ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

৬ হাত ঘুরে নাগালের বাইরে সবজি

প্রকাশনার সময়: ২২ ডিসেম্বর ২০২১, ০৪:৩০
সংগৃহীত ছবি

সবজির মতো পচনশীল কাঁচাপণ্যের দাম কীভাবে আকাশছোঁয়া হয়ে যায় তার নেপথ্য কাহিনি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরা হয়েছে এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে। গত ১৬ নভেম্বর বাজার মনিটর করে তৈরি করা প্রতিবেদনে সবজি পণ্যের বিতরণ ব্যবস্থা, হাতবদল, যান ব্যবহার ছাড়াও অসাধু ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফালোভী মনোভাব, যানজটসহ নানাবিধ কারণ তুলে ধরে কীভাবে ক্রেতাদের পকেট কাটা হচ্ছে তা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রত্যন্ত এলাকা থেকে রাজধানী ঢাকা পর্যন্ত সবজি পরিবহনে ঘাটে ঘাটে চলছে চাঁদাবাজি। এতে পণ্যের দাম দুই থেকে তিনগুণ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারও বেশি বেড়েছে। এর ওপর ডিজেলের দাম বাড়ার দোহাই দিয়ে পরিবহন ব্যবসায়ীরা বাড়তি খরচের চেয়ে আরো অনেক বেশি ট্রাক ভাড়া আদায় করছেন। সবমিলিয়ে সবজিসহ সব ধরনের কাঁচামালের বাজার অস্থির হয়ে উঠেছে।

গোয়েন্দা অনুসন্ধানের ‘পিক পয়েন্টে’ বলা হয়, ডিজেলের দাম বাড়ার আগের ও পরের মূল্য পর্যালোচনায় দেখে গেছে মাঠপর্যায়ে কাঁচামালের দাম স্থিতিশীল রয়েছে। শীতকালীন সবজির উৎপাদন বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে বাজারে সবজির দাম তুলনামূলক কম হওয়ার কথা। অথচ সবজির দাম না কমে দেড় থেকে দু’গুণ বেড়েছে। কোনো কোনো পণ্যের ক্ষেত্রে মূল্যবৃদ্ধির হার আরো বেশি।

গোয়েন্দা সংস্থার দেয়া পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে যে কোনো সবজি শহরকেন্দ্রিক ভোক্তার কাছে পৌঁছানোর আগে বেশ কয়েকবার হাতবদল হয়। হাতবদল, যান ব্যবহার ছাড়াও অসাধু ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফালোভী মনোভাব, বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যানজটসহ নানাবিধ কারণে বাজারে সবজির দাম বৃদ্ধি পায়। পাইকারি ক্রয়মূল্যের শতকরা ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারও বেশি লাভ করার প্রবণতা খুচরা ব্যবসায়ীদের মধ্যে লক্ষ্য করা গেছে। উত্তরবঙ্গ থেকে দেশের সবজির চাহিদার বড় অংশ পূরণ করা হলেও সেখানে তেমন বড় কোনো পাইকারি বাজার নেই। যার কারণে রংপুর, নাটোর, বগুড়া ইত্যাদি জেলা থেকে সবজি গাড়িতে করে বড় পাইকারি বাজার কুমিল্লার নিমসার আড়তে আসে। এখান থেকে আবার হাতবদল হয়ে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ অন্যান্য জেলা শহরে এসব সবজি নিয়ে যাওয়ার জন্য এখানে আরেক দফা অতিরিক্ত পরিবহন ব্যয় ও হাতবদলের কারণে খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

যারা কারওয়ান বাজার থেকে পুনরায় পণ্য পাইকারি বাজারে বিক্রির উদ্দেশে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় নেন, তাদের পণ্যবাহী বাহনেও বিভিন্ন রকমের খরচ করতে হয়। প্রথমেই তাদের পিকআপকে ২/৩ হাজার টাকার বিনিময়ে কারওয়ান বাজার স্ট্যান্ডে বাৎসরিক ভিত্তিতে তালিকাভুক্ত হতে হয়। প্রতি ট্রিপে শতকরা ১০ টাকা হারে স্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রণকারীদের দিতে হচ্ছে। কারওয়ান বাজারে চারশ’ বর্গফুট জায়গা প্রতিরাতের জন্য ভাড়া ২ হাজার ১০০ টাকা এবং একই জায়গায় প্রতিদিনের জন্য সাড়ে তিন হাজার টাকা দিতে হয়। যা পণ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলে।

বগুড়ার মহাস্থানহাট থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত প্রতিটি পণ্যবাহী ট্রাককে যেসব ঘাটে চাঁদা দিতে হয় তার তালিকাও গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বগুড়া পৌরসভার ৫০ টাকা টোল দিয়ে যাত্রা শুরু করতে হয়। এরপর শেরপুর ৫০ টাকা, সিরাজগঞ্জ ট্রাক মালিক-শ্রমিক সমিতিতে ৫০ টাকা, সিরাজগঞ্জ শহরে গাড়ি ঢুকলে ৫০ টাকা, সিরাজগঞ্জ মোড় হাইওয়ে পুলিশ খরচ (মাসিক) ৫শ’ টাকা, যমুনা সেতু গোল চত্বর হাইওয়ে পুলিশ খরচ (মাসিক) ৫শ’ টাকা, টাঙ্গাইল মোড় হাইওয়ে পুলিশ খরচ (মাসিক) ৫শ’ টাকা, আমিনবাজার, সাভার (লাঠিয়াল বাহিনী) প্রতি ট্রিপ এক থেকে ২শ’ টাকা, কারওয়ান বাজার পার্কিংয়ে ৫শ’ টাকা চাঁদা দিতে হয়। প্রতি ট্রিপে যুমনা সেতুর টোল ১ হাজার ৪শ’ টাকা রয়েছে।

এর বাইরে বগুড়ার মহাস্থানহাট থেকে ঢাকায় আসায় প্রতিটি ৫ টনের ট্রাকের প্রতি ট্রিপে ডিজেলে সাড়ে ছয় হাজার টাকা, চালক-হেলপারের বেতন দুই হাজার টাকা এবং রোড খরচ দুই হাজার টাকা খরচ হয়। যদিও ৫ টনের ট্রাকে সাধারণত ১২ থেকে ১৩ টন সবজি পরিবহন করা হচ্ছে।

ডিজেলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় খরচ কতটা বেড়েছে তা-ও গোয়েন্দা প্রতিবেদনে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, একটি ৫ টন ট্রাক এক লিটার ডিজেলে আড়াই থেকে তিন কিলোমিটার যায়। ৩ টন মিনি ট্রাক এক লিটারে যায় ৫ থেকে ৬ কিলোমিটার। এক থেকে দুই টন পিকআপ এক লিটারে যায় ৭ থেকে সাড়ে ৭ কিলোমিটার। এ হিসেবে মহাস্থানহাট থেকে ২০২ কিলোমিটার দূরত্বে ঢাকা যেতে গড়ে ডিজেল লাগে ৫ টন ট্রাকের ৮০ থেকে ৮১ লিটার। সম্প্রতি ডিজেলের দাম লিটার প্রতি ৬৫ টাকা থেকে ৮০ টাকায় সমন্বয় করায় বর্তমানে ডিজেল বাবদ খরচ হয় ৬ হাজার ৪৬৪ টাকা। ডিজেলের দাম বৃদ্ধির আগে খরচ হতো ৫ হাজার ২৫২ টাকা। এ হিসেবে বর্তমানে ডিজেল বাবদ অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে ১ হাজার ২১২ টাকা।

যেহেতু অন্যান্য খরচ আগের মতই রয়েছে, সেহেতু ডিজেলের দাম বৃদ্ধির কারণে ৫ টনের একটি ট্রাকের ভাড়া সর্বোচ্চ দেড় হাজার টাকা বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। অথচ ট্রিপপ্রতি ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা বেশি ভাড়া নেয়া হচ্ছে। যার কারণে কাঁচামালের বাজার বেসামাল হয়ে উঠেছে।

বগুড়ার স্থানীয় কৃষক, মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ী, আড়তদার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেও গোয়েন্দা প্রতিবেদনের সত্যতা পাওয়া গেছে।

বগুড়া থেকে কাঁচামরিচ কিনে কারওয়ান বাজারে বিক্রি করা একজন বেপারী জানান, তিনি ৫ টনের একটি ট্রাকে ২০২ বস্তা কাঁচামরিচ নিয়ে আসেন। প্রতি বস্তায় ৬৫ কেজি করে মোট ১৩ হাজার কেজি কাঁচামরিচ ছিল। ক্রয়কৃত কাঁচামরিচ ঢাকায় পাঠানোর ট্রাকে পৌঁছাতে প্রতিমণে লেবার খরচ, ভ্যান ভাড়া ও স্থানীয় খাজনায় মোট ২০ টাকা খরচ হয়। প্রতিটি বস্তা কিনতে ১৮ টাকা দিতে হয়েছে। কারওয়ান বাজারে পৌঁছানোর পর বস্তাপ্রতি লেবার খরচ ২০ টাকা এবং ভ্যান ভাড়া ৩০ টাকা। আড়তের খাজনা এক টাকা। অর্থাৎ প্রতিকেজি কাঁচামরিচে ওই বেপারীর মোট খরচ ৪৫ টাকা। যা আড়ত থেকে পাইকারদের কাছে বিক্রি করা হয় ৫৫ টাকা দরে। পাইকারের কাছ থেকে কেনার পর ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে খুচরা বিক্রেতারা তা একশ’ টাকা থেকে একশ’ দশ টাকা দরে বিক্রি করে।

একইভাবে নাটোরের হবিতপুর থেকে আসা একজন বেপারীর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, কৃষকের কাছ থেকে শিম কিনে ঢাকায় আনতে প্রতিকেজিতে ১২ টাকা খরচ হয়। এর সঙ্গে আরও ৩ টাকা যোগ করে তারা আড়তে বিক্রি করেন। পরবর্তীতে পাইকাররা কেজিপ্রতি ৬/৭ টাকা বাড়িয়ে তা খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। ভোক্তার কাছে পৌঁছতে এর সঙ্গে আরও ৫ থেকে ৭ টাকা যুক্ত হয়।

বেপারীদের দাবি, কৃষকরা যে দরে কাঁচামাল বিক্রি করেন, ভোক্তাদের তা কিনতে ৩ থেকে ৪ গুণ বেশি অর্থ খরচ করতে হয়। এর খুব সামান্য অংশ তারা লাভ হিসেবে পান। অতিরিক্ত পণ্য পরিবহন খরচ, ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজি, অব্যবস্থাপনা ও সর্বোপরি হাতবদলের সংখ্যা বেশি হওয়ায় কাঁচামালের বাজার অস্থির থাকছে।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ