ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬
৫০ বছরেও শেখা হয়নি নিয়ম

অজ্ঞতার কারণে পতাকার অবমাননা

প্রকাশনার সময়: ১৬ ডিসেম্বর ২০২১, ২০:১৮ | আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০২১, ২০:৪১

দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশলক্ষ শহীদ ও দুইলক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের প্রিয় লাল সবুজের পতাকা। এই জাতীয় পতাকা শুধু একটি কাপড়ের টুকরো নয়। স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রতীক। জেনে হোক বা অজ্ঞতার কারণে হোক, জাতীয় পতাকার অবমাননা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। জাতীয় পতাকা কীভাবে ব্যবহৃত হবে, সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট আইন থাকা সত্ত্বেও অজ্ঞতার কারণে তার লঙ্ঘন হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

জাতীয় পতাকার অবমাননা হলেও এদিকে প্রশাসনের কোনো নজর নেই। এরই ফলে বিজয়ের ৫০ বছরেও আমরা শিখতে পারিনি পতাকা ব্যবহারের সঠিক নিয়ম কানুন।

বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের নিদর্শন জাতীয় পতাকা বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, ঈদ এ মিলাদুন্নবী ও সরকার প্রজ্ঞাপিত অন্য যেকোনো দিবসে বাংলাদেশের সরকারি, বেসরকারি ভবন ও বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনের প্রাঙ্গণে এবং কনসুলার কেন্দ্রগুলোয় জাতীয় পতাকা উত্তোলন বাধ্যতামূলক করা হয়।

তাছাড়া শহীদ দিবস ও জাতীয় শোক দিবসে বা সরকার প্রজ্ঞাপিত অন্যান্য দিবসে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকার বিধান রয়েছে। অর্ধনমিত রাখতে হলে পতাকা উত্তোলনের নিয়ম হলো, অর্ধনমিত অবস্থায় উত্তোলনের প্রাক্কালে পতাকাটি পুরোপুরি উত্তোলন করে অর্ধনমিত অবস্থানে আনতে হবে এবং পতাকা নামানোর প্রাক্কালে পতাকাটি শীর্ষে উত্তোলন করে নামাতে হবে। বিধিমালা অনুযায়ী, সঠিক রং ও মাপে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করতে হবে।

আবার ইচ্ছা করলেই যে কেউ জাতীয় পতাকাকে গাড়িতে ব্যবহার, কেউ পোশাক হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে না। এমনকি গায়েও জড়িয়ে রাখা যাবে না। জাতীয় পতাকা কোনো অবস্থায়ই সমতল বা সমান্তরালভাবে বহন করা যাবে না এবং উত্তোলনের সময় সুষ্ঠু ও দ্রুতলয়ে উত্তোলন করতে হবে এবং সসম্মানে অবনমিত করতে হবে। জাতীয় পতাকা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উত্তোলিত থাকবে এবং সূর্যাস্তের পর কোনো মতেই পতাকা উড্ডীয়ন অবস্থায় থাকবে না।

কোনো দেয়ালে দণ্ডবিহীন পতাকা প্রদর্শিত হলে তা দেয়ালের সমতলে এবং রাস্তায় প্রদর্শিত হলে উলম্বভাবে দেখাতে হবে। গণমিলনায়তন কিংবা সভায় পতাকা প্রদর্শন করা হলে বক্তার পেছনে ও ঊর্ধ্বে স্থাপন করতে হবে। পতাকা এমনভাবে উত্তোলন, প্রদর্শন বা মজুদ করা যাবে না, যাতে এটি সহজেই ছিঁড়ে যেতে পারে, মাটি লাগতে পারে বা নষ্ট হতে পারে। অনুমতি ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে জাতীয় পতাকাকে ট্রেডমার্ক, ডিজাইন বা পেটেন্ট হিসেবে ব্যবহার করাও অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।

জাতীয় দিবসগুলোতে জাতীয় পতাকা ব্যবহারের মাত্রা বেড়ে যায়। যা খুবই আনন্দের একটি বিষয়। কিন্তু বিধিমালা জেনে বা না জেনে আমরা পতাকা অবমাননা করলেও সেটা নিয়ে আমাদের কারো মাথা ব্যাথা নেই। যে ভোবে পারে সেভাবেই নিজের ইচ্ছেমত বেশিরভাগ মানুষ বিভিন্ন জাতীয় দিবসে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ভবনে বাঁশের খুঞ্চিতে, লাঠি, ছোট পাইপে বেধে উল্টেপাল্টে, বাঁকা ত্যাড়াভাবে ঝুলিয়ে টানাচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রতীক লাল সবুজের এ পতাকা। জাতীয় দিবস গুলোতে রাস্তায় বের হলেই দেখা যায় পতাকার যত্রতত্র ব্যবহার। শুধু মাত্র আমজনতার ক্ষেত্রে এমনটা চোখে পড়ে তা নয়, বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি ও স্বায়িত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক বীমা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও যত্রতত্র ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। ভালোবাসা থেকে পতাকা টানালেও নিয়ম মানছেনা কেউ। জাতীয় দিবস গুলোতে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ভবনের কেউই মানছেনা কোনো নিয়মনীতি।

গৌরবময় মহান বিজয় দিবসের ৫০ বছর পূর্ণ হওয়ার স্বাধীনতার এ সুবর্ণ জয়ন্তীতে আজ ১৬ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার সরকারি নির্দেশনায় সারাদেশের ন্যায় কিশোরগঞ্জের ভৈরবে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করা হয়। এসব কর্মসূচীর মধ্যে সূর্য্যদেয়ের সাথে সাথে সকল সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়িত্বশাসিত, বেসরকারি, ব্যক্তি মালিকানাধীন ভবনসমূহে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের নির্দেশনা থাকলেও বেশিরভাগ ভবনেই উত্তোলন করা হয়নি পতাকা। আবার যেসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ভবনে উত্তোলন করা হয়েছে তাতে মানা হয়নি কোনো নিয়ম।

আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ভৈরব বাজারসহ শহরের বিভিন্ন অলিগলিতে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, ছোট ছোট বাঁশের খুঞ্চিতে, লাঠি, পাইপে বেধে দোকানের সার্টার, ভবনের বারেন্দার গ্রিলে, সাইনবোর্ডের বাড়তি লোহার রডে বেধে টানানো হয়েছে এ পতাকা।

যত্রযত্র ভাবে পতাকা টানানো থেকে বাদ যায়নি বিভিন্ন ব্যাংক গুলোও। আবার কিছু কিছু ব্যাংকে টানানোই হয়নি পতাকা। দেখাযায়, শহরের বঙ্গবন্ধু সরনির এনআরবিসি ব্যাংকের সাইনবোর্ডের পাশে ওই ব্যাংকের একটি ব্যানারের দুই প্রান্তে জোড়া দেয়া ছোট বাঁশের খুঞ্চে টানিয়ে রাখেন দুটি পতাকা। একই সড়কের ব্র্যাক ব্যাংকে সাইনবোর্ডের রড়ে পতাকা ঝুলিয়ে রাখা হয়। যা চোখে পড়ার মতনা। অন্যদিকে ভৈরব বাজারের সিটি ব্যাংক ও প্রিমিয়ার ব্যাংকের সাইনবোর্ডে প্লাস্টিকের পাইপে বাকাত্যাড়াভাবে টানানো হয়, উত্তরা ব্যাংকের দ্বিতীয় তলার বারেন্দার গ্রিলের সঙ্গে ত্যাড়াভাবে প্লাষ্টিক পাইপে, পূবালী ব্যাংক ভৈরব বাজার শাখায় গ্রিলে, কমলপুর শাখায় ও ন্যাশনাল ব্যাংক, খুঞ্চিতে, ডাচ্ বাংলা ব্যাংকে কেসি গেইটে পাইপে টানানো হয় এবং ঢাকা ব্যাংকের ফটকে বাকা পাইপে এবং ইস্টান ব্যাংকের সিঁড়িতে কয়েক ফুট লম্বা পাইপে বেধে নিম্নমুখী অবস্থায় পতাকা ঝুলিয়ে রাখা হয়। এছাড়াও বিভিন্ন ব্যাংক ও বীমা অফিস, বিভিন্ন হাসপাতালসহ শহরের অলিগলিতে একই চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। তবে কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠান ও স্কুলে গিয়ে দেখা গেছে সঠিকভাবে পতাকা টানানো রয়েছে।

ব্যবসায়ীরা জানান, দীর্ঘদিন পরপর জাতীয় দিবস গুলো আসায় তারা পতাকা টানাতে বিভিন্ন ভুল করে থাকেন। কিছুটা অজ্ঞতা ও অনিচ্ছাকৃত ভুলের কারণে সঠিকভাবে পতাকা টানাতে না পারলেও দেশের প্রতি আবেগ ও ভলোবাসা থেকেই বিভিন্ন দিবসে পতাকা টানানো হয় বলে জানান তারা। ভবিৎষতে পতাকার সঠিক নিয়ম মানবেন বলেও জানানো হয়।

ভৈরব উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার ফরহাদ আহমেদ বলেন, অনেকই দেশপ্রেম থেকেই বিভিন্ন জাতীয় দিবসে পতাকা টানাতে দেখেছি। দূঃখ হলো বেশিরভাগই পতাকার টানানোর সঠিক নিয়ম মানছেনা। সামনে যা পায় তা দিয়ে পতাকা বাকাত্যাড়াভাবে ঝুলিয়ে রেখে দেয়। যা কিনা জাতীয় পতাকার অবমাননা। মানুষের মাঝে সচেতনাবৃদ্ধির পাশাপাশি প্রশাসনের হন্তক্ষেপ জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

এডভোকেট মোশারফ হোসেন বলেন, আইনের ৫ধারায় বলা হয়েছে, জাতীয় পতাকার প্রতি অবমাননা প্রদর্শন করা বা জাতীয় পতাকার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন না করলে ওই ব্যক্তিকে ১ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। ২০১০ সালে সংশোধিত আইনে সর্বোচ্চ ২ বছর পর্যন্ত শাস্তি এবং ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়। তবে অজ্ঞতার কারণে যারা না জেনে, না বুঝে আর অতি উচ্ছ্বাসে যারা পতাকা ব্যবহারবিধি লঙ্ঘন করেন, তাদের অপরাধের মাত্রা বিবেচনা করে এই শাস্তির বিধান যথাযথ হতে পারে।

নয়া শতাব্দী/এম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ