বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯)-এর প্রভাবে প্রায় দুই বছর ধরে লোকসান গুনেছেন হোটেল-মোটেল এবং ট্যুর অপারেটর ব্যবসায়ীরা। নিবন্ধিত ৭৩২টি ট্যুর অপারেটর আর ৪৪টি তারকা হোটেলসহ সারাদেশের পাঁচ শতাধিক হোটেল-মোটেল ছিল অতিথিশূন্য। এতে এই খাতে প্রায় সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতি কাটিয়ে ব্যবসায় গতি আনতে হোটেল-মোটেল ও থিম পার্কের জন্য ব্যাংক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রণোদনা হিসেবে এক হাজার কোটি টাকা ঋণ সুবিধা দিয়েছে সরকার। এ সুবিধার বাইরে রাখা হয় ট্যুর অপারেটরদের। তবে মহামারির বিধিনিষেধ শিথিল করার পর সুবাতাস বইতে শুরু করেছে পর্যটন খাতে।
জানা গেছে, পর্যটন খাতের মোট আর্থিক ক্ষতির মধ্যে ট্যুর অপারেটরদের ক্ষতি সব থেকে বেশি ১০ হাজার কোটি টাকা। আর হোটেল খাতে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। জিডিপিতে চার দশমিক চার শতাংশ অবদান রাখা ট্যুর অপারেটর খাতে জড়িত আছেন প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। করোনার শুরু থেকেই ট্যুর অপারেটররা প্রণোদনার দাবি জানিয়ে এলেও সরকার তাতে সাড়া দেয়নি। এমনকি এই খাতটি সেবা খাতের অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও কোনো প্রকার ব্যাংক ঋণও পাচ্ছেন না তারা।
ট্যুর অপারেটর অ্যাসেশিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব) সভাপতি মোহাম্মদ রাফেউজ্জামান নয়া শতাব্দীকে বলেন, পর্যটক আকর্ষণের জন্য অপারেটররা প্রতি বছর বিভিন্ন পর্যটন মেলার আয়োজন করে থাকে। উদ্দেশ্য— বিদেশি পর্যটকদের দেশীয় পর্যটনে আকর্ষণ করা। মহামারির কারণে তা করা সম্ভব হয়নি। মহামারিতে অপারেটররা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের নিয়মিত কোনো প্যাকেজও পরিচালনা করেনি। ফলে সব অপারেটর আর্থিক ক্ষতির কারণে এক প্রকার মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য এবং নতুন ব্যবসা শুরু করতে সরকারের কাছে বারবার প্রণোদনার আবেদন করেও সাড়া পাননি। তাই সরকার পর্যটন খাত থেকে বিধিনিষেধ তুলে নিলেও কাঙ্ক্ষিতভাবে ব্যবসা শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না তাদের।’
বেসরকারি বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেছেন, প্রণোদনা দেয়া বা অনুমোদন দেয়া এই মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। তবে ট্যুর অপারেটর প্রণোদনা দিতে অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সংস্থায় চিঠি দেয়া হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সাড়া পাওয়া যায়নি।
হোটেল-মোটেল ও থিম পার্কের জন্য প্রণোদনা হিসেবে এক হাজার কোটি টাকা ঋণ সুবিধা দিয়েছে সরকার। এই ঋণের সুদ হার হবে সর্বোচ্চ আট শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এই ঋণের ওপর আরোপিত সুদের অর্ধেক অর্থাৎ চার শতাংশ দেবে ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠান। বাকি অর্ধেক অর্থাৎ চার শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে ব্যাংকে পরিশোধ করবে। তবে এই ঋণের পরিমাণ কোনোভাবেই এক হাজার কোটি টাকার বেশি হতে পারবে না।
বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল হোটেল অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল মহসিন হক হিমেল বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে হোটেলগুলো পড়েছে চরম সংকটে। প্রাথমিক হিসাবে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হিসাব করা হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই অঙ্ক আরো বাড়ছে। এই অবস্থায় হোটেল মালিকদের টিকে থাকার জন্য সরকার যে প্রণোদনা দিয়েছে তা দিতেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। ফলে অনেকটাই অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন এই খাতের ব্যবসায়ীরা। তবে ইদানীং পর্যটন এলাকায় ভিড় বাড়ছে। ফলে এই খাত আগের মতো আবার ফিরবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
জানা গেছে, গত ১৫ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক প্রণোদনাসংক্রান্ত সার্কুলার প্রকাশ করার পর এখন পর্যন্ত মাত্র ৪/৫টি হোটেল প্রণোদনার জন্য আবেদন করে। বাকিরা এখনো আবেদন না করলেও আবেদন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে হোটেলকে সরকার সরাসরি শিল্প হিসেবে স্বীকৃতি না দেয়ায় অন্যান্য সুবিধা পাচ্ছেন না এই খাতের ব্যবসায়ীরা। যদিও পর্যটনকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। মাত্র চার শতাংশ সুদে ঋণ সুবিধা পাওয়ার পরও অন্যরা আবেদন করছে না কেন—এর কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, সরকার প্রণোদনার জন্য অর্থের অংক ঘোষণা করেছে। কিন্তু ব্যাংক কোন খাত থেকে এই অর্থের জোগান দেবে বা অর্থের উৎস কী হবে তা জানে না ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। ফলে হোটেল মালিকরা ঋণের বিষয়ে ব্যাংকে যোগাযোগ করলে ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছেন না। এতে তারা ঋণের প্রতি অনেকটা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। ওই বছরের ৮ মার্চ দেশে করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে পুরোপুরি অতিথিশূন্য হয় হোটেলগুলো। এরপর কয়েক দফা লকডাউনের কবলে পড়ে দেশ। গত আগস্টে লকডাউন তুলে নেয়া হলেও বিদেশি অতিথিরা এখনো আসা শুরু করেনি। দেশি অতিথিরাও এতদিন আগের মতো ভ্রমণ করেননি। ইদানীং পর্যটন কিছুটা বাড়লেও তা আগের মতো নয়। তবে দিন দিন অতিথি বৃদ্ধি পাওয়ায় এই খাতে আশা দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
আগের মতো নানা রকম মেলা, সভা, সেমিনার ও অনুষ্ঠান হচ্ছে না। বিদেশি অতিথিদের বেশিরভাগই আসেন চীন, জাপান, ভারত, ফ্রান্স, ডেনমার্ক ও শ্রীলঙ্কা থেকে। সাধারণত বছরের প্রথম তিন মাসে ব্যবসায়িক কারণে যেসব বিদেশি বাংলাদেশ ভ্রমণ করে থাকেন, তাদের বড় একটি অংশ পোশাক খাতের ক্রেতা। কিন্তু দুই বছরের পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। করোনা আতঙ্কে পাশ্চাত্যের পোশাক খাতের ক্রেতাদের আগমন এখন একেবারে তলানিতে। সাধারণ সময়ে ৭০ শতাংশের বেশি রুমে অতিথি থাকলেও করোনার প্রভাবে তা ছিল শূন্য।
বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল হোটেল অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘রাজধানীর পাঁচ তারকা হোটেলগুলোয় বিদেশিদের বুকিং বাতিল শুরু হয় গত বছরের ২০ জানুয়ারির পর থেকে। ওই সময় যারা ভ্রমণে ছিলেন তারা ভ্রমণ সংক্ষিপ্ত করে ফিরে যান। এতে পাঁচতারকা হোটেলগুলোর সুইমিংপুল, জিমনেশিয়াম ও বারসহ সব সেবাই বন্ধ হয়ে যায়।
বেসরকারি বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, করোনাভাইরাস বিশ্বের ভ্রমণ ও পর্যটন খাতের ওপর এখনো বিরূপ প্রভাব রয়েছে। কারণ সংক্রমণের ভয়ে খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া কেউ আর ভ্রমণ করছেন না। ফলে ট্যুর অপারেটর আর হোটেলগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে দেশের তারকা হোটেলগুলোর ৯৭ শতাংশ অতিথিই বিদেশি, যারা মূলত পোশাক খাতের বিদেশি ক্রেতা এবং বিভিন্ন দূতাবাসসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা। পোশাক খাতের বিদেশি ক্রেতারা মূলত চীন থেকে কাপড় কিনে বাংলাদেশ আসেন তৈরির অর্ডার দিতে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্রেতারা যেহেতু চীনে যাচ্ছেন না, তাই তারা বাংলাদেশেও কম আসছেন। বিদেশি পর্যটকদের বেশিরভাগই বাংলাদেশ ভ্রমণ বাতিল করে। এরই প্রভাব পড়ছে হোটেলগুলোর বুকিংয়ে। তবে পরিস্থিতির অবনতি না হলে হয়তো পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে। তারপরও ঘুরে দাঁড়াতে সময় লাগবে।
বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সূত্রে আরো জানা গেছে, বিদেশি উদ্যোক্তাদের সঙ্গে যৌথভাবে প্রায়ই বাণিজ্যিক প্রদর্শনী ও মেলার আয়োজন করে থাকেন বিভিন্ন খাতের দেশি ব্যবসায়ীরা। ভেন্যু হিসেবে এসব মেলা ও প্রদর্শনী আয়োজনের মাধ্যমেও বেশ ভালো ব্যবসা হয় ট্যুর অপারেটর আর পাঁচ তারকা হোটেলগুলোর। কিন্তু করোনার কারণে এ ধরনের অনুষ্ঠানও এখন হচ্ছে না। করোনার সময় বাংলাদেশ প্লাস্টিক দ্রব্য প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক অ্যাসোসিয়েশন (বিপিজিএমই) এবং তাইওয়ানের প্রতিষ্ঠান ইয়র্কারস ট্রেড অ্যান্ড মার্কেটিং সার্ভিস কোং লিমিটেডের যৌথ উদ্যোগে ১৫তম আন্তর্জাতিক প্ল্লাস্টিক মেলা-২০২০ এবং বিটিএমইএর টেক্সটাইল ও গার্মেন্ট মেশিনারি প্রদর্শনী বাতিল হয়েছে। একইভাবে স্থগিত করা হয়েছে এরকম অনেক মেলা ও প্রদর্শনী।
হোটেল খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনাভাইরাসের প্রভাবে শুধু বাংলাদেশই নয়, এশিয়াজুড়ে পর্যটক ও বিজনেস ট্রাভেলারের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। চীন ও অন্যান্য আক্রান্ত দেশ ভাইরাসটিকে পুরোপুরি নির্মূল করতে না পারলে এশিয়ার পর্যটন খাত সহসা গতি পাবে না। বিশেষ করে তারকা হোটেলগুলো দীর্ঘমেয়াদি ব্যবসায়িক ক্ষতির মুখেই থাকবে। এর একটি দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব চলমান থাকবে।
বর্তমানে দেশে পাঁচ তারকা হোটেল রয়েছে ১৭টি। এর মধ্যে ১০টির অবস্থান রাজধানী ঢাকায়, যেগুলোর কক্ষ সংখ্যা প্রায় ২ হাজার। এর মধ্যে প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডে ২৭৭টি, ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঢাকায় ২২৬টি, র্যাডিসন ওয়াটার গার্ডেন হোটেলে ২০৫টি, ওয়েস্টিনে (ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট লিমিটেড) ২৩৫টি, লা মেরিডিয়ান ঢাকায় ৩১৭টি, রেনেসাঁস হোটেলে ২১১টি, ফোর পয়েন্টসে ১৪২টি ও হোটেল আমারিতে ১৩৪টি অতিথি কক্ষ রয়েছে।
নয়া শতাব্দী/এমআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ