ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কিমি.তে লাভ ১৫ টাকা

প্রকাশনার সময়: ১১ নভেম্বর ২০২১, ০৬:৩৬
ফাইল ছবি

করোনাভাইরাসের অজুহাতে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার। বেড়েছে বললে ঠিক বোঝা যায় না, পরিস্থিতি বলতে হবে ‘জ্বালানি তেল রকেট জাম্প’ দিয়েছে। ডিজেলের দাম এক লাফে বেড়েছে লিটার প্রতি ১৫ টাকা। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার অজুহাতে টানা ৩ তিন দিন চলে গণপরিবহন ধর্মঘট। সরকারও বাস মালিকদের দাবিকে যৌক্তিক মনে করে ‘বিলম্ব’ না করে রাজধানীতে ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ ও দূরপাল্লার বাসে ২৭ শতাংশ ভাড়া বাড়ায়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীর সড়কে এক লিটার ডিজেলে বাস চলে গড়ে ৫ কিলোমিটার। এ হিসাবে ১৫ টাকা বৃদ্ধিতে প্রতি কিলোমিটারে বাড়তি জ্বালানি খরচ ৩ টাকা। আর প্রতি বাসে গড়ে ৪০ জন যাত্রী থাকলে বাসের কিলোমিটার প্রতি অতিরিক্ত আয় ১৮ টাকা। ফলে নতুন ভাড়ায় কিলোমিটার প্রতি বাসের লাভ বেড়েছে ১৫ টাকা। গতকাল বুধবার বাস মালিক ও ড্রাইভারদের সাথে একান্ত আলাপকালে জানা গেছে এমন তথ্য।

তারা বলছেন, মতিঝিল থেকে মিরপুরের দূরত্ব ১৭ কিলোমিটার। সরকার নির্ধারিত ২ টাকা ১৫ পয়সা হিসাবে ভাড়া ৩৬ টাকা ৫৫ পয়সা। ফার্মগেট থেকে মিরপুর-১২-এর দূরত্ব ৯ কিলোমিটার। সরকার নির্ধারিত ভাড়া ১৯ টাকা ৩৫ পয়সা। মিরপুর-১০ থেকে মিরপুর-১২ পর্যন্ত দূরত্ব ২ দশমিক ৮ কিলোমিটার। সেই হিসাবে ভাড়া আসে ১০ টাকারও কম। তবে ‘ওয়েবিল’-এর দোহাই দিয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে ১৫ টাকা।

সূত্রমতে, মহানগরে বাসের ভাড়া আগে কিলোমিটার প্রতি ছিল এক টাকা ৭০ পয়সা। এখন তা বাড়িয়ে দুই টাকা ১৫ পয়সা করা হয়েছে। দূরপাল্লার ভাড়া এক টাকা ৪২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে এক টাকা ৮০ পয়সা নির্ধারণ করেছে সরকার। তবে সরকারের নির্ধারিত ভাড়ার থেকেও যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে পরিবহন শ্রমিকরা।

দূরত্ব ও ভাড়া বিশ্লেষণে দেখা যায়, মতিঝিল থেকে মিরপুর ১৭ কিলোমিটার যেতে ডিজেল অতিরিক্ত খরচ ৫২ টাকা। আগের ভাড়া ছিল ৩০ টাকা। আর এখন ২ টাকা ১৫ হিসাবে আদায় করা হচ্ছে ৩৭ টাকা। গড়ে বাসে ৪০ জন যাত্রী থাকলে অতিরিক্ত আয় ২৮০ টাকা। তেলের ৫২ টাকা খরচের বিপরীতে লাভ হচ্ছে ২২৮ টাকা। ঠিক একইভাবে ঢাকা-চট্টগ্রামের দূরত্ব ২৪৫ কিলোমিটার। প্রতি ট্রিপে ডিজেল খরচ হয় ৮০ লিটার। ডিজেলের অতিরিক্ত খরচ এক হাজার ২০০ টাকা। সরকারি হিসাব নতুন ভাড়া ১ টাকা ৮০ পয়সা অনুয়াযী, যাত্রী প্রতি ভাড়া ৪৪১ টাকা। এক টাকা ৪২ পয়সা অনুসারে ভাড়া ছিল ৩৪৭ টাকা। জনপ্রতি ভাড়া বাড়ল ৯৪ টাকা। গড়ে বাসে ৪৫ যাত্রী থাকলে অতিরিক্ত আয় ৪ হাজার ২৩০ টাকা। ফলে ১২০০ টাকা খরচের বিপরীতে লাভ হচ্ছে প্রায় ৩ হাজার ৩০ টাকা। কিলোমিটার প্রতি লাভ হচ্ছে ১২ টাকার বেশি।

ময়মনসিংহ থেকে ঢাকার দূরত্ব ১২০ কিলোমিটার। সরকার নির্ধারিত প্রতি কিলোমিটার ১ টাকা ৮০ পয়সায় ভাড়া দাঁড়ায় ২১৬ টাকা। যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে ২৭০ টাকা। সিলেট থেকে ঢাকার ২৪৫ কিলোমিটার দূরত্বে সরকার নির্ধারিত ভাড়া ৪৪১ টাকা হলেও নন-এসি বাসে আদায় করা হচ্ছে ৫৫০ টাকা। আর এসি বাসে এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৪০০ টাকা আদায় করছে বাসগুলো। রাজশাহী-ঢাকার দূরত্ব ২৪৭ কিলোমিটার। এ রুটে সরকার নির্ধারিত দরে ৪৪৫ টাকা ভাড়া আদায়ের কথা থাকলেও এসি ও নন-এসিতে নেয়া হচ্ছে ৬০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নিত্যপণ্যের বাড়তি দামে এমনিতেই দিশেহারা মানুষ। এমন সময়ে তেলের দামসহ পরিবহনের ব্যয় বৃদ্ধি ভয়ানক চাপে ফেলবে সাধারণ মানুষকে। মূল্যস্ফীতির এই সময়ে বাড়তি ভাড়ায় সব মিলিয়ে চাপে পড়বে নিম্ন-মধ্যবিত্তরা।

জানতে চাইলে বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক কে এস মুর্শিদ নয়া শতাব্দীকে বলেন, তেলের দাম বেড়েছে, বাস ভাড়া বাড়বে। আর সামগ্রিকভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাবে। এমন সময় তেলের দাম বাড়ল যখন মধ্যবিত্ত একটা কঠিন সময় পার করছে। জীবিকার সমস্যা, স্বাস্থ্যখাতে প্রচুর ব্যয়, সেভিংস যেটা ছিল সেটা শেষ হয়ে গেছে। সবমিলিয়ে মানুষ এখন অনেকটাই দিশেহারা।

যাত্রীরা বলছেন, সাধারণ মানুষের চলাচলের একমাত্র বাহন হলো গণপরিবহন। রাজধানীর বেশিরভাগ বাসই চলে গ্যাসে। তারাও আজ বলছে ডিজেলচালিত গাড়ি। আসলে বাড়তি ভাড়া আদায়ের এটি একটি অপকৌশল। যদি সব গাড়ি ডিজেলেই চলে তাহলে সিএনজি স্টেশনগুলো যেন তাদের গ্যাস না দেয়। সিটিং সার্ভিস ও ওয়েবিলের নামে দুই-তিনগুণ ভাড়া আদায় করছে। সরকারে নতুন ভাড়ায় বাসে সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা ও মিনিবাসে ৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। যেখানে বাসের ভাড়া ২-৩ টাকা বাড়ালেই ডিজেলের অতিরিক্ত দাম উঠে যেত, সেখানে এখন অন্তত ১৫ থেকে ২৫ টাকা নেয়া হচ্ছে।

যাত্রাবাড়ি থেকে আব্দুল্লাপুরগামী রাইদা পরিবহনের যাত্রী আল মামুন বলেন, সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়েও কিলোমিটার প্রতি অতিরিক্ত ভাড়া আদায় চলছেই। এক স্টপিজ থেকে আরেক স্টপিজে নামলেই ১৫ টাকা এবং ওয়েবিল অতিক্রম করলেই আরো ১৫ টাকা আদায় করা হচ্ছে। আমরা তো আর আন্দোলন করতে পারব না। দুঃখের বিষয় হলো, তেলের দাম কমলেও তখন ভাড়া কমবে না।

রাজধানীর গুলিস্তান এলাকায় কাজল নামের এক যাত্রী বলেন, পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা যাত্রীদের জিম্মি করে রাখছে। নতুন ভাড়া কার্যকরের আগ থেকেই তারা বেশি ভাড়া নিতো। এখন তেলের দাম বাড়ানোর কথা বলে আরো বেশি ভাড়া আদায় করছে। গুলিস্তান থেকে আগে মিরপুরের ভাড়া ছিল ৩০ টাকা। এখন নেয়া হচ্ছে ৫০ টাকা।

জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, ধর্মঘট ও মানুষের ভোগান্তির পেছনে সরকারের দায় দেখছেন পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি বলেন, করোনা থেকে অর্থনীতি উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে। এ সময় অন্তত দুই বছর জ্বালানির দাম না বাড়ানো উচিত ছিল। সরকারই মানুষকে দুর্ভোগে ফেলার এই সুযোগ করে দিয়েছে।

জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বলেন, যৌক্তিক না হলে কিভাবে হলো? ২০১৯ সালে তো এ চেয়ে বেশি ভাড়া কস্টিং কমিটি কস্টিং করে রেখেছিল। আমরা তো তেলের দাম বাড়ানোর পরও সেই ভাড়া নেই নাই। আরো কমিয়ে নিয়েছি।

তিনি আরো বলেন, বর্তমান বাজার পরিস্থিতি অনুযায়ী, বাস ভাড়া আরো বাড়ানো দরকার ছিল। তবে সরকার যতটুকু বৃদ্ধি করেছে মালিকরা তা মেনে নিয়েছেন।

এদিকে, ২৭ শতাংশ বেশি ভাড়া বৃদ্ধিকে অযৌক্তিক ও অবৈধ বলেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। যাত্রী কল্যাণ সমিতি বলছে, রাজধানীতে প্রায় ৯৫ ভাগ বাসই গ্যাসচালিত। তাই তেলের দাম বৃদ্ধির দোহাই দিয়ে সব পরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধি অযৌক্তিক। যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হোসেন বলেন, ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে যে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে সেই ভাড়া সিএনজিচালিত, অকটেনচালিত, পেট্রোলচালিত সবকয়টি যানবাহন অবৈধভাবে আদায় করছে। এই বাড়তি ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য তৈরি করে দেয়ার জন্য সরকার দায়ী।

তিনি বলেন, বাস মালিকরা ভাড়া বাড়ানোর একটি ইস্যু পেয়েছেন সেটা তারা ব্যবহার করেছেন। ডিজেলচালিত গাড়িতে মূল্যবৃদ্ধির কারণে ভাড়া বাড়িয়ে দেয়া হলো। ঠিক একইভাবে রাজধানীর সিএনজি বা এলপিজিচালিত বাসগুলোর ভাড়া বেড়েছে। এটা সম্পূর্ণ অনৈতিক এবং অবৈধ।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ