ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
স্বপ্নের মেট্রোরেল

নামকরণে ভিন্নতা কেন নয়

প্রকাশনার সময়: ২১ ডিসেম্বর ২০২১, ০৮:৩৭

ঢাকাবাসীর স্বপ্নের মেট্রোরেল একটু একটু করে উড়তে শুরু করেছে। দিয়াবাড়ি থেকে পল্লবী, সবশেষ দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও স্টেশন পর্যন্ত নিয়মিত বিরতিতে শুরু হয়েছে ‘ট্রায়াল রান’। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে যাত্রী নিয়ে উড়াল দেয়ার ‘সংকল্প’ নিয়ে আনুষঙ্গিক সব কাজ সম্পন্ন করতে দেয়া হচ্ছে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। ২০২৩-এর ডিসেম্বরের মধ্যে দিয়াবাড়ি থেকে মতিঝিলের ২০ কিলোমিটারেরও বেশি পথ নিয়মিত পাড়ি দেবে দেশের প্রথম উড়াল মেট্রোরেল। এর পর কমলাপুর পর্যন্ত বর্ধিত করা হবে লাইনটি।

তখন কমলাপুরেও হবে মেট্রোরেলের স্টেশন। দীর্ঘ এই রেলপথে যাত্রী ওঠানো ও নামানোর জন্য থাকছে ১৬টি রেলস্টেশন। প্রাথমিকভাবে স্টেশনগুলোর নামকরণ করা হয়েছে স্থানীয় নামে। তবে দেশের সুশীল সমাজের বিশিষ্টজন ও সাধারণ মানুষ বলছেন, শিল্প-সাহিত্য-রাজনৈতিক অঙ্গনের দেশবরেণ্য ব্যক্তিত্বদের নামেই হওয়া উচিত মেট্রোরেল স্টেশনগুলোর নাম।

তারা বলছেন, মেট্রেরেলের নামকরণে অবশ্যই ভিন্নতা আনা দরকার। একটা জাতিকে শিক্ষিত করতে অনেক ধরনের টুলস ব্যবহার করতে হয়। মেট্রোরেল স্টেশনগুলোর নাম দেশের বিখ্যাত ব্যক্তিদের নামে করা যেতে পারে। যেমন ‘স্টেশন বঙ্গবন্ধু স্কয়ার-বিজয় সরণি’, ‘স্টেশন কবি নজরুল-শাহবাগ’। এভাবে শিল্প-সাহিত্য-রাজনৈতিক অঙ্গনের ব্যক্তিত্বদের নামে মেট্রোর নামকরণ করলে নতুন প্রজন্ম স্টেশনে বসেই সেই ব্যক্তি সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট ধারণা পাবে। যে স্টেশন যার নামে সেই স্টেশনে তার একটি স্ট্যাচু ও তার প্রোফাইল থাকতে পারে। যা শিশুদের ওই স্টেশনে নেমে জানার জন্য আগ্রহ তৈরি করবে। স্টেশনে অপেক্ষার ফাঁকে যাত্রীরা ওটা পড়ে নেবেন। বিশেষ করে শিশুরা।

বিশিষ্টজনদের নামে মেট্রোর স্টেশনগুলোর নামকরণ বিষয়ে এখনই কিছু বলতে পারছে না মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা—ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)। সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পাওয়া নির্দেশনা অনুসারে প্রকল্পের সব কাজ এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। সাধারণভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মেট্রোরেল স্টেশনের নামকরণ করা হয় স্থানের নামে। ঢাকার প্রথম মেট্রোরেলপথের স্টেশনগুলোর নামকরণও তাই সংশ্লিষ্ট জায়গার নামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই করা হয়েছে। সরকারিভাবে নতুন কোনো সিদ্ধান্ত এলে সেভাবে নামকরণ করা এখনো সম্ভব।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রাথমিকভাবে মেট্রোরেল স্টেশনগুলোর নাম রাখা হয়েছে—উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ সচিবালয় ও মতিঝিল।

বিশিষ্টজনেরা বলছেন, স্টেশনগুলোর নামে মিষ্টতা-কাব্যিকতা-ভিন্নতা আনতে ১৬টি স্টেশনের নামকরণ এমনো হতে পারে— ‘স্টেশন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (উত্তরা-উত্তর); স্টেশন মাস্টারদা সূর্য সেন (উত্তরা-সেন্টার); স্টেশন বাউল শাহ আবদুল করিম (উত্তরা-দক্ষিণ); স্টেশন হাসন রাজা (পল্লবী); স্টেশন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (মিরপুর-১১); স্টেশন লালন শাহ (মিরপুর-১০); স্টেশন এস এম সুলতান (কাজীপাড়া); স্টেশন কবি শামসুর রাহমান (শেওড়াপাড়া); স্টেশন শেরে বাংলা ফজলুল হক (আগারগাঁও); স্টেশন বঙ্গবন্ধু স্কয়ার (বিজয় সরণি); স্টেশন মধুসূদন (ফার্মগেট); স্টেশন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (কারওয়ান বাজার); স্টেশন কবি নজরুল (শাহবাগ), স্টেশন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়); স্টেশন মানিক মিয়া (বাংলাদেশ সচিবালয়); স্টেশন কবিগুরু (মতিঝিল); স্টেশন জসীম উদ্দীন (কমলাপুর)।

বিশিষ্টজনদের মতে, যে স্টেশন যে ব্যক্তির নামে হবে সেই স্টেশনে তার ৫০ ফুট উচ্চতার স্ট্যাচু থাকবে। স্ট্যাচুর সামনে তার সংক্ষিপ্ত জীবনী বাংলা ও ইংরেজিতে খোদাই করা থাকবে। স্টেশনের গেটে স্টেশনের নামের পাশাপাশি ব্রাকেটে ওই স্থানের নাম থাকবে। মেট্রোরেলের স্ক্রলে শুধু ব্যক্তির নাম থাকবে। কিন্তু ভয়েস ওভারে ব্যক্তির নামের পাশাপাশি স্থানের নামও থাকতে পারে।

ডিএমটিসিএল সূত্রে জানা যায়, মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সাড়ে ১৬ হাজার কোটি টাকা দেবে জাপান। বাকিটা সরকার দেশীয় উৎস থেকে ব্যয় করবে। মেট্রোরেল পুরোপুরি বিদ্যুৎচালিত রেল। বাংলাদেশে এই প্রথম বিদ্যুৎচালিত কোনো রেল চালু হতে যাচ্ছে। প্রতি ঘণ্টায় আপ ও ডাউন রুটে ৬০ হাজার যাত্রী যাওয়া-আসা করতে পারবেন। মেট্রোরেলের পথটির নাম দেয়া হয়েছে এমআরটি লাইন-৬। ২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই পথে ১৬টি স্টেশন থাকছে। প্রকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী, বাস্তবায়নের মেয়াদ ২০২৪ সাল পর্যন্ত। তবে এরই মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে উত্তরা থেকে মিরপুর ১০ পর্যন্ত চলেছে মেট্রোরেল। এই প্রকল্পটি পুরোপুরি চালু হলে ঢাকার যানজট সমস্যার অনেকাংশে কমে আসবে আশা করা হচ্ছে।

জানা গেছে, ট্রেনে ওঠার একমাত্র পথ স্টেশন ভবন। স্টেশনগুলো তিনতলা। সড়ক থেকে লিফট, এস্কেলেটর ও সিঁড়ি দিয়ে যাত্রীরা দ্বিতীয় তলার কনকোর্স হলে উঠবে। এই তলায় টিকিট কাটার ব্যবস্থা, অফিস ও নানা যন্ত্রপাতি থাকবে। তিন তলায় রেললাইন ও প্ল্যাটফর্ম। একমাত্র টিকিটধারীরাই ওই তলায় যেতে পারবে। দুর্ঘটনা এড়াতে রেললাইনের পাশে বেড়া থাকবে। স্টেশনে ট্রেন থামার পর বেড়া ও ট্রেনের দরজা একসঙ্গে খুলে যাবে। আবার নির্দিষ্ট সময় পর তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হবে।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘মেট্রোরেল স্টেশনগুলোর নামকরণ দেশের বিশিষ্টজনদের নামে করা যেতে পারে। নামকরণ করলে তাদের একভাবে সম্মানই জানানো হবে। এর আগেও ঢাকার বেশ কিছু সড়কের নাম বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামে করা হয়েছিল। তবে তা খুব বেশি ফলপ্রসূ হয়নি।’

তিনি বলেন, দেশের বিশিষ্টজনদের নামে অনেক কিছু করা যেতে পারে। শুধু স্টেশন নামকরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না। তাদের নামে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠানের নাম দেয়া যেতে পারে। তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম দেশের মহারত্নদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে আরো বেশি আগ্রহী হয়ে উঠবে।

মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল নয়া শতাব্দীকে বলেন, রাজধানীতে নির্মাণাধীন মেট্রোরেল স্টেশনের নামকরণ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নামে হওয়া দরকার। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে তাদের নামে স্ট্যাচু হওয়া দরকার। সম্মানিত ব্যত্তিদের প্রাপ্য সম্মান হিসেবেই এটা করা উচিত। এটা দেশের মহারত্ন বা মহাজ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিরা ডিজার্ভ করেন। তিনি বলেন, শাহবাগে কাজী নজরুল ইসলামের সমাধি রয়েছে। তবে অনেকেই তা জানেন না।

বিশেষ একটা দিনে স্মরণ করা হয়। যদি শাহবাগ স্টেশনের নাম ‘কবি নজরুল’ নামে হয় তাহলে মানুষ তার সম্পর্কে জানবে। প্রতিদিন হাজারো মানুষ তাকে স্মরণ করবেন। নতুন প্রজন্মের কাছেও কবি নজরুল বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। ঠিক একইভাবে অন্য মহাপুরুষরা স্মরণীয় হতে থাকবেন যুগের পর যুগ।

নয়া শতাব্দী/এসএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ