ঢাকা, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ব্ল্যাঙ্ক স্ট্যাম্পে শিশু বিক্রি

প্রকাশনার সময়: ১৩ ডিসেম্বর ২০২১, ০৮:৪২

ঈশ্বরীপুর ইউনিয়ন ঘুমঘাট আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির ছাত্র জয়দেব মন্ডল। তার বাবা গৌরপদ মন্ডল মঠের চক গ্রামের বাসিন্দা। অন্যের জমিতে চাষাবাদ করে ৭ জনের সংসার চালান তিনি। টাকার অভাবে নবম শ্রেণির রেজিস্ট্রেশন করা হয়নি জয়দেবের। একই কারণে পাশের গ্রাম ধুমঘাট কেওড়াতলীর কৃষ্ণপদ মন্ডলের ছেলে দেবব্রত মন্ডলের স্কুল ছাড়তে হয়েছে। এই গ্রামের ৫ শ্রেণির ছাত্র পাঁচু মন্ডলের ছেলে প্রদীপ মন্ডলও করোনা পরবর্তী সময়ে আর স্কুলে ভর্তি হয়নি। স্কুল ছেড়ে তারা এখন কী করছে- এ বিষয়ে অনুসন্ধান চালায় নয়া শতাব্দী। অনুসন্ধানে উঠে আসে— শুধু এই তিন শিশুই নয়, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন থেকে অন্তত কয়েক হাজার শিশুর শৈশব এখন বন্দি হয়ে পড়েছে দেশের বিভিন্ন ইটভাটায়। স্ট্যাম্প করে তাদের বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠনের দেয়া তথ্যমতে, সাতক্ষীরায় এ রকম ভাগ্যবরণ করা শিশুর সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।

অভিযোগ রয়েছে, দারিদ্র্য যে সব পরিবারের গলার ফাঁস এ রকম পরিবারগুলোকে টার্গেট করে স্থানীয় ভাটা সর্দাররা। এরপর আগাম মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ৬ থেকে ৮ মাসের জন্য এসব পরিবারের সন্তানদের পাঠিয়ে দেয়া হয় ইটভাটায়। টাকার নিশ্চয়তা পেতে বিনিময়ে খালি স্ট্যাম্পে বাবা মায়ের স্বাক্ষর ও ব্ল্যাঙ্ক চেক রেখে দেয়া হয়। কষ্ট সহ্য করতে না পেরে কোন শিশু ইটভাটা থেকে পালিয়ে এলে স্ট্যাম্প ও চেকে ইচ্ছামতো টাকার অংক বসিয়ে তা আদায় করা হয়। বিষয়টি স্বীকারও করেছে ভাটার সর্দাররা। স্থানীয় মানবাধিকার কর্মীদের দাবি— ৮ মাসের জন্য এক একটি শিশুকে কিনে নেয় ভাটা সর্দাররা। অনুসন্ধানে ওঠে আসা এসব তথ্য নয়া শতাব্দীর কাছে ভিডিও রেকর্ড আকারে সংরক্ষিত আছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘এটা চরম অমানবিক। স্থানীয় প্রশাসনের উচিত বিষয়টি দেখভাল করা। এজন্য আমরা লোকাল প্রশাসনের কাছে প্রতিবেদন চাইব। একই সঙ্গে বাবা-মা কোনো অবস্থাতেই তাদের শিশুদের উপার্জনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে না। তিনি বলেন, খালি স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নেয়া চরম অন্যায়। তারা ওই স্ট্যাম্পে শিশুর পরিবর্তে সম্পত্তিও লিখে নিতে পারে। এজন্য জনসচেতনতা জরুরি। অভাবের কারণে বয়স্করা কাজ করতে পারে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই শিশুদের শৈশব বিক্রি করার অধিকার কারোরই নেই।’

সোসাইটি ফর অল হিউম্যান রাইটস অব বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার আহ্বায়ক ইসারত আলী নয়া শতাব্দীকে জানান, ঘূর্ণিঝড় আইলা পরবর্তী সময়ে কালীগঞ্জ ও শ্যামনগর উপজেলার মানুষ এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এছাড়া প্রতিবছরই তাদের দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হয়। এ কারণে ঘরে ঘরে অভাব লেগে থাকে। অভাবের কারণে অনেক পরিবারের সন্তানরা প্রাইমারি স্কুল থেকেই ঝরে যায়। এরপর তাদের পরিবারের সদস্যরা এককালীন মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে তাদের সন্তানদের ভাটায় পাঠিয়ে দেন। অনেক সময় এসব শিশু কষ্ট সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে আসে। এ কারণে শিশুর বাবা মায়ের কাছ থেকে খালি স্ট্যাম্প ও চেকে সই করে নেয়া হয়। কেউ পালিয়ে এলে অন্তত ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা বেশি লিখে এসব শিশুর পরিবারের কাছ থেকে আদায় করা হয়।

তিনি বলেন, প্রতি বছর অক্টোবর ও নভেম্বরে এসব শিশু পাঠিয়ে দেয়া হয়। তারা ফিরে আসে এপ্রিল অথবা মে মাসে। প্রতিবছর অন্তত ২০ হাজার শিশু ভাটায় গেলেও এবার এ সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। কারণ করোনার সময় অনেকেই পরিবারের ভাটা সর্দারদের কাছ থেকে আগাম টাকা নিয়ে সংসার খরচ চালিয়েছেন। এসব টাকা শোধ করতে না পারায় তাদের সন্তানদের বাধ্য হয়েই ভাটায় যেতে হয়েছে।

ইসারত আলীর এসব কথার সূত্র ধরে শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনি, মুন্সীগঞ্জ, ঈশ্বরীপুর, নওয়াবেকি, কৈখালী, শ্যামনগর সদর ও কাশিমাড়ি ইউনিয়নে অনুসন্ধান চালায় নয়া শতাব্দী। সেখানে দেখা যায়, চুনা বুড়িগোয়ালিনী গ্রাম থেকে মজিবর রহমানের ১২ বছর বয়সি ছেলে আজানুর, চাঁদনীমুখা গ্রামের আলাউদ্দিন গাজীর ১৪ বছর বয়সি ছেলে মোশারফ ও গাবুরার জাকির হোসেনের ১৩ বছর বয়সি ছেলে লতিফ চলে গেছেন ইট ভাটায়। এর মধ্যে মজিবরের জন্য নেয়া হয়েছে ৬০ হাজার টাকা, মোশারফের জন্য ৮০ হাজার ও লতিফের পরিবারর নিয়েছেন ৩৫ হাজার টাকা। ঈশ্বরীপুর ইউনিয়নের মঠের চক গ্রামের বাসিন্দা গৌরপদ মন্ডলের ছেলে জয়দেব মন্ডলের জন্য ৮০ হাজার, ধমঘাট কেওড়াতলীর কৃষ্ণপদ মন্ডলের ছেলে দেবব্রত মন্ডলের জন্য ৬৫ হাজার ও একই গ্রামের পাচু মন্ডলের ছেলে প্রদীপ মন্ডলের জন্য নেয়া হয়েছে লাখ টাকার ওপরে। এসব বিষয়ে সবার পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অভাবের কারণে তারা তাদের সন্তানদের ৮ মাসের জন্য এক প্রকার বিক্রি করে দিয়েছে। এই ৮ মাসের মধ্যে তারা দু’বার বাড়ি আসতে পারবে। আর এই শিশুরা বাড়িতে অবস্থানের সুযোগ পাবে মাত্র ৭ দিন।

শ্যামনগর ইটভাটা শ্রমিক সরদার কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি’র সিনিয়র সদস্য আব্দুর রশীদ বলেন, আমরা আমাদের টাকার নিরাপত্তার জন্যই স্ট্যাম্প করে থাকি। শিশুদের ক্ষেত্রে তার বাবা-মা স্ট্যাম্পে সই করে থাকেন। বিষয়টি উপজেলায় সবাই জানে। অভাবের কারণে তাদের বাবা-মা সন্তানদের কাজে লাগান। বাড়তি সতর্কতা হিসেবে এ বছর সবার কাছ থেকে ভোটার আইডি নেয়া হয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, দাদনের টাকা নির্ধারণ হয় কাজের ধরন বুঝে। একটি ভাটায় সাধারণত ৫ থেকে ৬ জন সর্দার থাকে। তাদের ভাটায় মিল মালিক বলা হয়। এসব মিল মালিকরা কাঁদা বানানোর জন্য, ভাটায় আগুন নিশ্চয়তা করতে, ইট উল্টাতে, ইট বানাতে, ইট বহনে ও ইট সাজানোর জন্য তাদের অধীনে লোক নিয়োগ দেন। এর মধ্যে ইট উল্টাতে, ইট বানাতে ও ইট বহনে শিশুদের ব্যবহার করা হয়। কারণ, শিশুদের হাত ও পায়ের মাপ ছোট থাকার কারণে তারা খুব সহজেই ইটের সারিতে আসা-যাওয়া করতে পারে। পাশাপাশি তাদের জন্য পারিশ্রমিক তুলনামূলক কম দেয়া লাগে।

স্থানীয় ভাটা সর্দার নুরুদ্দীন জানান, লোক সংগ্রহ করতে আগষ্ট মাস থেকে ভাটা মালিকরা সর্দারদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরপর তাদের আগাম টাকা দিয়ে দেয়া হয়। ওই টাকা নিয়ে সর্দাররা এলাকায় ফিরে লোক সংগ্রহে নামে। বয়স্ক লোক পাওয়া গেলেও শিশুদের ক্ষেত্রে বিপত্তি দেখা দেয়। এ কারণে যে পরিবারে শিশু আছে তাদের সবাইকেই ইটভাটায় যাওয়ার জন্য টাকার প্রলোভন দেখানো হয়। পাশাপাশি গরিব স্কুলছাত্রদেরও রাস্তাঘাটে আলাপের মাঝে ইটভাটায় যাওয়ার জন্য প্রলোভন দেখানো হয়। অল্প বয়সে মোটা অঙ্কের টাকার লোভ সামলাতে না পেরে অনেক শিশু পরিবারের সদস্যদের না বলেই গোপনে ইটভাটায় চলে যায়। সেখানে যাওয়ার পর তারা পরিবারকে ভাটায় যাওয়ার বিষয়টি জানায়। এ সময় অভিভাবকদের আর কিছুই করার থাকে না। ভাটায় যাওয়ার পর তিন বেলা খাওয়া ও সেখানেই থাকার ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া সামান্য কিছু হাত খরচও দিয়ে থাকেন সর্দাররা। তিনি আরো বলেন, ভাটার মালিকদের কাছ থেকে যে পরিমাণ টাকা আনা হয় তা শ্রমিকরা পায় না। এক একটি লোকের বিপরীতে সর্দারদের ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা বাড়তি থাকে।

নয়া শতাব্দী/জেআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ