ঢাকা, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

দুই টেকনিশিয়ানে জিম্মি হৃদরোগের সিসিইউ

প্রকাশনার সময়: ২৪ ডিসেম্বর ২০২১, ০৬:১৮

নানা রকম দুর্নীতি, অনিয়ম, ঘুষ-বখশিশ বাণিজ্য আর সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এখন নিজেই ‘হৃদরোগে আক্রান্ত’— এমন মন্তব্য করছেন ভুক্তভোগী, রোগী ও তাদের স্বজন। এ হাসপাতালে গড়ে ওঠা দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা আর কর্মচারীদের সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটির স্বাস্থ্যসেবা।

ঘুষ-বকশিশ-বাণিজ্য এমন অবস্থায় পৌঁছে গেছে যে, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কোনো রোগীর মৃত্যু হলে তার ডেথ সার্টিফিকেটের জন্যও ঘুষ দিতে হয় ঘাটে ঘাটে। হৃদরোগের মতো ঝুঁকিপূর্ণ রোগের চিকিৎসায় হাসপাতাল কর্মচারীদের এমন নৈরাজ্যে অতিষ্ঠ ভুক্তভোগী রোগী ও তাদের স্বজন। একাধিক রোগীর স্বজন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, রোগী সুস্থ হয়ে রিলিজ নেয়ার সময়ও বখশিশ দিতে হয়। তা ছাড়া মেলে না রিলিজ পত্র। সরকারি হাসপাতাল হলেও অসৎ কর্মচারীদের দাপটে প্রতিনিয়ত এখানে ভোগান্তি আর হয়রানির শিকার হতে হয় চিকিৎসাসেবা প্রার্থীদের।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আদিল উদ্দিন তালুকদার (৮০) হৃদরোগে আক্রান্ত হন চলতি বছরের ২৬ এপ্রিল। মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে ভর্তি করা হয় জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালের সিসিইউর ২নং বেডে। স্বাভাবিক শ্বাসক্রিয়া ব্যাহত হওয়ায় ফুসফুস কৃত্রিমভাবে চালু রাখতে রোগীর শরীরে একটি ভেন্টিলেটর মেশিন সংযোজন করেন চিকিৎসক। এরপর ধারাবাহিকভাবে রোগীর অবস্থার উন্নতি হতে থাকে। ছয় দিন পর, ক্যাথল্যাব টেকনিশিয়ান তারিকুল ইসলাম লিটনের ইশারায় গভীর রাতে চিকিৎসকের বরাত দিয়ে রোগীর ভেন্টিলেটরটি খুলে নেন সেখানকার কর্তব্যরত ব্রাদার। মেশিনটি খুলে নেয়ার ৪ ঘণ্টা পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আদিল উদ্দিন তালুকদার।

মৃতের ছেলে জাহিদ হাসান সুজন অভিযোগ করে বলেন, ‘এ সময় ১ ও ২ নম্বর বেড ছাড়া আর কোথাও ভেন্টিলেটর ছিল না। পাশের বেডের আরেক মুমূর্ষু রোগীর প্রয়োজনে তার স্বজনদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা নেন লিটন। এরপর গভীর রাতে ভেন্টিলেটরটি খুলে নেয়া হয়। করোনাকালীন হওয়ায় পিপি এবং মাস্ক পরিহিত থাকায় ব্রাদারকে চিনতে পারেননি তারা।

একই রকম অভিযোগ করেন জুলফিকার আলী রবি। তিনি বলেন, ২০১৬ সালের ১১ জুন তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রহিম শিকদার (৭৫) হদরোগে আক্রান্ত হন। মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে ভর্তি করা হয় সিসিইউর ১নং বেডে। চিকিৎসকদের চেষ্টায় ধারাবাহিকভাবে তার শারীরিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছিল; কিন্তু ছয় দিন পর, গভীর রাতে ভেন্টিলেটর মেশিনটি খুলে নেন টেম্পোরারি পেসমেকার টেকনিশিয়ান গোলাম হোসেন। মেশিনটি খুলে নেয়ায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় সেদিন রাতেই মারা যান আবদুর রহিম শিকদার। মৃতের ছেলে অভিযোগ করে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে ডেথ সার্টিফিকেট দিতেও অস্বীকৃতি জানান কর্মচারীরা। ‘মৃত্যুর বিষয়ে কোনো অভিযোগ নেই’— লিখিতভাবে এমন মুচলেকা দেয়ার পরই মেলে আবদুর রহিম শিকদারের ডেথ সার্টিফিকেট।

উভয় ক্ষেত্রেই ঘটনাগুলো ঘটেছে বৃহস্পতিবার গভীর রাতে। সাধারণত শুক্রবার হাসপাতালের স্বাভাবিক কার্যক্রমে ছুটি থাকে। এ সময় সিনিয়র চিকিৎসকরা বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া হাসপাতালে আসেন না। এই সুযোগে সেখানকার দুর্নীতিবাজ ব্রাদার, টেকনিশিয়ান আর নার্সদের অবৈধ সিন্ডিকেট বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে মেতে ওঠেন। হাসপাতালের সিসিইউ এবং ক্যাথল্যাবের এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন টেম্পোরারি পেসমেকার রুমের টেকনিশিয়ান গোলাম হোসেন ও ক্যাথল্যাব ইনচার্জ টেকনিশিয়ান তারিকুল ইসলাম লিটন।

পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটর না থাকার অজুহাতে প্রতিনিয়ত তারা মুমূর্ষু রোগীদের পাঠিয়ে দেন আশপাশের প্রাইভেট হাসপাতালে। সেজন্য প্রতিটি রোগীর বিনিময়ে পান মোটা টাকা কমিশন।

জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে অনৈতিকভাবে উপার্জিত টাকা দিয়ে গোলাম হোসেন রাজধানীর বাবর রোডে কিনেছেন ফ্ল্যাট। তার অন্যতম প্রধান সহযোগী তারিকুল ইসলাম লিটন হাসপাতালে পরিচিতি পেয়েছেন ‘বড়লোক কর্মচারী’ হিসেবে।

জানা গেছে, জাতীয় হৃদরোগ হাসপাতালের সিসিইউ বিভাগটি দুটি ইউনিটে বিভক্ত। সিসিইউ-১ ও সিসিইউ-২ তে মোট বেডের সংখ্যা ৩৮টি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্দেশনা মতে প্রতিটি বেডে ভেন্টিলেটর থাকা বাধ্যতামূলক হলেও আছে ৫-৬টি। হৃদরোগে আক্রান্ত মুমূর্ষু রোগীদের কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস-প্রশ্বাস চালু রাখতে ভেন্টিলেটরের বিকল্প নেই। তবে দুর্নীতিবাজ কর্মচারীদের এই সিন্ডিকেট সিসিইউতে ভেন্টিলেটরের কৃত্রিম সংকট তৈরি করেন। যার জন্য এদের সব অনৈতিক নির্দেশ মেনে নিতে বাধ্য হন অসহায় রোগীর স্বজন। নিজেদের প্রিয়জনকে বাঁচাতে একটি ভেন্টিলেটরের জন্য মোটা টাকা ঘুষ দেন অবস্থাপন্ন রোগীর স্বজন।

গত ২৪ নভেম্বর রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত নোয়াখালীর হাজেরা খাতুনকে (৫৫) ভর্তি করা হয় সিসিইউ-১ এর ১নং বেডে। নিহতের ছেলে হাবিবুর রহমান বলেন, অনেক অনুরোধ করেও মায়ের জন্য ভেন্টিলেটর পাননি তিনি। এ সময় সিস্টারদের নির্দেশে ১২ ঘণ্টায় প্রায় ২০ হাজার টাকার ইঞ্জেকশন, এনজি টিউব, ফিডিং টিউব, আইভি ক্যানোলাসহ অন্যান্য সরঞ্জাম ক্রয় করেন তিনি। তাদের নির্দেশ মতো নিয়ে আসেন প্রতিটি আইটেমের ইনভয়েস। এসব ওষুধপত্র কিনে আনার ২০ মিনিট পরেই ২৫ নভেম্বর দুপুর ১২টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান হাজেরা খাতুন।

হাবিবুর রহমান অভিযোগ করেন, তার মায়ের মৃত্যুর পরে এসব ওষুধপত্র ফেরত পাননি তিনি। এমন অভিযোগ পাওয়ার পরে দেখা যায়, ওইদিন দুপুর দেড়টার সময় টেকনিশিয়ান তারিকুল ইসলাম লিটন আসেন টেম্পোরারি পেসমেকার কক্ষে। তার সাথে বহন করা ব্যাগটি বোঝাই করেন এসব মালামাল দিয়ে। তাকে অনুসরণ করলে দেখা যায়, হাসপাতালের বিপরীত পার্শ্বে কলেজগেটের ১/৭ মসজিদ গলির আয়ান মেডিসিন কর্নারে গিয়ে বিক্রি করে দেন সবকিছু। এসব মালামাল কোথা থেকে এনেছেন এমন প্রশ্নে চিৎকার দিয়ে লোক জড়ো করলে দৌঁড়ে চলতি একটি বাসে উঠে পড়ে পালিয়ে যান লিটন। ওই ফার্মেসির কর্তব্যরত বিক্রয়কর্মীকে অবৈধভাবে কেনা এসব সামগ্রীর ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে দোকান মালিকের সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন।

অভিযুক্ত তারিকুল ইসলাম লিটনকে ফোন করা হলে প্রথমে অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি। বাইরের ফার্মেসিতে ওষুধ বিক্রির ভিডিও আছে জানালে বলেন, ‘ভিডিও পাঠালে দেখতে পারবো না। আমি গরিব মানুষ, তাই ফিচার ফোন ব্যবহার করি। সরাসরি হাসপাতালে আসেন, একটা ব্যবস্থা হবে।’ একই বিষয়ে টেম্পোরারি পেসমেকার টেকনিশিয়ান গোলাম হোসেনকে ফোন করলে অপারেশন থিয়েটারে আছেন জানিয়ে ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিনের ফোনে একাধিক বার কল করে ও এসএমএস পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।

নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জর্জরিত জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে গত বছরের শেষের দিকে গত ২০ অক্টোবর অভিযানও চালায় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযানে সব অনিয়ম-দুর্নীতি ও ঘুষ বাণিজ্যের প্রমাণও পায় দুদক কর্মকর্তারা। দুদকের সহকারী পরিচালক ফারজানা ইয়াসমিনের নেতৃত্বে ৪ ঘণ্টাব্যাপী ওই অভিযান পরিচালিত হয়। ওইসময় কারিগরি ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি ও অবহেলার কারণে রোগীদের মৃত্যু এবং সার্বিক অব্যবস্থাপনার বিষয়ে হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. এম আর সিজারকে জিজ্ঞাসাবাদও করেন দুদক কর্মকর্তারা।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ