ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

সাড়ে ৯ কোটি টাকা পানিতে!

প্রকাশনার সময়: ২৬ ডিসেম্বর ২০২১, ০৬:৫১
সংগৃহীত ছবি

রাজধানীর বৃত্তাকার নৌপথে ওয়াটার বাস প্রকল্প ভেস্তে গেছে। বর্তমানে ১২টি ওয়াটার বাসের মধ্যে একটি ছাড়া বাকিগুলো পড়ে আছে অব্যবহৃত অবস্থায়। ১১ বছর আগে চালু হলেও প্রকল্পটি কখনো লাভের মুখ দেখেনি। মোট ৯ কোটি ২১ লাখ টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পটি এখন অচল। জ্বালানি খরচ, কর্মকর্তাদের বেতন ভাতাসহ কয়েক কোটি টাকা লোকসান গুনেছে প্রতিষ্ঠানটি। এ পরিস্থিতিতে অব্যাহত লোকসানের মুখে ওয়াটার বাস বিক্রি করে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি)।

বিআইডব্লিউটিসির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বুড়িগঙ্গার বাদামতলী ঘাট থেকে আমিনবাজার পর্যন্ত ওয়াটার বাস চলাচল শুরু হয় ২০১০ সালে। নামানো হয় ১২টি ওয়াটার বাস। এর মধ্যে ৭টি সচল, বাকি ৫টি অচল। সচল ৭টি ওয়াটার বাসের চারটি একটি প্রতিষ্ঠান ভাড়া নিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে যাত্রী পারাপার করছে। একটি চট্টগ্রামে বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ব্যবহার করছেন। অপরটি ডকইয়ার্ডে মেরামতাধীন রয়েছে। বাকিগুলো ফেলে রাখা হয়েছে। এ অবস্থায় এসব ওয়াটার বাস বিক্রির জন্য নিলাম বা টেন্ডার করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যানজট কমাতে সড়ক, রেল ও নদী তিনটি পথই একসঙ্গে কাজে লাগানোর বিকল্প নেই। তবে ঢাকার পুরো নৌপথ তো দূরের কথা, দফায় দফায় চেষ্টা করে সদরঘাট-গাবতলী পথ, টঙ্গী-নারায়ণগঞ্জ পথ ও শেষে বুড়িগঙ্গায় পারাপারেও ব্যর্থ যাত্রীবাহী ওয়াটার বাস। তড়িঘড়ি করে চালু করা এ প্রকল্পে সম্ভাব্যতাও পরীক্ষা হয়নি। ২০০৪ সালে যাত্রা শুরুর পর ক্রমাগত কোটি কোটি টাকা জলে যায়। কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতার জন্যই মূলত এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কারণ এ প্রকল্পটি হাতে নেয়ার আগে ছিল না কোনো সামগ্রিক পরিকল্পনা। ফলে এটি এখন সরকারের মন্দ বিনিয়োগে পরিণত হয়েছে।

জানতে চাইলে নগর বিশেষজ্ঞ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব নয়া শতাব্দীকে বলেন, ঢাকার চারপাশের নদ-নদীর দখলমুক্ত করে নাব্য বৃদ্ধি করে বৃত্তাকার নৌপথ চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর। সে লক্ষ্যে বেশকিছু কর্মপরিকল্পনাও আলোচনা করা হয়। তবে কর্তৃপক্ষ সার্বিকতা নির্ভর পরিকল্পনা না করে তড়িঘড়ি করে ওয়াটার বাস ক্রয় করে। এটা ঘোড়ার আগে গাড়ি কেনার মতো ঘটনা ঘটেছে।

বিআইডব্লিউটিসির নথিপত্র থেকে জানা যায়, তিন দফায় উৎপাদিত ১২টি ওয়াটার বাসের উৎপাদনে খরচ হয়েছে মোট ৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। শুধু ২০১৮-১৯ অর্থবছরের হিসাব ঘেঁটে দেখা যায়, সদরঘাট গাবতলী নৌপথে আয় হয় ৭ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। এই সময় শুধু জ্বালানি খরচই ছিল ৪১ লাখ টাকা। এর বাইরেও রয়েছে রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় ও কর্মীদের বেতন ভাতা। তবে শেষ পর্যন্ত কয়েক কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। জ্বালানি খরচ, বেতন ভাতাসহ অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তার নির্দিষ্ট পরিমাণ জানা যায়নি। বৃত্তাকার নৌপথ প্রকল্পের তিন পর্বের উদ্যোগে প্রথম দুটিতেই খরচ হয় প্রায় ১০০ কোটি টাকা।

জানা যায়, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর বৃত্তাকার নৌপথ সচল করতে ১২টি ওয়াটার বাস ক্রয় করে বিআইডব্লিউটিসি। প্রথম দফায় ৩৫ আসনবিশিষ্ট ২টি ওয়াটার বাস ক্রয় করে ১ কোটি ১১ লাখ টাকায়। দ্বিতীয় দফায় ৮৩ আসনবিশিষ্ট ৪টি ওয়াটার বাস ক্রয় করে ৩ কোটি টাকায় এবং সর্বশেষ ৪৬ আসনবিশিষ্ট ৬টি ওয়াটার বাস ক্রয় করে ৫ কোটি টাকায়।

পরীক্ষামূলকভাবে শুরুতে ১০৭ কোটি টাকা ব্যয়ে বাদামতলী থেকে আমিনবাজার পর্যন্ত ওয়াটার বাস নামানো হয়। ২০১৩ সালে সবগুলো বাস চলাচল শুরু করে বৃত্তাকার নৌপথে। তবে ওই সময়েই ওয়াটার বাসগুলো লোকসান গুনতে শুরু করে। ফলে ২০১৪ সালে সেগুলোর চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ওয়াটার বাস চালুর আগে বৃত্তাকার নৌপথে নতুন করে ১০টি ল্যান্ডিং স্টেশন নির্মাণ করার কথা ছিল। একই সঙ্গে এসব ল্যান্ডিং স্টেশনের সঙ্গে শহরের যোগাযোগের জন্য যানবাহনের আয়োজন করে ওয়াটার বাস চালু করার দরকার ছিল। তবে সেসব কাজ বাস্তবায়নের আগেই ওয়াটার বাস ক্রয় করে চলাচল শুরু করা হয়।

২০২০ সালের মার্চে বাদামতলী-গাবতলী রুট বন্ধ হওয়ার পর বর্তমানে চারটি ওয়াটার বাস (ওয়াটার বাস-৮, ৯, ১০ ও ১১) বুড়িগঙ্গা নদীতে ডিঙ্গি নৌকার পাশাপাশি যাত্রী পারাপার করছে। বিনিময়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন মাসে প্রতিটি ওয়াটার বাস থেকে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা ভাড়া পাচ্ছে।

বিআইডব্লিউটিসির একাধিক কর্মকর্তা জানান, ওয়াটার বাস চালুর শুরুতে এ নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা গেলেও কিছুদিন যেতে না যেতেই সে উৎসাহে ভাটা পড়ে। ল্যান্ডিং স্টেশনে নিরাপত্তার অভাব, নদীপথে চলাচলে নানা প্রতিকূলতা, নদীর পানি দূষণ, ল্যান্ডিং স্টেশন, ওয়ার্কওয়ে, বনায়ন, নদীর পাড়ের সৌন্দর্য বর্ধন ও নৌঘাট থেকে শহরে চলাচলের যানবাহনের ব্যবস্থা না করায় এ উদ্যোগ ভেস্তে গেছে। সমস্যার কারণে যাত্রী সঙ্কট দেখা দেয়ায় বন্ধ করে দেয়া হয় ওয়াটার বাস সার্ভিস।

বিআইডব্লিউটিসির সদ্য প্রাক্তন চেয়ারম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, যাত্রীসেবার উদ্দেশে যে নৌপথ নির্মাণ করা হয়েছিল, সেই লক্ষ্য অর্জন না হওয়া, আয়ের কয়েকগুণ বেশি লোকসান হওয়া এবং সামনের দিনগুলোয় এসব ওয়াটার বাস কাজে লাগানোর কোনো সুযোগ না থাকায় এগুলো বিক্রির আলোচনা চলছে।

তিনি আরো বলেন, ওয়াটার বাসগুলো টেকসই নয়। এগুলোয় লোকসানের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। নদীতে ছোট নৌযান ও বালুবাহী জাহাজ চলাচল অসুবিধা হওয়ায় ওয়াটার বাস পুরো গতিতে চালানো যাচ্ছে না। ফলে গন্তব্যে যেতে সময় বেশি লাগছে। মানুষ এত সময় নিয়ে ওয়াটার বাসে চড়তে চায় না।

জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, ওয়াটার বাস ভাল উদ্যোগ ছিল। তবে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা এটাকে আকর্ষণীয় করে তুলতে পারেননি। সে কারণে এই প্রকল্প ভেস্তে গেছে। বৃত্তাকার নৌ-পথে সারা বছরই নাব্য থাকে, তবে শুষ্ক মৌসুমে পানি দুর্গন্ধ থাকে। বর্ষা মৌসুমে তো এটা অনেক জনপ্রিয় করে তোলা যায়।

যে কারণে টেকেনি প্রকল্প: নানা কারণে টিকতে পারেনি ওয়াটার বাস। এর মধ্যে সংশ্লিষ্ট সব কটি পক্ষই সবচেয়ে বেশি দায়ী করেছে নদী দূষণকে। ২০১৭ সালে বিআইডব্লিউটিসির একটি সমীক্ষা প্রতিবেদনেও ১২টি কারণের মধ্যে নদীদূষণকে দায়ী করা হয়েছিল। সদরঘাটমুখী যানজট, ঘাটে যাতায়াতের অনুন্নত ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছিল। বাস্তবে কচুরিপানার মধ্যে বাস আটকে পড়ার ঘটনাও ঘটেছে।

বিআইডব্লিউটিসির পরিচালক (বাণিজ্য) এস এম আশিকুজ্জামান বলেন, অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত দূষিত পানিতে চলাচল করা চ্যালেঞ্জ। গার্মেন্টের ঝুট, পলিথিন ওয়াটার বাসের প্রোপেলারের সঙ্গে আটকে যেত। সদরঘাট-গাবতলী নৌপথের পাশ ঘেঁষা বেড়িবাঁধ ওয়াটার বাসে লোকসানের অন্য আরেকটি কারণ। বেড়িবাঁধ ধরে চলা বাসে গন্তব্যে পৌঁছাতে লাগে ঘণ্টাখানেক সময়, যেখানে ওয়াটার বাসে যেতে লাগত দেড় ঘণ্টার মতো।

বিআইডব্লিউটিসি ও বিআইডব্লিউটিএর কয়েকটি সূত্র অভিযোগ করেছে, অন্য নৌযান মালিকদের স্থানীয় সিন্ডিকেট ওয়াটার বাস পরিবহনে একটি বড় বাধা ছিল। ওয়াটার বাসের গতিতে অন্য নৌযানগুলোর সমস্যা হয় এ অভিযোগে বসিলা ও ঢাকা উদ্যান এলাকায় কয়েকবার ওয়াটার বাস আটকে দিয়েছিলেন স্থানীয় ট্রলার, নৌকা ও বালুবাহী বাল্কহেডের মালিক-শ্রমিকেরা। এমনকি বাসগুলোতে ঢিল মারার ঘটনাও ঘটেছে।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ