চলতি বছরের ৮ নভেম্বর টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে নিহত হন তিন শিক্ষার্থী। ঘটনার দিন সকাল ১০টায় উপজেলার ঘাটাইল সাগরদীঘি রাস্তার সরিষাআটা মোড়ে এ দুর্ঘটনা ঘটে। স্থানীয়দের দাবি, বেপরোয়া গাড়ি চালানোর সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছের সঙ্গে ধাক্কা লাগে মোটরসাইকেলটির। এতে ঘটনাস্থলেই শরিফ ও আবু বক্কর নিহত হন। হাসপাতালে নেয়ার পথে মৃত্যু হয় গুরুতর আহত সিয়ামের। এভাবে একইসঙ্গে তিনটি পরিবারের স্বপ্নের সমাধি হয়। নিহতদের বয়স ১৩ থেকে ১৫ বছর। তিনজনই ধলাপাড়া বড়মেধার (ঝাইপাটা) গ্রামের বাসিন্দা এবং স্থানীয় ওয়েসিস ক্যাডেট স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র। এ ঘটনার ২ দিন পর রাজধানীর খিলগাঁও ফ্লাইওভারে একটি সিএনজি অটোরিকশার ধাক্কায় গুরুতর আহত হন মোটরসাইকেল আরোহী গোলাম রাব্বানী (৩০) ও চালক নূর মোহাম্মদ (৩২)। স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নিলে চিকিৎসকরা গোলাম রাব্বানীকে মৃত ঘোষণা করেন। নিহত রাব্বানী ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্সের অফিস সহকারী (প্রশাসন) ছিলেন। তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। একই সঙ্গে তিনি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। ফলে থমকে গেছে রাব্বানীর পরিবারের সদস্যদের জীবনমান।
এ দুটি ঘটনাই নয়— দেশে আশঙ্কাহারে বেড়েছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা। প্রতিদিনই কোথাও না কোথায় এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এতে ধ্বংসের মুখে পড়ছে নিহতের পরিবার। আহতরাও দীর্ঘমেয়াদি সমস্যায় ভুগছেন। অনেকে পঙ্গুত্বও বরণ করছেন।
পুলিশের দেয়া তথ্যমতে, হতাহতদের বেশিরভাগই তরুণ। মানসম্মত হেলমেট না থাকায় দুর্ঘটনার পর হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে বলে পুলিশ সদর দফতরের এক পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে। পুলিশ সদরের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ছয় মাসে দেশে ১ হাজার ৪৯৪টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪৭৮টি। এতে ৩৩৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন। তাদের মধ্যে ২৩৯ জনের হেলমেট ছিল। আহত হয়েছেন ৩০৫ জন, এর মধ্যে ২২৪ জনের হেলমেট ছিল না। একই পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনার শিকারের ৭০ ভাগই পথচারী। মোটরসাইকেল ভিকটিমদের বেশিরভাগই তরুণ, যাদের বয়স ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। তারা দেশের উৎপাদনক্ষম জনশক্তি।
সম্প্রতি রাজধানীর একটি হোটেলে ব্র্যাক আয়োজিত বাংলাদেশে ইউএন স্ট্যান্ডার্ড হেলমেট চালুকরণ অনুষ্ঠানে আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ মোটরসাইকেল এবং সাইকেল চালকদের মানসম্পন্ন হেলমেট ছাড়া রাস্তায় বের না হওয়ার আহ্বান জানান। আইজিপি বলেন, ‘দেশ যত উন্নত হচ্ছে রাস্তায় বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের সংখ্যা তত বাড়ছে। সড়ক নিরাপত্তাও দিন দিন চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে।’ পরিসংখ্যান উল্লেখ করে আইজিপি বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনার শিকারের ৭০ ভাগই পথচারী। মোটরসাইকেল ভিকটিমদের বেশিরভাগই তরুণ, যাদের বয়স ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। তারা দেশের উৎপাদনক্ষম জনশক্তি। আমাদের দেশে হেলমেটের কোনো সার্টিফিকেশন কর্তৃপক্ষ নেই।’ ইউরোপীয় ইউনিয়ন অথবা ইউএস স্ট্যান্ডার্ড হেলমেট আমদানি অথবা দেশে অ্যাসেম্বলিংয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, দেশে অনেক প্রতিষ্ঠান মোটরসাইকেল উৎপাদন করছে। মোটরসাইকেলের সাথে হেলমেট যুক্ত করে প্যাকেজ মূল্য নির্ধারণের জন্য মোটরসাইকেল উৎপাদনকারীদের প্রতি আহ্বান করে নিম্নমানের হেলমেট আমদানি বন্ধেরও দাবি জানান আইজিপি। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বা আহত হলে এটা শুধু একটা পরিবারেরই ক্ষতি নয়, এতে দেশের অর্থনীতিও ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
বেপরোয়া গতির কারণেই বেশিরভাগ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটছে। এতে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে হতাহতের পরিবার । আহত অবস্থায় চিকিৎসা ব্যয় মেটাতেও হিমশিম খেতে হয় পরিবারের সদস্যদের। পুলিশের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহতদের ৮০ শতাংশ কখনোই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন না। দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসায় পরিবারের সদস্যরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন।
সম্প্রতি ঝিনাইদহ থেকে ঢাকা মেডিকেলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত ছেলেকে নিয়ে আসেন বিপ্লব কুরি। তিনি জানান, স্থানীয় ১২ বাজার এলাকায় তার অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হন। প্রথমে তাকে যশোর সদর হাসপাতালে নেয়া হলে সেখান থেকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর তাগিদ দেয়া হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসার পর তাকে এমআরআই করতে বলা হয়। এমআরআই রিপোর্টে মাথায় ভেতরে গুরুতর জখমের চিহ্ন পাওয়া যায়। পরে তাকে নিউরোসায়েন্স মেডিকেল কলেজে পাঠানো হলে সেখানে সিট খালি না থাকায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেখানে ১৫ দিনে ব্যয় হয়ে যায় অন্তত ৪ লাখ টাকা। এরপরও ছেলে তার স্বাভাবিক হতে পারেনি। অনেকটা স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছে একমাত্র ছেলে সৌরভ।
তিনি বলেন, স্থানীয় বাজারে তার একটি মিষ্টির দোকান রয়েছে। ব্যবসায়িক কারণে তিনি মোটরসাইকেল কেনেন। তার অজান্তেই ছেলে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ওই এক দুর্ঘটনায় পুরো ব্যবসা বন্ধের উপক্রম।
পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন যশোরের মাহবুবুর বলেন, বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাওয়ার পথে অতিরিক্ত গতির কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। স্থানীয় হাসপাতালে পর্যাপ্ত চিকিৎসা না পাওয়ায় তাকে পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো নয়। সব মিলিয়ে গত ১২ দিনে তার প্রায় ২ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। প্রথম অবস্থায় পা কেটে ফেলার পরামর্শ দেয়া হলেও পরে সে অবস্থান থেকে চিকিৎসকরা সরে আসেন। কয়েক দফা অপারেশন করে তার পা রক্ষা করা হয়েছে।
গত ১১ আগস্ট মোহাম্মদপুর থানাধীন গণভবনের সামনে, ট্রাকের চাকায় পিস্ট হয়ে মোটরসাইকেল আরোহী এটি এম মোতাকাব্বির হোসেন জুয়েল নিহত হন। তিনি বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের অধীনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের কারুকার্যের কাজ করতেন। ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার আমিনুল ইসলামের ছেলে। বর্তমানে মোহাম্মদপুর চন্দ্রিমা উদ্যানের বি ব্লকে বসবাস করতেন। এ ঘটনার পর তার পরিবারের সদস্যদের ঢাকা ছেড়ে গ্রামের বাড়ি চলে যেতে হয়েছে। গত ২ নভেম্বর ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালে সড়ক দুর্ঘটনায় মোটর সাইকেল আরোহী সহোদর দুই ভাই নিহত হয়েছেন। নিহতরা হলেন— ফিরোজ মোর্শেদ ও তৌহিদুল ইসলাম। তারা গাজীপুর নয়পুর থেকে গ্রামের বাড়ী জামালপুর সদরের নান্দিনা খড়খড়িয়ায় যাচ্ছিলেন। তাদের পিতার নাম আজিজুল হক। নিহতদের মধ্যে ফিরোজ মোর্শেদ গাজীপুরে ডিবিএল সিরামিকস এ চাকরি করতেন ও ছোট ভাই তৌহিদুল ইসলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। গত কয়েক দিন আগে তৌহিদুল বিসিএস পরীক্ষা দিতে ঢাকায় ভাইয়ের বাসায় এসেছিল। এক ঘটনায় দুই ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় নিহতের পরিবারের সদস্যরা।
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ