বন্দরনগরী চট্টগ্রামের উত্তর পতেঙ্গার মুসলিমাবাদ কাটগড় জেলেপাড়ার বাসিন্দা অনিল জলদাশ। এক লাখ টাকার বিনিময়ে ১শ' টাকার স্ট্যাম্পে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার জন্য ৮টি টংপার জাল এবং ১৬টি খুঁটির জলসীমা কিনে নিয়েছেন। একইভাবে ৫ লাখ টাকা দিয়ে ৪০টি টংপার জালের দখলসহ কিনে নিয়েছেন একই এলাকার ৪০ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. ইউচুপ। এক লাখ টাকায় সাগর কিনে মাছ ধরছেন সঞ্জয় জলদাশ। কাগজ-কলমে টংপার জাল হলেও তারা মূলত সাগরের এই জলসীমা দখল করে মাছ ধরছেন বছরের পর বছর। শুধু এই তিন ব্যক্তিই নয়- এ ধরনের অন্তত ২৮ জনের কাছে এভাবে সাগরের জলসীমা বিক্রি করে দিয়েছেন মো. ইলিয়াছ সওদাগর নামের এক ব্যক্তি। সাগরের জলসীমা বিক্রি করে চলতি বছরই হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।
অভিযোগ রয়েছে- এ ধরনের অপকর্মের সহযোগিতা করে আসছে স্থানীয় প্রশাসন। স্থানীয় থানায় অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার মেলে না। উল্টো প্রতিবাদ করলেই নিরীহ জেলেদের ভাগ্যে নেমে আসে নির্যাতন। বন্ধ হয়ে যায় সাগরে মাছ ধরা। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে নয়া শতাব্দীর করা এক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে দলিল করে সাগর বিক্রির মতো চাঞ্চল্যকর চিত্র। সাগর বিক্রির ষ্ট্যাম্পের চুক্তিনামা ও জেলেদের অভিযোগের ভিডিও ফুটেজ নয়া শতাব্দীর কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী নয়া শতাব্দীকে বলেন, সাগর কারো বাপের না। তারা বাপ-দাদার সম্পত্তির মতো দীর্ঘদিন ধরে এভাবে দলিল করে সাগর বিক্রি করে আসছিল। বিষয়টি তাদের নজরে আসার পর গত ৪ ডিসেম্বর সংশ্লিষ্টদের ডেকে আনা হয়। এরপর ওইসব স্থাপনা উচ্ছেদ করে প্রকৃত জেলেদের মাছ ধরার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, সাগরে মাছ ধরার জন্য জালের খুঁটি বসাতে অনেক খচর হয়। ছেলেদের একটি পক্ষ এসব খুঁটি বসানোর জন্য অপর একটি পক্ষকে কাজ দেয়। তারা চুক্তি অনুযায়ী খুঁটি বসিয়ে দেয়। এসব ঘটনা নিয়ে এলাকায় অনেক গণ্ডগোলও হয়েছে। আবার খুঁটি বসাতে গিয়ে অনেকে জায়গা দখল করে নেয়। পরে ওই জায়গা আবার টাকার বিনিময়ে মৌখিকভাবে বিক্রি করার অভিযোগ তোলা হয়।
জানা গেছে, প্রভাবশালী পক্ষ থেকে দলিল করে সাগরের জলসীমা বিক্রির উদ্যোগ নেয়ায় মাত্র এক থেকে ৫ লাখ টাকার বিনিময়ে যে কেউ হতে পারছে বঙ্গোপসাগরের একটি নির্দিষ্ট অংশের গর্বিত মালিক। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য বেশ- কয়েক বছর ধরে প্রকাশ্যেই চলছে বঙ্গোপসাগর বিকিকিনি। অভিযোগ রয়েছে, বাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকে কেউ কেউ বঙ্গোপসাগরে অবৈধ দখল ও উচ্ছেদের নেতৃত্ব দিচ্ছে। প্রভাবশালীদের দখল বেদখলের ফলে ন্যায্য হিস্সা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে নিরীহ জেলেরা।
বঙ্গোপসাগরের জেলে এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র জানায়, বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকা মহেশখালী, কুতুবদিয়া, আনোয়ারা, বাঁশখালী, পতেঙ্গা, কাটলী এবং সীতাকুণ্ড উপকূলীয় এলাকাসহ বঙ্গোপসাগরের বিশাল একটি অংশ জোর করে দখলে রেখেছে হাজারের অধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি। তারা সমুদ্রে বিশেষ ধরনের চিহ্ন ‘ফার’ (ফান) নিয়ে দখল করে তা বেচাবিক্রি করছে। দখলকৃত নির্দিষ্ট এলাকা ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা দরে মৌখিক বা স্ট্যাম্পের মাধ্যমে জেলেদের কাছে বিক্রি করছে। যেসব জেলে টাকার অভাবে দখলি স্বত্ব কিনতে পারে না, তারা তিন মাসের জন্য নির্দিষ্ট একটি এলাকা লিজ নিয়ে মাছ ধরে। আর যারা দখলি স্বত্ব কিনতে বা লিজ নিতে ব্যর্থ হয় তারা ভরা মৌসুমেও বেকার বসে থাকতে বাধ্য হন।
পতেঙ্গ মৎসজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি মো. শাহিনুর নয় শতাব্দীকে বলেন, চলতি বছরে অন্তত ২৮ জনের কাছে সাগর বিক্রি করে দিয়েছ পতেঙ্গার ১৫ নং ঘাটের ব্যবসায়ী মো. ইলিয়াছ সওদাগর। তার কাছ থেকে সাগর ক্রেতারা হচ্ছে- ৪০নং ওয়াডের বাসিন্দা মো. জয়নাল, সেলিম, মুসা, মো. সোহেল, আব্দুল মান্নান, মো. রাশেদ, মো. ইসাহাক, মো. সেলিম, আনিসুর রহমান, সৈয়দ নূর, আব্দুল খালেক, মো. আলী, লিটন জলদাশ, দিদার, মানিক, জয়নাল, অভিরত জলদাশ, বিপুল জলদাশ, রনি জলদাশ, প্রবীর জলদাশ, নয়ান জলদাশ, মোহন জলদাশ, মুসলিম উদ্দিন, বজলু, রাসেল মাল্টি ও মিলন। তারা সবাই এক থেকে ৫ লাখ টাকার বিনিময়ে সাগর কিনে নেয়ায় সরকারী লাইসেন্সধারী জেলেরা সেখানে মাছ ধরতে পারে না। এ কারণে অসহায়ভাবে দিন পার করেছেন নিরীহ ছেলে।
তিনি বলেন, প্রায় ২০ বছর ধরে এ ধরনের সাগর কেনাবেচা চললেও প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তাদের এ ধরনের অপকর্মের কথা বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত আকারে অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পাওয়া যায়নি। শাহিনুরের বক্তব্যের সূত্র ধরে অনুসন্ধানে নামে নয়া শতাব্দী। এলাকার একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া যায়। এলাকাবাসীর অভিযোগ সাগর বিক্রির বিষয়টি এলাকায় ‘ওপেন সিক্রেট’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মাছ ধরার মৌসুম এলেই সাগর কেনা-বেচা শুরু হয়ে যায়। বিক্রির নেতৃত্ব দেন ইলিয়াছ সওদাগর। তার সহযোগী হিসেবে সাগর কেনাবেচা তদারকি করেন- মো. সেকেন্দার, মুসলিম উদ্দিন, বজলু জানাল, দিদার আলম, রাসেল, লিটন জলদাশ ও নয়ন জলদাশ।
স্থানীয় জেলে আব্দুর নূর বলেন, সমুদ্রে তিন নৌকা সমপরিমাণ জায়গার (এক ফরে থেকে আরেক ফার সাম্পান দিয়ে যেতে লাগে ৩০ মিনিট) বিক্রি হচ্ছে ১ থেকে ৫ লাখ টাকায়। যেসব জেলের দখল স্বত্ব নেই তাদের সমূদ্রের দখলদারদের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। এক্ষেত্রে জেলেরা তিন মাসের জন্য নির্দিষ্ট এলাকা লিজ নেন। লিজের জন্য ইলিশ মৌসুমে তিন মাসের জন্য ৫০ হাজার টাকা এবং বছরের অন্যান্য মৌসুমে তিন মাসের জন্য ১৫ হাজার টাকা হারে ভাড়া নিতে হয়। যিনি দখল নেই বা লিজ নিতে পারেন না ভরা মৌসুমেও তাকে বেকার বসে থাকতে হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ছেলে বলেন, সমুদ্র দখল-বেদখল নিয়ে প্রায় সময় সংঘাতের ঘটনা ঘটে। এমনকি দখল-বেদখলকে কেন্দ্র করে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটে।
এসব ঘটনায় মাঝে মধ্যে থানায় দুই একটি মামলা হলেও পরবর্তীতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মধ্যস্থতায় ধামাচাপা দেয়া হয় ওই মামলা। পতেঙ্গা মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সদস্য মনু মিয়া জানান, চলতি বছরের ৫ জুলাই ইলিয়াছ সওদাগর তাকে সাগরে মাছ ধরতে যেতে বাধা দেয়। নৌকা প্রতি ১ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। এ সময় জেলেরা টাকা দিতে অপরাগতা জানালে সমিতির অর্থ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম ও মোহাম্মদ হোসেন বাপ্পাকে ১০ জুলাই মারধর করে। এতে তারা মারাত্মক আহত হন। এ ঘটনার পরের দিন ইলিয়াছের লোকজন সাগর থেকে তাদের ২১ লাখ টাকার জাল, রশি, দুটি বয়া টাংগি ও শোলা নিয়ে যায়। এ বিষয়ে পতেঙ্গা থানায় মামলা করতে গেলে মামলা না নিয়ে ২৮ জুলাই একটি সাধারণ ডায়েরি করা ছাড়া থানায় একাধিক অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পাওয়া যায়নি। এ কারণে আদালতে একাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে। সিআর মামলাগুলো হচ্ছে, ১১১/২০-২১, ১০৮/২০২১, ১৮/২০২১ ও ৬৯/২০২১ এ ছাড়া পতেঙ্গা থানায় তার নামে দুটি মামলা রয়েছে। মামলা নং-১২/১৪৮ ও ২৪/২৯৭।
জানতে চাইলে বন্দর জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার কাজী মো. তারেক আজীজ নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘জেলেদের উপর নির্যাতনের বিষয়ে তদন্ত চলছে। এরই মধ্যে একজন এসআইকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।’
সাগর বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত ইলিয়াছ সওদাগর নয়া শতাব্দীকে বলেন, এক সময় আমি ব্যবসা করতাম। তখন কোন অভিযোগ ছিল না। বছর দুয়েক আগে এক মাদক ব্যবসায়ীকে ধরিয়ে দেয়ার পর থেকে আমার বিরুদ্ধে সাগর বিক্রির অভিযোগ ওঠে। মূলত আমি সাগর বিক্রি করি না। আমার বড় বড় নৌকা থাকার কারণে সাগরে মাছ ধরার জন্য খুঁটি গাড়তে সহজ হয়। একটি খুঁটি গাড়তে ৪ হাজার ৭শ’ টাকা খরচ হয়। ওই টাকার বাড়তি কিছু আমি জেলেদের কাছ থেকে নিয়ে থাকি। সেখানে আমার ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা লাভ হয়। দলিল কেন করা হয় এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, খুঁটিগুলো যেহেতু আমি বসাই এ কারণে যাতে ভবিষ্যতে আমার ওয়ারিশরা ওই খুঁটি দখল নিতে না পারে এ কারণে দলিল করে দেয়া হয়।’
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ