াদ উত্তীর্ণ ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য ট্রাকটি থামানো হয়েছে। আনসার সদস্যরা তার অজান্তে হয়তো টাকা চাইতে পারেন। কোনো ওজন পরিমাপক যন্ত্র ছাড়া ওভারলোডের অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করলে, উত্তর না দিয়ে ডিউটির অজুহাতে দ্রুত চলে যান তিনি। এসব অভিযোগের বিষয়ে ট্রাফিক (মিরপুর) বিভাগের দারুস সালাম জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) ইফতেখার আহাম্মেদ বলেন, যৌক্তিক কারণে সুনির্দিষ্ট অভিযোগে মামলা করেন তারা। এর ব্যতিক্রম হলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। দায়িত্বে নিয়োজিত অবস্থায় পুলিশ ও আনসার সদস্যরা নেমপ্লেট খুলে রাখতে পারেন কি না— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, কর্তব্যরত অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিটি সদস্যের নেমপ্লেট দৃশ্যমান জায়গায় থাকা বাধ্যতামূলক। বিষয়টি তদন্ত করে সত্যতা পাওয়া গেলে অভিযুক্তদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ