ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে ঢাকা থেকে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে এখন পর্যন্ত ৩৯ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। দগ্ধ হয়েছেন শতাধিক। বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অন্তত ৭০ জনকে ভর্তি করা হয়েছে।
এদিকে সকালের দিকে ঘন কুয়াশার কারণে উদ্ধার অভিযান ব্যাহত হচ্ছিল। ঝালকাঠি ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক কামাল উদ্দিন ভুইয়া জানান, এ পর্যন্ত ৪০ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন শতাধিক যাত্রী। ঝালকাঠি সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খলিলুর রহমান বলেন, লঞ্চে পাঁচ শতাধিক যাত্রী ছিলেন। আগুনে দগ্ধ হয়েছেন শতাধিক। দগ্ধ বেশ কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। তবে এর সঠিক সংখ্যা জানা যায়নি। হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলেও জানান ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তা কামাল উদ্দিন।
শুক্রবার ভোর ৩টার দিকে লঞ্চটিতে আগুন লাগে বলে জানিয়েছেন যাত্রীরা। সদর উপজেলার পোনাবালি ইউনিয়নের নিয়াকুল এলাকায় এলে লঞ্চ থেকে কিছু যাত্রী নামতে পেরেছেন।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন একাধিক যাত্রী ও স্বজনেরা জানান, বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে লঞ্চে আগুন লাগে। আকস্মিকভাবে ইঞ্জিন রুম থেকে আগুনের লেলিহান শিখা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আগুন ও ধোঁয়ায় লঞ্চ আচ্ছন্ন হয়ে পড়লে ডেকে হুড়োহুড়ি লেগে যায়। প্রাণ বাঁচাতে অনেকে নদীতে ঝাঁপ দেন। কেবিন থেকে বের হয়ে চারদিকে ছোটাছুটি করতে থাকে মানুষ। ধাক্কাধাক্কি ও পদদলিত হয়ে অনেকে আঘাতপ্রাপ্ত হন। যাত্রীরা দিশেহারা হয়ে চিৎকার করতে থাকেন। যে যেভাবে পেরেছেন আত্মরক্ষার চেষ্টা করেছেন। অনেকে স্বজনদের রেখেই নদীতে ঝাঁপ দিয়েছেন।
লঞ্চের যাত্রী শিমুল তালুকদার জানান, ঝালকাঠি লঞ্চ টার্মিনালের ঠিক আগে গাবখান সেতুর কিছু আগে লঞ্চের ইঞ্জিন রুমে আগুন লেগে যায়। এরপর সেই আগুন পর্যায়ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে পুরো লঞ্চে। জীবন বাঁচাতে তিনি নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতরে তীরে ওঠেন। তবে অনেকেই লঞ্চে থেকে যায়।
নিচতলার ইঞ্জিন রুম সংলগ্ন জায়গায় যেসব যাত্রী ঢাকা থেকে বরগুনার উদ্দেশে রওনা হন তাঁরাই বেশি দগ্ধ হয়েছে। কয়েকজনকে শরীরে আগুন নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিতে দেখেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
লঞ্চের যাত্রী সাইদুর রহমান জানান, তিনি ঢাকা থেকে বরগুনা ফিরছিলেন। ঝালকাঠি লঞ্চ টার্মিনালের ঠিক আগে গাবখান সেতুর কাছে এলে ইঞ্জিন রুমে আগুন লেগে যায়। এরপর সেই আগুন পর্যায়ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে পুরো লঞ্চে। রাত ৩টা থেকে আগুন জ্বলতে থাকে। যাত্রীরা অনেকেই নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতরে তীরে উঠতে পেরেছেন। অনেকে হয়তো পারেননি। লঞ্চে শিশু, বুড়ো, নারীসহ কমপক্ষে ৫০০ যাত্রী ছিল।
বিদেশফেরত এই যাত্রী বলেন, ‘পোড়া গন্ধ পেয়ে আমি ভিআইপি কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে দেখি লঞ্চে আগুন লেগেছে। তখন আমার স্ত্রী, শ্যালক নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রচণ্ড ঠান্ডায় নদী সাঁতরে তীরে উঠেছি। লঞ্চ ভাসতে ভাসতে কোথাও গিয়ে থেমেছে। তবে এটুকু বলছি, লঞ্চের কোনো অংশ পোড়ার বাকি নেই।’
লঞ্চের যাত্রী রাজু আহমেদ জানান, লঞ্চে পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট ও বয়া ছিল। হাতেগোনা পাঁচ সাতটি বয়া নদীতে ভাসতে দেখেছেন তিনি। ৩২৩ নম্বর কেবিনের যাত্রী রাজু আরও জানান, মাস্টার ব্রিজের পেছনেই ছিল তাঁর কেবিন। চিৎকার চেঁচামেচি শুনে কেবিন থেকে বের হয়ে জানতে পারেন আগুন লাগার কথা। তখন লঞ্চের সারেংকে জিজ্ঞেস করলে জানানো হয়, আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তাঁদের ভুল তথ্যের কারণেই হতাহত বেশি হয়েছে বলে উল্লেখ করেন রাজু।
ইঞ্জিন রুমের পাশেই ছিলেন আরেক যাত্রী হালিমা বেগম। তিনি জানান, বিকট শব্দে ইঞ্জিন বিস্ফোরণ হয়েছে। সেখান থেকেই আগুনের সূত্রপাত। সেখান থেকে কোনো মতে তিনি বেঁচে ফিরলেও তাঁর বৃদ্ধ বাবা হামিদ হাওলাদারকে খুঁজে পাচ্ছেন না।
বরগুনার তালতলি উপজেলার মোসা. সোনিয়া বেগম (২৫) নামের এক যাত্রী কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, লঞ্চে আগুন লাগার সময় তিনি ইঞ্জিন রুমের ওপরে দোতলার ডেকে অবস্থান করছিলেন। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে ডেক গরম হয়ে চারিদিক ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এরপর লঞ্চের সঙ্গে বাঁধা দড়ি বেয়ে ছোট ছেলেকে নিয়ে নিচে নামেন। এরপর নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে তীরে ওঠেন। তবে তার মা রেখা বেগম এবং ৫ বছরের বড় ছেলে জুনায়েদ সিকদার এখনো পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছেন।
লঞ্চটির যাত্রী রিমন হোসেন ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, লঞ্চটি ঝালকাঠি ঘাটে ভিড়ানোর ১০ থেকে ১৫ মিনিট আগে আগুন লাগে। মাস্টার প্রথমে লঞ্চটি পাশের একটি চরে ভিড়ান। এরপর দ্রুত লঞ্চটি আবার নদীর মাঝে নিয়ে যান।
আরেক যাত্রী আবদুল্লাহ জানান, আগুন লাগার পর জাহাজটি পাশের চরে ভিড়ানো হলেও নামার দরজা কোনোভাবে খোলা যাচ্ছিল না। এরপর আবার জাহাজটি নদীতে নেওয়া হয়। তখন বহু যাত্রীকে লাফিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিতে দেখা যায়।
আগুনে পোড়া লঞ্চটিকে ভেসে যেতে দেখেছেন লঞ্চ থেকে নামতে পারা অন্য যাত্রীরাও। আগুনে দগ্ধদের অধিকাংশকে বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহতদের বেশির ভাগই ঝালকাঠি হাসপাতাল থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শেবাচিমের চিকিৎসক মো. আনিসুজ্জামান। তিনি জানান, ভর্তি রোগীদের মধ্যে ৭ জন শিশু রয়েছে। তাদের মধ্যে ৩ শিশুকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।
নয়া শতাব্দী/এস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ