বুড়িগোয়ালিনি ইউনিয়নের জেলেপাড়ার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম। ৫ বছর ধরে সুন্দরবনে কাঁকড়া ধরে তার ৬ জনের সংসার চলে। সরকারের রাজস্ব কি— তা জানেন না তিনি। এমনকি কখনো তিনি তা নিজ হাতে পরিশোধও করেননি। মাছ ধরে ফেরার পর স্থানীয় দালালদের হাতে গুঁজে দেন ৩৫০ টাকা। এরপর কোনো রকম ঝামেলা ছাড়াই বিক্রি করে দেন মাছ। এভাবেই যুগের পর যুগ ধরে ‘সরকারি রাজস্ব’ দিচ্ছেন তিনি। একই কথা জানালেন জেলে পাড়ার অন্তত অর্ধশত বাসিন্দা। দালালদের হাতে ‘রাজস্ব’ চলে যাওয়ায় প্রতি মৌসুমে মোটা অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। বিপরীত দিকে পকেট ভারী হচ্ছে স্থানীয় দালালদের পাশাপাশি ফরেস্টের কিছু অসাধু কর্মকর্তার।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘এটা তো চরম দুর্নীতি। এই চক্রের সবাইকে আইনের আওতায় আনা উচিত। দিনের পর দিন এভাবে একটি সেক্টর চলতে পারে না। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সুন্দরবনে মাছ ধরার পর জেলেরা মাছ ও নৌকা নিয়ে সরাসরি পাস নেয়া স্টেশনে হাজির হন। সেখানে ফরেস্ট কর্মকর্তারা প্রতিটি পাসের বিপরীতে প্রতিকেজি কাঁকড়ার জন্য ৩ টাকা ৭৫ পয়সা, সাদা মাছের ক্ষেত্রে ৩ টাকা ৭০ পয়সা, ভেটকি মাছের জন্য ১২ টাকা ও চিংড়ি ২ টাকা ৭৫ পয়সা করে রাজস্ব আদায় করে। স্থানীয়রা ওই পাসটিকে বলেন ‘সিটি পাস’। যে পাস নিয়ে জেলেদের বাজারে মাছ ও কাঁকড়া বিক্রি করার কথা। তবে নয়া শতাব্দীর অনুসন্ধানে এ ধরনের কোনো চিত্র চোখে পড়েনি। কাগজ-কলমে সব জেলের নামেই গড়ে ৩৫০ টাকা রাজস্ব পরিশোধের চিত্র দেখা গেছে। তবে এ সংখ্যাও খুবই কম।
জানতে চাইলে বুড়িগোয়ালিনি স্টেশন কর্মকর্তা সুলতান আহমেদ বলেন, ‘জেলেরা বেশিরভাগ সময় রাতে ফেরেন। এ সময় ফরেস্টের কোনো লোক স্টেশনে থাকে না। এ কারণে পরের দিন তাদের কাছ থেকে সর্বনিম্ন হিসাবে ৩৫০ টাকা আদায় করা হয়। তবে জেলেরা ইচ্ছা করে রিসিট সংগ্রহ করে না। তারা স্থানীয় কারোর কাছে মাছ ধরার পাস ও টাকা রেখে চলে যান। পরে ওই পাস সারেন্ডার করে তাকে আবার নতুন পাস দেয়া হয়। একটি পাসের বিপরীতে জেলেরা ৭ দিন মাছ ধরার অনুমতি পান। তবে কারোর কাছ থেকে বাড়তি টাকা নেয়া হয় না।
জানা গেছে, প্রতি গোনে (সরকার নির্ধারিত সময়) অন্তত কয়েক হাজার জেলে সুন্দরবনে মাছ ও কাঁকড়া শিকার করতে যান। একটি নৌকায় ২ থেকে ৩ জন অবস্থান করেন। যাওয়ার সময় তারা বাজার থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার করে নিয়ে যান। সেখানে অবস্থানের সময় তারা নদীর মাছই বেশি খান।
স্থানীয় জেলে শহিদুল ইসলাম বলেন, এখানে সব কিছুই চুক্তিতে চলে। সরকারের সর্বনিম্ন রেট ৩৫০ টাকা নেয়া হলেও এর বাইরে নেয়া হয় নৌকাপ্রতি অন্তত হাজার টাকা। টাকাগুলো স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়। মাছের পরিমাণ যাই হোক চুক্তির টাকা হাতে পেলেই সাতখুন মাফ হয়ে যায়। কোনো কারণে চুক্তির টাকা দিতে অক্ষম হলেও তার ওপর নির্যাতন নেমে আসে।
তিনি বলেন, ‘ফরেস্টের দালালদের সাথে আমার প্রতি গোনে মাছ ধরে ফেরার পর ৫ হাজার টাকা দেয়ার চুক্তি হয়েছিল; কিন্তু আমি চুক্তির টাকা দিতে না পারায় আমার নৌকায় একটি খেপলা জাল পাওয়ার অজুহাতে সিআর বাবদ ৪৫ হাজার আদায় করে। শুধু জরিমানা করেই ক্ষ্যান্ত হননি স্টেশন কর্মকর্তা সুলতান আহমেদ ও সহকারী বন সংরক্ষক এম এ হাসান। বিষয়টি গণমাধ্যম কর্মীদের জানানোর অপরাধে সুন্দরবনে প্রবেশের বৈধ পারমিশন থাকার সত্ত্বেও তার বিএলসিকৃত নৌকাটি জোর করে আটক করে। পরে এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি।
তিনি বলেন, প্রতিদিনই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। যাদের টাকা আছে তারা নৌকা ছাড়াতে পারেন। আর যার টাকা নেই তিনি রাস্তায় রাস্তায় ঘোরেন। নতুন মাছ ও কাঁকড়া ধরার বিএলসির জন্য সরকারি রেট ২০ টাকা থাকলেও প্রতি স্টেশনে একটা বিএলসির বিপরীতে দালালদের মাধ্যমে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা আদায় করে হাতিয়ে নেয়া হয়। প্রমোদ ভ্রমণের নৌকার বিএলসির জন্য ২৭০০ টাকার সরকারি হিসাব থাকলেও একই কায়দায় ১২-১৫ হাজার টাকা আদায় করা হয়। সব ধরনের বিএলসি নবায়নে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করেন বনবিভাগের অসাধু কর্মকর্তারা।
স্থানীয় জেলেরা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, রাতে বিশ্রামে যাওয়ার পর ফরেস্টের অফিসের আশপাশেই তাদের নির্ধারিত দালালরা অবস্থান করে। এরপর রাতে কোনো নৌকা এলেই চুক্তি অনুযায়ী টাকা ও মাছ ধরার পাস দালালদের কাছে জমা দিয়ে চলে যায়। এরপর ওই টাকা থেকে ৩৫০ টাকা সরকারি খাতে জমা দিয়ে বাকিটা পকেটে চলে যায়। এক্ষেত্রে জেলেদের কোনো ধরনের রিসিট দেয়া হয় না। স্থানীয় জেলেদের সাথে কথা বলেও বিষয়গুলোর সত্যতা মিলেছে।
স্থানীয় জেলে রেজাউল জানান, খোদ রেঞ্জ অফিসের নিয়ন্ত্রণে চলে টহল ফাঁড়িগুলো। খুলনা কয়রার কিছু বড় জেলে মহাজনের সঙ্গে চুক্তি করে এলাকায় মাছ ধরান এসিএফএমএ হাসান। অন্য মহাজনরা হচ্ছে কয়রা উপজেলার আমিরুল, রজব, জামাল মোড়ল ও দবির। এসব মহাজনদের নৌকায় কখন তল্লাশিও হয় না। কারণ তারা বড় মাপের ব্যবসায়ী। মোটা অঙ্কের টাকা দেন। আবার মাছও ধরেন বেশি।
জানতে চাইলে পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জ কর্মকর্তা এম এ হাসান বলেন, ‘আমি দায়িত্ব আসার পর সব স্টেশনে দালাল ঢুকতে নিষেধ করে দিয়েছি। যদি কেউ বনবিভাগের নাম ভাঙিয়ে জেলেদের কাছ থেকে টাকা নেয় প্রমাণ দিলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। জেলেরা সরাসরি স্টেশনে এসে প্রয়োজনীয় সব কাজ করে যাবে।’ ১৮৬৫ সালের বন আইনের ২ নং ধারা অনুযায়ী ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৮৭৫ তারিখে খুলনা এবং বাগেরহাট জেলার সুন্দরবনের বনাঞ্চলকে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়। ১ আগস্ট ১৮৭৬ তারিখে বর্তমান সাতক্ষীরা জেলাধীন সুন্দরবনের বনাঞ্চলকে সংরক্ষিত ঘোষণা করা হয়। এরপর ১৮৭৮ সালের বন আইনের ৩৪ নং ধারা মোতাবেক আগে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষিত খুলনা, বাগেরহাট এবং সাতক্ষীরা জেলাধীন সুন্দরবনের বনাঞ্চলের সীমানা ২৩ জানুয়ারি ১৮৭৯ তারিখে পুনর্নির্ধারণপূর্বক গেজেট প্রকাশিত হয়। এ এলাকায় সাধারণ মানুষের প্রধান পেশা হচ্ছে মাছ ও কাঁকড়া ধরা এবং মধু আহরণ।
নয়া শতাব্দী/এমআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ