ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

জামিন নিয়ে লাপাত্তা ২৭২ জঙ্গি

প্রকাশনার সময়: ২২ নভেম্বর ২০২১, ০৬:৪৩
প্রতীকী ছবি

বিভিন্ন সময়ে জামিন নিয়ে পলাতক রয়েছে ২৭২ জঙ্গি। তাদের সন্ধানে মাঠে নেমেছে পুলিশের একাধিক ইউনিট। ধারণা করা হচ্ছে, পরিচয় গোপন করে তারা দেশের ভেতরেই অবস্থান করছে। পুলিশের তালিকায় দেশে জঙ্গির সংখ্যা ৫ হাজার ২৮৯ জন। গত ২৭ বছরে ১৩৪২ মামলার আসামি থেকে এই তালিকা করেছে পুলিশ। যাদের মধ্যে গ্রেফতার হয়েছে ৪ হাজার ৯৯৮ জন। এসব আসামিদের মধ্যে জামিনে আছে ২ হাজার ৫১২ ও জেলহাজতে আছে ১ হাজার ৬৯৬ জন। পুলিশ সদর দফতরের এক হিসাব থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

অভিযোগ রয়েছে জামিনপ্রাপ্ত জঙ্গিদের অনেকেই আবার উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে। আবার কেউ কেউ আত্মগোপনে চলে যাচ্ছে। সম্প্রতি জামিন নিয়ে আবারো জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে একাধিক সদস্যকে।

জানতে চাইলে অতিরিক্ত আইজিপি মো. কামরুল আহসান বলেন, জামিন পাওয়া জঙ্গিদের আমরা সবসময় নজরদারিতে রাখি। এছাড়া কারাবন্দিদের বিষয়ে ডির‌্যাডিক্যালাইজেশনসহ নানামুখী কর্মসূচি রয়েছে। যারা পলাতক রয়েছেন তাদেরও সন্ধান করা হচ্ছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, পুরোনো জঙ্গিরা প্রায় কয়েক বছর ধরেই লুট, ছিনতাই ও ডাকাতি মাধ্যমে অর্থ জোগাড় করছে। এ সময়ের মধ্যে প্রায় ৭-৮টি ডাকাতির ঘটনা ঘটিয়ে বিপুল অঙ্কের টাকাও লুট করেছে। এমনকি খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে তারা। এসব ঘটনায় জড়িত বেশ কয়েক জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হলেও জামিনে বেরিয়ে আবারো জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েছে। তাদের নেটওয়ার্ক ময়মনসিংহ-জামালপুর উত্তরবঙ্গসহ বেশ কয়েকটি জেলায় বিস্তৃত রয়েছে।

করোনাকালেও অনলাইনে তারা সদস্য সংগ্রহ, বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালিয়ে গেছে। তারা সংগঠনকে শক্তিশালী করতে নতুন কর্মী সংগ্রহ, মোটিভেশন ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালাতে অনলাইনে ব্যবহার করেছে। সম্প্রতি বোমার সরঞ্জাম কেনে বান্দরবানে গভীর পাহাড়ে অঞ্চলে জঙ্গি ট্রেনিং করেছে কমপক্ষে শতাধিক তরুণ। সংগঠনকে বিস্তৃত করতে রোহিঙ্গা ক্যাস্পগুলো পরিদর্শন করেছে নব্য জেএমবি সংগঠনের নেতাকর্মীরা।

সম্প্রতি সিটিটিসি ও র‌্যাবের হাতে অন্তত ২০ জঙ্গি গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে নানা চাঞ্চল্যকর কাহিনী। কীভাবে জঙ্গি সংগঠনগুলো তাদের সাংগঠনিক কার্যাক্রম চাঙা করার নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে? তারা আগের রূপে ফিরে আসার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। দেশে প্রথম প্রশিক্ষিত জাবাইদা সিদ্দিকা নাবিলা নামে এক তরুণী জঙ্গি পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। তাছাড়া র‌্যাবের হাতে ময়মনসিংহে চার জঙ্গি ও ঢাকার বসিলা জঙ্গি আস্তানা থেকে শীর্ষ জঙ্গি এমদাদুল হককে গ্রেফতারের পরই নড়েচড়ে বসেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো।

জানা গেছে, সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের (এআইইউবি) একটি গাড়িতে পেট্রোলবোমা মারতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে দেলোয়ার নামে এক জঙ্গি। বাংলাদেশে হামলা করে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার টার্গেট ছিল তার। তাকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ডিবির কাউন্টার টেররিজম ইউনিট।

জঙ্গি নিয়ে কাজ করে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) উপ-পুলিশ কমিশনার আব্দুল মান্নান জানিয়েছেন, দেলোয়ার ‘সেলফ রেডিকালাইজড’। কিছুদিন তিনি জাপান ছিল। তার গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর। তার কাছ থেকে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। তার কাছ থেকে একটি ব্যাগ উদ্ধার করা হয়। ব্যাগের ভেতরে এক লিটারের বেশি তরল পদার্থ ও দুটি লোহার তৈরি ছুরি ছিল।

পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, দেলোয়ার ঠান্ডা মাথার জঙ্গি। গুলশানে এআইইউবির একটি মাইক্রোবাসে তিনি বোমা মারার চেষ্টা করেছিল। পথচারীর সহায়তায় তাকে ধরা সম্ভব হয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও স্টাফদের ওপর বড় ধরনের হামলা চালিয়ে প্রাণহানি ঘটিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার ছক ছিল তার। অনলাইনে উগ্রপন্থি বিভিন্ন অডিও-ভিডিও দেখত দেলোয়ার। কয়েক সহযোগীর নামও বলেছেন দেলোয়ার। তাদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।

১৯৯৪ সাল থেকে চলতি বছরের ৩০ আগস্ট পর্যন্ত জঙ্গি মামলার পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ১৩৪২টি জঙ্গি মামলার মধ্যে পুলিশ অভিযোগপত্র দিয়েছে ১ হাজার ২৬টি। চূড়ান্ত প্রতিবেদন বা ফাইনাল রিপোর্ট দেয়া হয়েছে ৪৩টির। তদন্তাধীন মামলা আছে ২৭৩টি। যেসব মামলার অভিযোগপত্র হয়েছে সেগুলোতে মোট ৪ হাজার ৬৩৮ জনকে আসামি করা হয়েছে। আসামিদের মধ্যে বিচারে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে ৫১ জনকে। বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে ৫২৮ জনকে। খালাসপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা ৫৯৭ জন।

সন্ত্রাসবিরোধী আইনের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা জানিয়েছে সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর ও মৃত্যুবরণ করেছে মোট ৬৫ জন। পলাতক আছে ৯ জন। জামিনে আছে ৮ জন। কারাগারে কয়েদি হিসেবে বন্দি আছে ৪৮৪ জন। বিগত ২৭ বছরের জঙ্গি মামলাগুলোর মধ্যে সর্বাধিক ২০০৫ সালে ২০১টি মামলা হয়েছে। এরপর সর্বাধিক ১৮৪টি মামলা হয়েছে ২০১৬ সালে। এছাড়া ২০১৭ সালে ১২২টি ও ২০১৮ সালে মামলা হয়েছে ১০৩টি। চলতি বছর জঙ্গি মামলা হয়েছে ৬৯টি। চলতি বছর ৬৯ মামলায় মোট আসামি সংখ্যা ১৯৩ জন। যাদের মধ্যে গ্রেফতার হয়েছে ১৩৫ জন। চলতি বছর গ্রেফতার হওয়া আসামিদের মধ্যে জামিনে আছেন ১ জন এবং জেলা হাজতে ১২৪ জন ও পলাতক আছেন ৪৬ জন।

সিটিটিসির এক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় ছোটখাটো ও বা আত্মঘাতী কিছু হামলার ঘটনা হলেও জঙ্গিদের সর্ববৃহৎ হামলা ছিল ২০১৬ সালে গুলশানের হলি আর্টিসান রেস্টুরেন্টে। ওই হামলায় ১৮ বিদেশি নাগরিকসহ মোট ২২ জন নিহত হয়। নিহতের মধ্যে ইতালির ৯ জন ও জাপানের নাগরিক ছিল ৭ জন। এই মামলায় আদালত সাত জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। হামলায় অংশ নেয়া জঙ্গীদের ৫ জন ঘটনার দিন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কমান্ডো অভিযান মারা যান।

পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় কারাগারে ডির‌্যাডিকালাইজেশন কর্মসূচি রয়েছে। এছাড়া পুলিশ, র‌্যাব, সিটিটিসি ও এটিইউ বিভিন্ন সময় ডির‌্যাডিকালাইজেশনে বিভিন্ন কাজ করে থাকে। নানামুখী অভিযানে জঙ্গিদের সামর্থ্য নষ্ট করা সম্ভব। কিন্তু তাদের আদর্শ থাকে ব্রেনে। কারো ভেতর যদি ভুল মতাদর্শ থাকলে সেটা শক্তি দিয়ে মোকাবিলা করা যাবে না। সেটার জন্য বিভিন্ন মোটিভেশনাল প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন জানান, গত ৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর বসিলার জঙ্গি আস্তানা থেকে দুর্ধর্ষ জঙ্গি জেএমবি শীর্ষ নেতা এমদাদুল হক ওরফে উজ্জল মাস্টারকে গ্রেফার করে র‌্যাব। ২০০৩ সালে জেএমবির সাবেক শীর্ষ নেতা শায়খ আব্দুর রহমানের বায়াত গ্রহণ করেন তিনি। বসিলায় জঙ্গি আস্তানাও গড়ে তোলে উজ্জল। জঙ্গিরা লাইম লাইটে আসার চেষ্টা করলেও কাজ হবে না। আত্মগোপনে থাকা জঙ্গিদের ধরতে র‌্যাবের একাধিক টিম কাজ করছে।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ