ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

বাবা ফেরেননি, লাশও মেলেনি

স্বীকৃতির জন্য দৌঁড়ে হাল ছেড়েছে সন্তানরা
প্রকাশনার সময়: ১৭ ডিসেম্বর ২০২১, ২১:৩৩ | আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০২১, ২৩:০২

ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার চরমজলিশপুর ইউনিয়নের চান্দলা গ্রামের মৌলভী ও হেকিম আবদুস ছাত্তার শান্তি কমিটির ধাওয়ায় পালাতে গিয়ে আর ফেরেননি।

ফেনী শহরের মাস্টার পাড়ায় তার দুই হাতে পেরেক মেরে বুক ছিড়ে হত্যা করে লাশ অজ্ঞাত স্থানে ফেলে দেয়া হয়েছে বলে পরবর্তীতে স্বজনরা জানতে পেরেছেন।

বুধবার মুক্তিযুদ্ধে বাবার বাস্তবতার গল্পের স্মৃতিগুলো বলছিলেন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবদুস ছাত্তারের মেয়ে হোসনেয়ারা। তিনি জানান, বাবা ছাত্তার মৌলভী ছিলেন ভাসানী ন্যাপ পন্থী নেতা। তিনি বিভিন্ন সময়ে কবিতা লিখে তা আবৃত্তি করে সাধারণ মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন।

ফেনী সদর উপজেলার সুন্দরপুর ও সোনাগাজীর কুঠির হাটসহ বিভিন্ন বাজারে হেকিমী ঔষধ বিক্রি করে ১০ সন্তানের সংসারের ব্যয়ভার বহন করতেন দেশ প্রেমিক আব্দুস ছাত্তার।

হোসনেয়ারা জানান, আমার বয়স তখন ৯/১০ বছর। দেশজুড়ে চলছে যুদ্ধ। ১০ শ্রাবণ (সম্ভাব্য তারিখ) কুঠির হাট থেকে তার বাবাকে ধরে নিয়ে যান রাজাকাররা। বাবাকে সারা রাত বিঞ্চুপুর স্কুলের ক্যাম্পে উপোষ রেখে ভোর রাতে কুঠির হাটের তৎকালীন কসাইখানার পাশে নিয়ে যাওয়া হয় হত্যা করার জন্য। সেখানে বাবার আগেই ৬ জনকে হত্যা করে নদীতে লাশ ফেলে দেয়া হয়েছে। বাবাকে গুলি করার জন্য তারা প্রস্তুতি নিলে তিনি দুই রাকায়াত নামাজ পড়ার জন্য তাদের নিকট সময় ভিক্ষা চান। তারা রাজী হয়ে সেখানেই নামাজ আদায় করতে বলেন। সেখানে কসাইখানার গরুর রক্ত পড়ে থাকায় বাবা তৎসংলগ্ন কাঠের পুলের উপর নামাজ আদায়ের অনুমতি চান।

একপর্যায়ে শান্তি কমিটি বাবাকে নামাজ পড়তে অনুমতি দেয়। বাবা দুই রাকাত নামাজ আদায় করে মোনাজাত না করেই নদীতে ঝাঁপ দিয়ে কচুরী ফেনার নিচে পালিয়ে যান। সাথে সাথে নদীর পানিতে রাজাকারদের গুলির আওয়াজে আশপাশ প্রকম্পিত হয়। কিন্তু বাবার শরীরে কোন আঁচ লাগেনি। বাবা কচুরী ফেনা ধরে পাশ্ববর্তী গ্রামের একটি বাড়িতে গিয়ে সকালে আশ্রয় প্রার্থণা করেন।

তারা বাবাকে নাস্তা করিয়ে হামলার আশঙ্কায় অপারগতা স্বীকার করেন। একপর্যায়ে বাবা আবার চান্দলায় নিজ বাড়িতে চলে আসেন। ততক্ষণে বাবার চেহারায় ক্ষুদার যন্ত্রণা আর মৃত্যুর ভয়ের প্রতিচ্ছবি আমরা দেখেছি। আম্মা তড়িঘড়ি করে নারিকেল দিয়ে আব্বাকে পান্তাভাত ক্ষেতে দেয়। আব্বা খাওয়া শুরু করতেই দুই চাচা এসে আব্বুর হাতের বাহু ধরে আব্বুকে দাড় করিয়ে বলে ‘তুই এখনি বাড়ি থেকে পালিয়ে যা’ তোকে ধরার জন্য শান্তি কমিটির লোকজন বাড়ির দিকে আসছে’। বাবা পেটপুরে খাবার না খেয়েই গায়ে চাদর মুড়িয়ে বালিগাঁও গ্রামের দালাল বাড়িতে (সমি পাটোয়ারী বাড়ি) দৌঁড়ে গিয়ে আশ্রয় চায়। কিন্তু তাদেরও একই কথা। তোমাকে রাখলে আমাদের বাড়িতেও হামলা হতে পারে। ইতোমধ্যে তৎকালীন ঐতিহ্যবাহী চান্দলা মাদ্রাসার মুহতামিম নুর আহাম্মদের লেখা একটি চিঠি বাবার কাছে পৌঁছে। ওই চিঠিতে বাবাকে ফেনীর একটি স্থানে (নামটা মনে নেই) নিরাপদ আশ্রয় নেয়ার জন্য অনুরোধ ছিলো। চিঠিটি হাতে পেয়েই বাবা পায়ে হেটে ফেনী শহরতলীর লুদ্দার পাড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের ওই বাড়িটি খুঁজছিলেন।

আবদুস চাত্তারের ছেলে গিয়াস উদ্দিন জানান, বাড়ি খুঁজতে গিয়ে বাবার সাথে দেখা হয় আমাদের প্রতিবেশি মফিজ চেয়ারম্যানের সাথে (তৎকালীন রাজাকার সদস্য)। তিনি আব্বাকে আশ্রয়ের কথা বলে ফেনী শহরের একটি বাসায় নিয়ে যান। সেখান থেকে রাতেই আব্বাকে শান্তি কমিটির লোকজনের হাতে তুলে দেয় মফিজ চেয়ারম্যান।

তিনি জানান, ১৩ শ্রাবণ লোকজনের কাছে জানতে পারি আব্বাসহ আরো কয়েকজন মুক্তিকামী মানুষকে ফেনী শহরের ট্রাংক রোড এলাকায় গাছের সাথে প্যারেক মেরে বুক ছিড়ে হত্যা করে টাঙ্গিয়ে রাখা হয়েছে। খবর পেয়ে এলাকার কিছু লোক আব্বাকে দেখার জন্য যায়। কিন্তু আমার বড় ভাই সিরাজ বাবাকে দেখতে এলে তাকেও হত্যা করতে পারে শান্তি কমিটির লোকজন। তাই স্বজনরা ভাইয়াকে আব্বার লাশটাও দেখতে দেয়নি।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভাইয়া ফেনী ও আশপাশের সকল স্থানে আব্বুর লাশ খুঁজেছে। কিন্তু কোথাও সন্ধান মেলেনি। তবে যুদ্ধ পরবর্তী ফেনী থেকে প্রকাশিত অর্ধ সাপ্তাহিক পথ পত্রিকায় বাবাসহ সেদিন যাদেরকে হত্যা করা হয়েছিলো তাদের নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

কিন্তু সে প্রতিবেদনেও সেদিনের লাশগুলোর সমাধি স্থান নিয়ে কিছু বলা হয়নি। জানা যায়নি বাবার লাশের স্থান কোথায় হয়েছিলো।

গিয়াস উদ্দিন জানান, কুঠির হাটের নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচেও ফেরার পরও বাবাকে হারালাম। সেদিন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ঘর থেকে বের হওয়া বাবাকে হারালাম; হারালাম বাবার লাশও। মায়ের কবরের পাশে দাঁড়ালেই বাবার কবর খুঁজি। সবাই তার বাবা মায়ের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে দোয়া করে। আমরা এমন পরিবারের সন্তান কখনো বাবার কবরের পাশে দাঁড়ানোর ভাগ্য আমাদের হবেনা। আমরা এক হতভাগ্য মুক্তিকামী মানুষের সন্তান। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবদুস ছাত্তারের নাতী সাংবাদিক নুর উল্লাহ কায়সার জানান, নানার উপর নির্যাতন আর নানা শহীদ হওয়ার বিষয়টি অনেকেই জানতো। এখন এর প্রত্যক্ষদর্শী কেউ বেঁচে নেই। শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের একটি তালিকায় নানার নাম উল্লেখ থাকার পরও স্বীকৃতির জন্য মুক্তিযোদ্ধা নেতাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন বড় মামা সিরাজুল ইসলাম।

কিন্তু কোন ফল হয়নি। তবে প্রয়াত জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আজিজ আহাম্মদ চৌধুরী মজলিশপুর ইউনিয়নের চান্দলা গ্রামের একটি সড়কের নাম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবদুস ছাত্তারের নামে করে দিয়ে আমাদের সম্মানিত করেছেন।

নয়া শতাব্দী/এম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ