দেশের বিভিন্ন হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগে চরম অব্যবস্থাপনার মধ্যে করা হচ্ছে ময়নাতদন্ত। মানা হচ্ছে না কোনো নিয়মনীতি। দেশের কিছু কিছু মর্গ গোয়ালঘরকেও হার মানায়। লাশ উন্মুক্তভাবে ফেলে রাখা হয় এখানে-সেখানে। জেলা হাসপাতালগুলোর মেঝেতেও ফেলে রাখতে দেখা যায় লাশগুলোকে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা না থাকার কারণে অনেক লাশ গলে-পচে যায়, যার কারণে মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ণয় করা চিকিৎসকদের জন্য দুরূহ হয়ে যায়।
আধুনিক যন্ত্রপাতির বদলে মান্ধাতার আমলের ছুরি-হাতুড়ি দিয়ে শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি খাটিয়ে কাটা হয় লাশ। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নিশ্চিত করা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে বলে জানিয়েছেন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা।
জানা যায়, সারাদেশে ৩৭টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থাকলেও লাশ রাখার জন্য ফ্রিজ রয়েছে হাতেগোনা ৪-৫টিতে। এর বেশির ভাগই আবার নষ্ট। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ কক্ষ না থাকায় লাশ গলে-পচে নরম হয়ে যায়। এ কারণে ময়নাতদন্তে মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ধারণ করা অনেক সময়ই সম্ভব হয় না।
সূত্র জানায়, দেশে প্রতিনিয়তই অবকাঠামো উন্নয়ন বাড়ছে। তবে মর্গের উন্নয়নে দৃশ্যমান কোনো কাজ হচ্ছে না। একাধিক হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা হেছে, মর্গ আছে এমন হাসপাতালে ফ্রিজ কেনা বা মেরামত খাতে কোনো বরাদ্দ নেই। যুগ যুগ ধরেই এমন অব্যবস্থাপনা চলে আসছে।
রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গের অবস্থা বেশি করুণ। সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ফরেনসিক বিভাগ থাকলেও নেই ছাত্র-ছাত্রীদের প্র্যাকটিক্যাল করার ব্যবস্থা। নেই লাশ কাটার আধুনিক যন্ত্রপাতি। ভোঁতা চাকু-ছোরা ও হাতুড়ি দিয়ে ডোম একপ্রকার যুদ্ধ করে কাটে লাশ। মেঝেতে ফেলে চুরি-হাতুড়ি দিয়ে গায়ের জোরে লাশ কাটা হয় এখানে। অনেক ডোম ৪-৫ পুরুষ যে ছুরি-হাতুড়ি দিয়ে লাশ কেটেছেন তা দিয়েই লাশ কাটেন এখনো।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ সূত্র থেকে জানা যায়, প্রতিদিন সাত থেকে আটটি লাশ মর্গে আনা হয়। এর মধ্যে প্রতিদিনই ১-২টি থাকে অজ্ঞাত পরিচয় লাশ। এ ধরনের লাশ শনাক্তের জন্য সংরক্ষণ করতে হয়। অন্য লাশগুলোর সুরতহাল প্রতিবেদনসহ পুলিশি কাগজপত্র দেরিতে পৌঁছার কারণে ময়নাতদন্ত দেরি হয়; কিন্তু এসব লাশ সংরক্ষণের জন্য নেই পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। তাই সংশ্লিষ্টরা অনেকটা বাধ্য হয়েই লাশগুলোকে মেঝেতে ফেলে রাখেন। এতে অনেক সময়ই লাশগুলোতে পচন ধরে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফরেনসিক বিভাগের একজন চিকিৎসক জানান, রাজধানীর বিভিন্ন বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শিক্ষার্থীরা ময়নাতদন্তের ব্যবহারিক শিক্ষার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের মর্গে আসেন। বেশিরভাগ লাশের ময়নাতদন্ত করা হয় এসব শিক্ষার্থীদের সামনে। গুমোট পরিবেশে ক্লাস করতে গিয়ে এসব ছাত্রছাত্রীরা হাঁপিয়ে ওঠেন। দুর্গন্ধ সহ্য করতে না পেরে অনেককে বমি করতেও দেখা যায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছাত্রছাত্রীরা তো রয়েছেই।
হাসপাতাল মর্গের সহকারি সেকান্দর আলী নয়া শতাব্দীকে জানান, ‘এখানে পাঁচটি ফ্রিজের প্রতিটিতে ৪টি করে লাশ সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা ছিল। দীর্ঘদিন যাবত ৩টি ফ্রিজ নষ্ট। চালু থাকা ২টি ফ্রিজের মধ্যে ১টিতে রাখা হয়েছে দুই জঙ্গি আর দুই বিদেশি নাগরিকের লাশ। বাকি একটিতে রয়েছে হিন্দু-মুসলমান দুই স্ত্রীর দ্বন্দ্বে ২০১৪ সাল থেকে খোকন নামের এক ব্যবসায়ীর লাশ। এ ফ্রিজের বাকি তিনটি চেম্বারে রয়েছে অজ্ঞাত পরিচয় এক নারীসহ তিন লাশ। ফলে প্রতিদিন যে সব নতুন লাশ আসে তা মেঝেতে অথবা ট্রেচারে রাখতে হয়। ফলে মর্গের ভেতরে লাশের গলা-পচা গন্ধ দুর্বিষহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।’ সূত্র জানায়, সম্প্রতি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নতুন একটি অত্যাধুনিক ফ্রিজ আনা হয়েছে। এ ফ্রিজে এক সঙ্গে ৪০টির বেশি লাশ রাখা যাবে। তবে দীর্ঘদিন পার হলেও অজ্ঞাত কারণে ফ্রিজটি ব্যবহার করা হচ্ছে না। জানতে চাইলে ডিএমসি’র ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. মাকসুদুর রহমান নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘যে কোনো মেকানিক্যাল যন্ত্রপাতি দীর্ঘদিন ব্যবহার করা না হলে এমনিতেই নষ্ট হয়ে যায়। অত্যাধুনিক ফ্রিজটি এনে ফেলে রাখা নিছক সম্পদ নষ্টের নামান্তর।’
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুইটি ফ্রিজ রয়েছে যার দুটিই নষ্ট। বার বার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখেও কোনো সাড়া মেলেনি। এখানেও অব্যবস্থাপনায় লাশগুলো রাখা হয়। অনেক সময় রাতে ঠিকঠাক লাশ রেখে যাওয়া হয়। সকালে এসে দেখা যায় লাশের চোখ নাই বা কান নাই। পরে খুঁজে দেখা যায়, বেঁজি বা ইঁদুর নিয়ে গেছে চোখ-কান!
লাশকাটা ঘরে পাহারা না থাকার বিষয়ে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ জানান, লাশের দায়িত্ব পুলিশের। যে সমস্ত লাশ রাতে নিয়ে আসে সে সমস্ত লাশ পাহারার ব্যবস্থা পুলিশের করা উচিত। যতক্ষণ পর্যন্ত লাশ ময়নাতদন্তের জন্য লাশ কাটা ঘরে থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত ১-২ জন পুলিশ পাহারায় থাকা উচিত। লাশকাটা ঘর দুইটি মন্ত্রণালয় দেখভাল করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। যদি লাশগুলো পাহারা দেয়ার জন্যে পুলিশ নিয়োগ করা যায় তাহলে হয়তো লাশগুলো গলে-পচে যাওয়া ছাড়া আর কোনো ধরনের ক্ষতি হবে না।
উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও অমান্য করে চলছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৭ সালে ২৪ জুলাই হাইকোর্ট হাসপাতাল মর্গে ফ্রিজ মেরামতের নির্দেশ দেন। এরপর সাড়ে চার বছর পার হয়ে গেলেও নতুন একটি আধুনিক ফ্রিজ আনা ছাড়া কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
নয়া শতাব্দী/এমআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ