ঢাকা, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শূন্য হাতে অবসরে

প্রকাশনার সময়: ২৪ ডিসেম্বর ২০২১, ০৭:১৯

এক সময় অন্ধকার জীবন ছিল তাদের। চরমপন্থা-সন্ত্রাস-লুট-রাহাজানি-খুনে ঘেরা ছিল তাদের দৈনন্দিন জীবন। দিনে আত্মগোপন আর রাতে অস্ত্রবাজি-লুট করে কাটতো তাদের জীবন। কার্যত দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ছিল তাদের কব্জায়। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল জনজীবন। ‘সর্বহারা’ নামধারী এসব সন্ত্রাসবাদীদের কাছে সরকারি প্রশাসনও ছিল কার্যত অসহায়। এমন পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদে (১৯৯৬-২০০০) ১৯৯৯ সালে চরমপন্থিদের বিশেষ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। একইসঙ্গে আত্মসমর্পণকারী চরমপন্থিদের পুনর্বাসনের অংশ হিসেবে তাদের বিশেষ আনসারে চাকরি দেয়া হয়।

প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় পরে এসব আনসারকে ব্যাটালিয়ান আনসারের আত্তীকরণ করে নেয়া হবে। এরপর কেটে গেছে ২২ বছর। বিশেষ আনসার সদস্যদের আর আত্তীকরণ করা হয়নি ব্যাটালিয়ন আনসারে। এরই মধ্যে চাকরি জীবন শেষ হয়েছে ৩৯৬ জনের। শূন্য হাতেই ‘অবসরে’ গেছেন তারা। আনসার সদর দফতরের কেপিআই শাখা সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ২২ বছর বিশেষ আনসারে চাকরি করার পর ‘অবসরে’ যাওয়া সদস্যরা নিয়ে যেতে পেরেছেন শুধু শেষ মাসের বেতন! ফলে গত দেড় বছরে অবসরে যাওয়া বিশেষ আনসারদের ৩৯৬টি পরিবারের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

জানা যায়, ১৯৯৯ সালে সরকারের সাধারণ ক্ষমার সুযোগ নিয়ে আত্মসমর্পণ করে ২ হাজারের বেশি সর্বহারা সদস্য। এর মধ্যে থেকে ১৯৯৯-২০০২ সাল পর্যন্ত ৭৯৫ জন নাম লেখান আনসার বাহিনীতে। তাদের পুলিশের সঙ্গে সংযুক্ত করে দায়িত্ব পালনের ব্যবস্থা করা হয়। আর এসব আনসার সদস্যদের নাম দেয়া হয় ‘বিশেষ আনসার’। এরই মধ্যে ৩৯৬ জন বিশেষ আনসার সদস্যের চাকরির বয়স শেষ হয়ে যাওয়ায় বাহিনীতে বর্তমানে রয়েছে ৩৯৯ জন বিশেষ আনসার।

আনসার সদর দফতর সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৯ সালে সাধারণ ক্ষমা ও পুনর্বাসনের আশ্বাস দিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে চরমপন্থীদের আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়। তখন বিভিন্ন গ্রুপের দুই হাজার ১২৬ জন চরমপন্থী সদস্য অস্ত্র জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করে। যাচাই-বাছাই শেষে যাদের বিরুদ্ধে কোনো ফৌজধারি অভিযোগ কিংবা মামলা ছিল না— এমন ৪৬৫ জন আনসারে যোগদান করেন। তারা ১৯৯৯ সালের ২৫ জুলাই থেকে ২১ আগস্ট পর্যন্ত সময়ে বিশেষ আনসারে যোগদান করেন। একই বছরের ৩১ অক্টোবর থেকে ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত আনসারে নাম লেখান আরও ১৫৮ জন। এর পর বিভিন্ন সময়ে ২০০২ সাল পর্যন্ত আরো ১৭২ জন সহ মোট ৭৯৫ জন বিশেষ আনসার হিসেবে পুলিশ বাহিনীর সাথে কাজ শুরু করেন। আত্মসমর্পণকারী বাকি সদস্যদের কে কোথায় কিভাবে রয়েছে—তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান আনসার মহাপরিচালকের কার্যালয়ে নেই বলে জানা গেছে।

একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, সর্বহারা পার্টি থেকে আত্মসমর্পণ করে আনসারে যোগদানের পর পরই অনেকেই চাকরি ছেড়ে চলে যান। তাদের অনেকে কৃষিকাজ সহ বিভিন্ন পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। অভিযোগ রয়েছে—প্রাপ্তি আর প্রত্যাশার অমিল থাকায় অনেকেই ফিরে যান পুরনো ‘লুট-লুণ্ঠন’ পেশায়। তবে পুরনো পেশায় ফিরে যাওয়ারদের তথ্য সরকারের কাছে নেই। আনসার সদর দফতরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে বোঝা যায়, বাহিনী থেকে পালিয়ে যাওয়াদের নিয়ে বিশেষ কোনো মাথা ব্যথাও নেই সংশ্লিষ্টদের।

নামপ্রকাশ না করার শর্তে মহাব্যবস্থাপক কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা নয়া শতাব্দীকে বলেন, প্রায় ৮০০ সর্বহারা সদস্য আনসার বাহিনীতে যোগ দেয়। তবে এখন এ সংখ্যা চারশ’র কাছাকাছি। প্রথম ৪-৫ বছরের মধ্যেই ৪০-৫০ জন সদস্য বিভিন্ন কাজের কথা বলে বাহিনী ছেড়ে চলে যায়। পরে চলে যাওয়া আনসারদের আর কোনো ফলোআপ করা হয়নি। কে কোথায় কিভাবে আছে তার কোনো রেকর্ড আমাদের দফতরে নেই। বিশেষ আনসারদের জন্যে অঙ্গীভূতকরণ নামের একটি আলাদা শাখা রয়েছে। এ শাখায় একজন পরিচালক, একজন উপ-পরিচালক ও একজন সহকারী পরিচালকসহ অধীন ডজন খানেক স্টাফ থাকলেও এ বিষয়ে কিছুই জানে না তারাও।

অঙ্গীভূতকরণ শাখার সহকারী পরিচালক ফারজানা রহমান জানান, ঢাকা বিভাগে মোট ১৫৬ জন বিশেষ আনসার কর্মরত আছেন। তার মাঝে প্রশাসনিক জোনে ৬৬, নারায়ণগঞ্জে ১২, গাজীপুরে ৬৬, মানিকগঞ্জে ২, মুন্সীগঞ্জে ২, টাঙ্গাইলে ১ ও কিশোরগঞ্জে ১ জন। ময়মনসিংহ বিভাগে ৮ জন, ময়মনসিংহে ১, জামালপুরে ৩, শেরপুরে ২ ও নেত্রকোনায় ২ জন। চট্টগ্রামে মোট ৮৮ আনসার কর্মরত রয়েছেন। এর মধ্যে ৫৮ জন চট্টগ্রাম প্রশাসনিক জোনে ও ৩০ জন কক্সবাজারে কর্মরত রয়েছেন।

সিলেট বিভাগের সিলেটে ২ ও হবিগঞ্জে ১ জন মোট ৩ জন আছেন। কুমিল্লায় ২৭ ব্রাহ্মণবাড়িয়া ৮, নোয়াখালী ২৫ লক্ষ্মীপুর ৭, ফেনীতে ৬ জনসহ মোট ৭৩ জন কর্মরত রয়েছেন। রাজশাহী বিভাগের রাজশাহীতে ৩, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ৪, নাটোর ১৬, বগুড়া ৬, পাবনা ২, নওগাঁ ২, জয়পুরহাটে ৭ জনসহ ৩৮ জন রয়েছেন। রংপুর বিভাগের রংপুরে ৫, দিনাজপুর ৪, ঠাকুরগাঁও ৭, নীলফামারী ৭, গাইবান্ধা ১, কুড়িগ্রাম ৪, পঞ্চগড় ২ ও লালমনিরহাটে ৩ জনসহ মোট ৩৩ জন রয়েছেন। বরিশাল ও খুলনা বিভাগে কোনো বিশেষ আনসার নেই।

আনসার ভিডিপি মহাপরিচালকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালে বিভিন্ন জেলায় পুলিশের সাথে ৪৩৯ জন বিশেষ আনসার কর্মরত ছিল। এর মধ্যে মারা গেছেন ৯ জন আর ৩১ জনের ৫৯ বছর বয়স হয়ে যাওয়ার কারণে তাদের অবসরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।

জানা গেছে, অবসরে যাওয়া আনসারদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার কার্যত অন্ধকার। কেননা, ‘অবসরে’ গেলেও তাদের যেতে হয়েছে শূন্য হাতে। ব্যাটালিয়ন আনসারে আত্মীকরণ না হওয়াতে তাদের কেউই অবসরকালীন ভাতা বা অবসরে যাওয়ার সময় এককালীন বরাদ্দ পাওয়ার অধিকারী হননি।

জানতে চাইলে দুই আনসার সদস্য আলমগীর হোসেন ও মাহবুব হোসেন নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘আমরা যখন সারেন্ডার করি তখন বলা হয়েছিল আমাদের চাকরি স্থায়ী করে ব্যাটালিয়ন আনসারে আত্মীকরণ করা হবে; কিন্তু গত ২২ বছরেও আমাদের চাকরি স্থায়ী করা হয়নি। সরকার আমদের সাথে প্রতারণা করেছে ওয়াদা রাখেনি। অনেকেই অবসরে চলে গেছেন তারা খেয়ে না খেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। চাকরিটা স্থায়ী হবে সেই আশায় ২২ বছর কাটিয়ে দিয়েছি। এখন তো আর চাষাবাদও করতে পারবো না। সেজন্যই এ অপেক্ষা, মৃত্যুর আগে সেই অপেক্ষা শেষ হবে কিনা দেখতে চাই।’

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ