দেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে। যার প্রভাবে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য। এগুলোর মধ্যে রয়েছে, কোমলপানীয়র বোতল, কসমেটিকসের মোড়ক, নিত্যব্যবহার্য বিভিন্ন পণ্যসহ পলিথিন ব্যাগ। পরিবেশের ক্ষতিকারক হিসেবে চিহ্নিত এসব জিনিসের ব্যবহারই এখন বেশি চলছে রাজধানীসহ সারাদেশে।
বর্তমান বিশ্বের অন্যতম প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা, যা বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশকে একটি একক পর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের একাধিক কারণ আমাদের সামনে দণ্ডায়মান। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে এটি যতটা না প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট, তার থেকেও বেশি মানবসৃষ্ট। মানবসৃষ্ট একাধিক কারণের মধ্যে একটি হচ্ছে প্লাস্টিক।
তথ্য মতে, ২০১৭ সালের ১০০ মিলিয়ন টন পলিইথিলিন রেজিন প্রতি বছর উৎপাদিত হচ্ছে দেশে। গত ২০ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাংকের পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ঢাকায় বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ২৪ কেজি, যা জাতীয় গড় থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। ঢাকার বাইরের শহরাঞ্চলে বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহার ২০০৫ সালে ছিল ৩ কেজি। ২০২০ সালে যা তিনগুণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ কেজি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০৩০ সালের মধ্যে এর পরিমাণ ৩৪ কেজিতে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। আকার ও ওজনে সুবিধাজনক হলেও প্লাস্টিকের বোতল স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্লাস্টিকের পাত্রে কিছু রেখে খাওয়া ও প্লাস্টিকের বোতলে পানি পান করা ক্যানসারের কারণ হতে পারে। প্লাস্টিকের পাত্রে খাবার গরম করলেও ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান বের হয়ে খাবারের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে। ফলে অ্যাজমা, অটিজম, হরমোনজনিত সমস্যা হতে পারে। গত কয়েক শতাব্দীতে প্লাস্টিক থেকে তৈরি নানা দ্রব্য আমাদের জীবনযাপনের ধারাকে হয়তো বদলে দিয়েছে, কিন্তু প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার শেষে আমাদের জন্য যে বিষাক্ত হয়ে উঠছে, তা অজানা নয়।
বর্তমানে দেশে প্লাস্টিক ব্যবহারের প্রবণতা অতিমাত্রা বেড়েই চলেছে। দেখা গেছে, এটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান করে নিয়েছে। সবজি, মাছ, তরিতরকারি কেনাকাটা থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রয়োজনে আমরা পলিথিন ব্যবহার করছি। অনেক সময় কাগজের ব্যাগ কিংবা পলিথিনের বিকল্পব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও প্রতিনিয়ত পলিথিন ব্যবহারে অভ্যস্ত হওয়ায় আমরা সেই পথে এগোতে পারছি না। বিশেষ করে শহরের মানুষ থলে ব্যবহার না করায় পলিথিনের ওপর অধিক নির্ভরশীল। কারণ গ্রামের মানুষ কাঁচাবাজার বা মুদি মালামাল কিনতে সবসময় একই থলে ব্যবহার করে। পাশাপাশি দেখা যায়, শহরের অধিকাংশ পরিবার খাদ্যদ্রব্য পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে ফ্রিজে রাখে। অথচ আমরা অনেকেই জানি না যে, পলিথিন মোড়ানো খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণ করলে খাদ্যদ্রব্যে এক ধরনের অবায়বীয় ব্যাকটেরিয়ার কবলে পড়ে। এর ফলে আমরা মারাত্মক চর্মরোগসহ ক্যানসারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছি। বর্তমানে আমাদের অসচেতনতার কারণে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে প্লাস্টিক দূষণের নতুন নতুন উৎস তৈরি হচ্ছে।
প্লাস্টিক হলো সিনথেটিক বা সেমি-সিনথেটিক ও নিম্ন গলনাঙ্কবিশিষ্ট পদার্থ, যা তাপীয় অবস্থায় যে কোনো আকার ধারণ করতে পারে এবং পুনরায় কঠিনে রূপান্তরিত হতে পারে। প্লাস্টিক স্থায়ী, সহজলভ্য, সস্তা এবং সহজে বহনযোগ্য হওয়ায় আমরা সবাই প্লাস্টিক ও প্লাস্টিকজাত দ্রব্য ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে শুরু করে উন্নয়নশীল এমনকি উন্নত দেশেও প্লাস্টিক একটি নিত্য ব্যবহার্য বস্তু। শিল্পোন্নত দেশগুলোতে বিভিন্ন পণ্য বাজারজাতকরণের জন্য প্লাস্টিক চাহিদা ব্যাপক। অথচ কেউই জানে না এই প্লাস্টিক আমাদের এবং আমাদের পরিবেশের জন্য কতটা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা যেসব প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্যাদি ব্যবহার করি, সেগুলো তৈরি হয় তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস প্রভৃতি জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করে। প্লাস্টিকের গামলা, বালতি, চায়ের কাপ, স্ট্র, পানির বোতল, জগ, কোমল পানীয়র পাত্র ইত্যাদি আরো অনেক ক্ষেত্রে প্লাস্টিক ব্যবহূত হয়ে থাকে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক ও স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার নয়া শতাব্দীকে বলেন, আমাদের প্লাস্টিকের যত সহজলভ্যতা আছে, চাহিদার যে প্রবণতা আছে তা অত্যধিক। পৃথিবীর অন্য দেশগুলোতে ডিপার্টমেন্টাল স্টোর বা শপিং মলে কিছু কেনাকাটা করা হয় বা কেউ যদি পলিথিনের ব্যাগ নিতে চায় তাহলে তাকে এডিশনালি টাকা তুলনামূলকভাবে পে করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এটা একদম ফ্রি দেয়া যায়। ফলে যদি আমরা দশটা পণ্য কিনি তাহলে আমাকের দশটা পলিথিনের ব্যাগ দেয়া হচ্ছে। এটির জন্যই আসলে বাৎসরিক পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিমাণ বেড়ে যায়।
তিনি বলেন, আমাদের এখন প্রাত্যাহিক জীবনের একটা আনুষঙ্গিক হয়ে গেছে পানির বোতল, সিঙ্গেল টাইম গ্লাস বা প্লেট এগুলো ব্যবহার করা। আর কোভিডকালীন মাস্ক, গ্লোভসসহ অন্যান্য সামগ্রী যে আমরা ব্যবহার করছি তার ভিতরে অধিকাংশ প্লাস্টিক বা টিস্যু দিয়ে তৈরি। সার্বিকভাবে এটা সুলভে পাওয়া যায় বলে এটির প্রতি মানুষের আগ্রহ বেশি। অন্যদিকে, প্লাস্টিকের বিপরীতে এখনো কোনোকিছু সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছে দেয়ার মতো বিকল্প কিছু বর্তমান সময়ে নেই। পাটের তৈরি, কাপড়ের তৈরি ব্যবহার দেশে থাকলেও এগুলোকে আমরা জনপ্রিয় করে তুলতে পারিনি। ফলে প্লাস্টিক বা পলিথিন আমাদের প্রধান ব্যাগ হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
প্লাস্টিকের হুমকি মোকাবিলায় সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ বলে জানিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়কমন্ত্রী শাহাব উদ্দিন। গত সোমবার রাজধানীর এক অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, প্লাস্টিকের হুমকি মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় প্লাস্টিকের দূষণ কমানোর জন্য কয়েকটি উদ্যোগ নেয়, যা পরে প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়।
বাংলাদেশে নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর ড্যান ড্যান চেন বলেন, নগরায়ণের ফলে বাংলাদেশে প্লাস্টিক ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে। ফলে দূষণও তীব্রভাবে বাড়ছে। করোনা সংকট প্লাস্টিক বর্জ্যের সমস্যাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এ জন্য টেকসই প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা জরুরি। একটি পণ্য ডিজাইন করা থেকে শুরু করে, প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো, পুনর্ব্যবহার করা, দেশের সবুজ প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে।
তিনি বলেন, প্লাস্টিক দূষণ রোধে জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন ৩০ শতাংশ কমানোর পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। সঠিক সময়ে কর্মপরিকল্পনার বাস্তবায়ন করতে হবে। তা না হলে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি অর্জন বাধাগ্রস্ত হবে।
নয়া শতাব্দী/এমআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ