ঢাকা, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

‘বই উৎসব’ না হওয়ার নেপথ্য

প্রকাশনার সময়: ২৪ ডিসেম্বর ২০২১, ০৫:৫০
সংগৃহীত ছবি

সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ার পর ২০১০ সালে থেকেই নতুন এক বিপ্লবের সূচনা করে আওয়ামী লীগ। বছরে প্রথম দিনেই এক সঙ্গে ৪ কোটিরও বেশি শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দেয়া শুরু হয় পাঠ্যবই। বিনামূল্যে এত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর হাতে বই তুলে দিয়ে বহির্বিশ্বে এক অনন্য নজির স্থাপন করে বাংলাদেশ। সেই থেকে ১ জানুয়ারি সারাদেশের শিক্ষার্থীর হাতে বই তুলে দিয়ে পালিত হয়ে আসছে ‘বই উৎসব’।

করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারির মধ্যে চলতি বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পরও নির্ধারিত দিনেই বই পেয়েছিল শিক্ষার্থীরা। বই উৎসব উদ্যাপনে দিনক্ষণ আসতে বাকি আর মাত্র ৭ দিন। এবার ‘করোনাভাইরাসের অজুহাতে ১ জানুয়ারি বই উৎসব হবে না বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি’।

তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছরের নভেম্বর মাসের শুরুতেও মাধ্যমিক স্তরের ৪৮ শতাংশ বই ছাপানোর চুক্তি করতে ব্যর্থ হয় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এরপর গত ৯ নভেম্বর এনসিটিবি ও মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চুক্তি হয়। নিয়মানুযায়ী—অষ্টম ও নবম শ্রেণির বইয়ের জন্য ৮৪ দিন সময় ধরে ৩১ জানুয়ারি এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বইয়ের জন্য ৭০ দিন ধরে ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত বই দেয়ার সময় আছে। মূলত এই জটিলতার কারণে বছরের প্রথম দিনই শিক্ষার্থীরা সব বই পাচ্ছে না। এনসিটিবি অবহেলা ও পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে গিয়েই উৎসবকে অনিশ্চয়তায় ফেলে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, তারা তাদের সর্বোচ্চ গতিতেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তবে পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে গিয়ে বই উৎসবকে হুমকির মুখে ফেলেছে এনসিটিবি। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় বিলম্বের কারণেই আজ এই অবস্থা। যে সময় কাজ দেয়া হয়েছে তাতে নির্ধারিত সময়ে বই পৌঁছানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। আর নিজেদের ভুলের কারণে এনসিটিবিও আমাদের কিছু বলতে পারবে না। তবে এনসিটিবি এখনো আশা প্রকাশ করছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে যাবে পাঠ্যপুস্তক।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সারাদেশে ১ জানুয়ারি বই উৎসব করতে হলে ২৫ ডিসেম্বরের মধ্যে তা উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছাতে হবে। সেখান থেকে বিদ্যালয়ে বিদ্যালয়ে পৌঁছাতেও সময় লাগবে। এখন বই ছাপার কাজ যে পর্যায়ে আছে, সে হিসেবে ১ জানুয়ারি বই উৎসবের দিনে সব শিক্ষার্থী যে উৎসবে শামিল হতে পারবে তা অনেকটাই অনিশ্চিত। বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীই বছরের প্রথম দিনের উৎসব থেকে বঞ্চিত হবে। অনেকের হাতেই বই তুলে দিতে পারবে না সরকার। প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা নির্ধারিত দিনে বই হাতে পেলেও মাধ্যমিকের কোটি শিক্ষার্থী এবার বই পাবে না বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন তারা।

এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘এ বছরও করোনা পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে বই উৎসব করা হবে না। এ বছরও বই উৎসব করার মতো পরিস্থিতি আমাদের নেই। সব স্কুলেই ক্লাস ধরে ধরে বই বিতরণ করা হবে। এতে কোনো সমস্যা হবে না। ১৭ কোটির বেশি বই বাঁধাই হয়ে গেছে। আগামী তিন-চার দিনের মধ্যে সবটাই হয়ে যাবে। তারপরও স্বল্পসংখ্যক বাদ থাকতে পারে। সেটাও আমরা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে শিশুদের হাতে দিতে পারব।

তিনি বলেন, বাকি বই ৭ জানুয়ারির মধ্যে পৌঁছে যাবে। শিক্ষার্থীরা সময়মতো বই হাতে পেয়ে যাবে। আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৯৫ শতাংশের বেশি বই পৌঁছে যাবে। ২০০টি প্রেসে কাজ চলছে ১৫৮টি মাধ্যমিকে আর ৪২টি প্রাথমিকে। যে কোম্পানিকে দায়িত্ব দেয়া আছে, তারা নিয়মিত পরিদর্শনে আসে। প্রাক-প্রাথমিক নিয়ে সমস্যা হয়েছিল। সেটা সমাধান হয়ে গেছে।

জানা যায়, ২০২২ সালের ৪ কোটি শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাথমিক পর্যায়ের ১০ কোটি বই এবং মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের জন্য ২৫ কোটি বই ছাপাতে হবে। এর মধ্যে গতকাল পর্যন্ত প্রাথমিকের ৯ কোটি ৫৪ হাজার বই ছাপানো হয়েছে। ৮ কোটি ৩৮ লাখ বই মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান থেকে ডেলিভারি দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে মাধ্যমিকের ৫ কোটি ৭২ লাখ বই এখনো ছাপানোই হয়নি।

যদিও মুদ্রণ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বই ছাপানো হয়নি যে সংখ্যা বলা হচ্ছে বাস্তবে তার সংখ্যা আরো বেশি। এনসিটিবি হিসাব অনুযায়ী, প্রাথমিকে ৮ কোটি ৩৮ লাখ ৫৪ হাজার আর মাধ্যমিকে প্রায় ১৯ কোটি ছাপা হলেও তা সরবরাহে আরো কয়েকদিন লেগে যেতে পারে। কেননা বই মুদ্রণের পর তা বাঁধাই, কাটিংসহ আরো কিছু কাজ বাকি থাকে। এরপর তা বিভিন্ন উপজেলায় পাঠানো হয়।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, প্রাথমিকের ১ম, ২য়, ৩য়, ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণির ৯ কোটি ৩০ লাখ ৩৪ হাজার ৩০টি বইয়ের মধ্যে ছাড়পত্র পেয়েছে ৮ কোটি ৩ লাখ ৩২ হাজার ৫৪০টি (৮৬ শতাংশ)। প্রাক-প্রাথমিকের ৬৬ লাখ ৫ হাজার ৪৮০টির মধ্যে ছাড় পেয়েছে ৩৩ লাখ ২ হাজার ৭৪০টি (৫০ শতাংশ)। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ২ লাখ ১৯ হাজার ৩৬৪টি বইয়ের মধ্যে শতভাগ ছাড় পেয়েছে।

অভিযোগ রয়েছে, অনৈতিক সুবিধা নিয়ে পছন্দের ঠিকাদারদের কাজ দিতে পুনঃদরপত্র আহ্বান করায় মাধ্যমিক স্তরের বই ছাপার কাজ দেরি হয়েছে। এজন্য ১ জানুয়ারি বই উৎসব হলেও অষ্টম ও নবম শ্রেণির বই দেয়ার ক্ষেত্রে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সর্বশেষ সময় ৩১ জানুয়ারি, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির জন্য ২২ জানুয়ারি। প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা নির্ধারিত দিনে বই হাতে পেলেও তাই মাধ্যমিকের কোটি শিক্ষার্থী এবার বই পাবে না বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রিন্টিং ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি শহিদ সেরনিয়াবাত বলেন, সরকারকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য টেন্ডারের শর্ত পরিবর্তন করে লাখ লাখ কোমলমতি শিক্ষার্থীকে জিম্মি করে একটি মাত্র প্রতিষ্ঠানকে লাভবান করার জন্য এ দেরিটা হলো। বর্তমান সরকারের সবচেয়ে সফল কর্মসূচিটিকে এখন ঝুঁকির মুখে ফেলা হলো।

সম্প্রতি কয়েক কর্মকর্তা এখান থেকে ট্রান্সফার হয়ে গেছে, এই কর্মকর্তাদের অতি উৎসাহ, লোভ এবং তারা লাভবান হওয়ার জন্য এ কাজটি করা হয়েছে। এদের বিরুদ্ধে তদন্ত হওয়া উচিত।

এনসিটিবি সূত্রমতে, ২০২২ শিক্ষাবর্ষে মাধ্যমিক স্তরের বই ছাপানোর জন্য পাঁচ ভাগে দরপত্র আহ্বান করা হয়। এর মধ্যে মাধ্যমিক স্তরের (বাংলা ও ইংরেজি ভার্সন) অষ্টম ও নবম শ্রেণি, ইবতেদায়ি স্তরের (তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি), দাখিল স্তরের অষ্টম ও নবম শ্রেণির এবং এসএসসি ও দাখিল ভোকেশনালের ২৮০ লটের মধ্যে ৩২টি লটের বই ছাপার জন্য গত ১৪ সেপ্টেম্বর নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড (নোয়া) দেয়া হয়েছে।

চুক্তির শর্তানুযায়ী ৯৮ দিনের মধ্যে বই ছাপিয়ে মাঠ পর্যায়ে সরবরাহ করতে হবে। ৩২ লটে মাত্র এক কোটি ৬৮ লাখ ৩০ হাজার ৯৭১টি বই রয়েছে। ২০৮ লটে মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম, ইবতেদায়ি স্তরের প্রথম ও দ্বিতীয়, দাখিল স্তরের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বই ছাপার টেন্ডার আহ্বান করা হয়। এর মধ্যে ২০টি লটে এক কোটি সাত লাখ ৫২ হাজার ৮৪০টি বই আগামী ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে বই সরবরাহের চুক্তি করা হয়েছে।

এনসিটিবি সূত্রে আরো জানা যায়, মাধ্যমিক স্তরের (বাংলা ও ইংরেজি ভার্সন) অষ্টম ও নবম শ্রেণি, ইবতেদায়ি স্তরের তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণি, দাখিল স্তরের অষ্টম ও নবম শ্রেণির এবং এসএসসি ও দাখিল ভোকেশনালের ২৪৮ লটের বই ছাপার জন্য পুনঃদরপত্র আহ্বান করা হয়। ২৪৮ লটে ১০ কোটি সাত লাখ ৫২ হাজার ৮৪০টি ছাপানো হবে। একই স্তরের ১০ লাখ ৮৬ হাজার ২৪৮টি বই ছাপানোর জন্য পুনঃদরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। ১৮৮টি লটের মাধ্যমে মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম, ইবতেদায়ি স্তরের প্রথম ও দ্বিতীয়, দাখিল স্তরের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ১১ কোটি ১২ লাখ ৪৪ হাজার ৮৯৫টি বই ছাপার জন্য পুনঃদরপত্র দেয়া হয় ১৯ জুলাই।

অভিযোগ উঠেছে, প্রাথমিক স্তরের ১০ কোটি বইয়ের মধ্যে একটি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকেই ৩ কোটি বইয়ের ছাপার কাজ দিতে গিয়ে যত বিপত্তি। দরপত্রের মাঝখানে হঠাৎ সংশোধনী আনে এনসিটিবি। আর এতেই বিগত ১১ বছরের নতুন বই পৌঁছে দেয়ার সফলতা ভেস্তে যাওয়ার পথে।

জানা যায়, দেরিতে দরপত্রের কাজ করায় এনসিটিবি বই সরবরাহের ক্ষেত্রেও এবার ‘আংশিক’ নীতি গ্রহণ করে। অর্থাৎ ৩০ ডিসেম্বরে সব বই গ্রহণের পরিবর্তে আংশিক বই পাওয়ার ব্যাপারে চুক্তি করেছে। এবার যে ৩৫ কোটি বই ছাপানো হচ্ছে, এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরে আছে ৯ কোটি ৯৮ লাখ। আর মাদরাসার দাখিল, ইবতেদায়ি, ভোকেশনাল ও সাধারণ শিক্ষার মাধ্যমিক স্তর মিলিয়ে ছাপানো হচ্ছে ২৪ কোটি ৫১ লাখ ৫৬ হাজার। মাধ্যমিক স্তরের বই দুই ভাগে দরপত্র দেয়া হয়। প্রথম ভাগে অষ্টম-নবম আর ইবতেদায়ির তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির বই ছাপানোর চুক্তি হয় ৮ নভেম্বর। এই দরপত্রে মুদ্রাকরদের ৮৪ দিন সময় দেয়া হয়েছে। সেই হিসাবে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত তাদের সময় দেয়া হয়েছে।

পাশাপাশি এতে ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে ৫০ শতাংশ বই সরবরাহের শর্ত দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে চুক্তি অনুযায়ী, মাধ্যমিকের ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণি এবং ইবতেদায়ির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির বই সরবরাহে ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় পাচ্ছেন মুদ্রাকররা।

এই দরপত্রে বই সরবরাহে সময় দেয়া হয় ৭০ দিন। সেই হিসাবে ১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে অর্ধেক বই সরবরাহের শর্ত দেয়া হয়। মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, প্রাথমিক স্তর নিয়ে হয়তো সমস্যা হবে না। এর মধ্যে অবশিষ্ট বই চলে যাবে। তবে এখন পর্যন্ত মাধ্যমিকের ছাপাই হয়নি ৭ কোটি বই। আবার ছাপা হয়েছে কিন্তু বাঁধাই-কাটিং হয়নি-বিভিন্ন প্রেসে এমন বই আছে কয়েক কোটি। এসব দৃষ্টিকোণ পর্যালোচনায় বলা যায়, ডিসেম্বরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ বই যাবে। বাকি বই সরবরাহে মধ্য জানুয়ারি লেগে যেতে পারে। আর এমনটি হলে আইনগতভাবে এনসিটিবি মুদ্রাকরদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থায় যেতে পারবে না।

তিনি বলেন, চুক্তি অনুযায়ী, ৯ নভেম্বর থেকে অষ্টম ও নবম শ্রেণির বইয়ের জন্য ৮৪ দিন সময় ধরে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বই দেয়ার সময় আছে। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বইয়ের জন্য ৭০ দিন ধরে ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত। ফলে এনসিটিবি কোনো অবস্থাতেই আমাদের বলতে পারে না যে ৩১ ডিসেম্বরের আগে বই দিতে হবে।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ