গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী, বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দল বিদেশের মাটিতে শাখা বা কমিটি গঠন করতে পারবে না। কমিটি করলে দলের নিবন্ধন বাতিল হবে। তবে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) এই আইনকে বৃদ্ধাঙুল দেখিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত বেশিরভাগ দলই ‘প্রবাস শাখা’ কমিটি গঠন করেছে।
ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান ও আফগানিস্তান ছাড়া বিশ্বের প্রায় ৩০টি দেশে আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ সক্রিয় রয়েছে প্রবাস কমিটি। নানা কৌশলে বিদেশে ‘প্রবাস কমিটি’ গঠন করে দলীয়ভাবেও অনুমোদন দিয়েছে দলগুলো। এমনকি প্রবাস কমিটির নেতারা বিভিন্ন সময় দেশে এসে সরাসরি দলীয় রাজনীতি সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েও এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। এসব কমিটি গঠন আরপিওর লঙ্ঘন বিধায় তা সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করা হয় না। অনেকটাই গোপনেই চলে তাদের কার্যক্রম। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিরা সরাসরি প্রবাসে গিয়ে কমিটি গঠন করেন। নয়া শতাব্দীর সঙ্গে আলাপকালে একাধিক নেতা জানিয়েছে এমন তথ্য।
দলগুলোর নেতারা বলছেন, পাশ্ববর্তী কয়েকটি দেশ বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশেষ করে নির্বাচনের সময় সরাসরি প্রভাব বিস্তার করে। তাই এসব দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর শাখা বা কমিটি দেয়া হয় না। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কুয়েত, জাপান, ইতালি, লেবানন ও আরব আমিরাতে বাংলাদেশিরা বেশি বসবাস করেন। তাদের দিয়েই রাজনৈতিক দলগুলো প্রবাস কমিটি গঠন করে। এসব কমিটির নেতারা অনেক সময় দেশে ও প্রবাসে দুই জায়গাতেই রাজনীতি করেন। তাদের অনেকে দেশে এসে মনোনয়ন নিয়ে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন। কেউ কেউ আবার সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হয়েছেন।
ইসি সূত্রমতে, নির্বাচন কমিশনের ‘রাজনৈতিক দলসমূহের নিবন্ধন আইন-২০২০’ অনুযায়ী, কোনো দলের গঠনতন্ত্রে যদি দেশের ভৌগোলিক সীমার বাইরে কোনো দফতর, শাখা বা কমিটি গঠন ও পরিচালনার বিধান থাকে তাহলে ইসির ধারা ১১ অনুসারে সেই রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল হবে। তবে ইসির এই ধারাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সব দলই প্রবাস শাখা কমিটি গঠন করছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি রাজনৈতিক দলের মহাসচিব বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনে দেখেছি, কীভাবে পাশের একটি দেশ সরাসরি হস্তক্ষেপ করল। তবে, এটা প্রথম তা নয়। এর আগে-পরেও পাশের দেশগুলো বাংলাদেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছে। এ কারণে দেশগুলোতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের রাজনৈতিক কোনো কমিটি নেই।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেশে দলের কার্যক্রম আছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির। এ দুটি দলের ৩০টির বেশি দেশে প্রবাস শাখা বা কমিটি রয়েছে। এরপর জাতীয় পার্টি, ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বিকল্পধারা, জাকের পার্টি, ইসলামী ফ্রন্ট বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোটের মতো দলগুলোর প্রবাসে শাখা বা কমিটি আছে।
প্রবাসে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন এমন একাধিক নেতা বলেন, প্রবাসে দেশের অনেক রাজনৈতিক দলের শাখা কমিটি আছে। কমিটিগুলোর মধ্যে সক্রিয় কেবল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। দেশের রাজনীতির মতো এখানেও তাদের বছরব্যাপী সক্রিয় কর্মসূচি থাকে। তবে, দলের সভাপতি বা চেয়ারম্যানের বিদেশ সফরকে কেন্দ্র করে প্রবাস কমিটিগুলোর তৎপরতা আরো বেড়ে যায়।
তারা বলেন, একপক্ষ দলীয় প্রধানকে শুভেচ্ছা জানিয়ে কর্মসূচি দেয়। বিরোধীপক্ষ তার সফরের প্রতিবাদে কর্মসূচি পালন করে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে দেশ সফর করেন, সেই দেশের প্রবাস কমিটি তাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে কর্মসূচি পালন করে। অন্যদিকে, বিএনপি তার সফরের প্রতিবাদে কর্মসূচি দেয়। এভাবেই চলে আসছে বছরে পর বছর।
আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, জাপান, কুয়েতসহ বিশ্বের প্রায় ৩৫টি দেশে দলটির প্রবাস কমিটি আছে। এসব দেশে বসবাসরত বাঙালিরা সেখানে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম পরিচালনা করেন। এসব প্রবাস কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকরা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে কাউন্সিলর ও ডেলিগেট হিসেবে আমন্ত্রণ পেয়ে থাকেন। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফেনীর আসন থেকে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সৌদি আরব আওয়ামী লীগ শাখার সভাপতি রহিম উল্লাহ।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, আমরা বিষয়টিকে নিরুৎসাহিত করি। তবে প্রবাসী বাংলাদেশিরা যদি সে দেশের আইন মেনে, এক জায়গায় বসে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। আমরা তো নিষিদ্ধ করতে পারি না।
এদিকে, বিএনপি সূত্রে জানা যায়, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া, জাপান, সৌদি আরব, ইতালি, লেবানন, আরব আমিরাত, কুয়েতসহ প্রায় ৩০টি দেশে প্রবাস কমিটি রয়েছে দলটির। তবে ভারত, নেপাল, মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কায় কোনো শাখা নেই। সাধারণত দলের জাতীয় সম্মেলনে এসব দেশের কমিটিগুলোর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষিত হয়। কাউন্সিলর হিসেবে তারা সম্মেলনে ভোট ও মতামত দিতে পারেন। বিএনপির প্রবাস কমিটিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় রয়েছে যুক্তরাজ্যের কমিটি। সেখানে বসবাসরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ঘিরে তারা বেশি সক্রিয়।
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এমরান সালেহ প্রিন্স নয়া শতাব্দীকে বলেন, আমরা আরপিও মেনেই কাজ করি। তাই আমাদের কোনো বিদেশ শাখা নেই। বিএনপির গঠনতন্ত্রে বলা আছে, প্রবাসীরা যে দেশে থাকেন, সেই দেশের আইন-কানুন মেনে যদি বিএনপির আদর্শ ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে সংগতি রেখে কোনো সংগঠন করতে চান, করতে পারবেন। যারা আছেন, তারা ওইসব দেশে স্থানীয়ভাবে কাজ করেন। ইউরোপ ও আমেরিকাসহ প্রায় সব দেশেই বিএনপির এরকম সংগঠন আছে। যারা সংগঠন করেন, তারা বিএনপির আদর্শ ও উদ্দেশ্যে অনুপ্রাণিত। বিদেশে তারা এর মাধ্যমে সংগঠিত থাকতে চান। আর বিএনপি তাদের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারেন। নানা ধরনের তথ্য-উপাত্ত বিনিময় করতে পারে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান নয়া শতাব্দীকে বলেন, দলের গঠনতন্ত্রে ‘প্রবাস সংগঠন’ নামের একটি ধারা আছে। এই গঠনতন্ত্র নির্বাচন কমিশনের অনুমোদিত। সুতরাং, ধারাটিও ইসির অনুমোদিত।
জানা গেছে, বিশ্বের প্রায় ১০টি দেশে জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রবাস কমিটি আছে। জাকের পার্টির কাতার, সৌদি আরব, বাহরাইনসহ বেশকিছু দেশে প্রবাস কমিটি আছে। নিউইয়র্ক ও লন্ডন, ইতালি ও ফ্রান্সে কমিটি আছে ড. বদিউজ্জমান চোধুরীর বিকল্পধারা বাংলাদেশ। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের দুবাই, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতারসহ কয়েকটি দেশে কমিটি আছে। ইসলামী ঐক্যজোটের অনেক দেশে কার্যক্রম সক্রিয় আছে। সেখানে মিটিং-মিছিল করতে না পারলেও দেশে এলে সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন নেতারা।
এ ছাড়া অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দল আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) মালয়েশিয়া, সৌদি আরবসহ বেশকিছু দেশে তাদের সাংগঠনিক কমিটি আছে। ইসলামী আন্দোলন দলেরও বেশিরভাগ দেশে সক্রিয় রয়েছে নেতা-কর্মীরা। এসব দলের চেয়ারম্যান বা সভাপতিরা প্রবাসী বাঙালিরা কমিটি করে দেশে পাঠালে সেগুলোর অনুমোদন দেন। জানতে চাইলে জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরবসহ কয়েকটি দেশে আমাদের কমিটি আছে। তবে এসব কমিটি আমরা গিয়ে করে দিয়ে আসি না। সেখানকার প্রবাসীরা নিজেরাই এসব কমিটি করেছেন।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান নয়া শতাব্দীকে বলেন, অনেক দেশেই ইসলামী আন্দোলনের কার্যক্রম আছে। তারা তো দেশের মতো সেখানে মিটিং-মিছিল করতে পারে না। ওইসব দেশের আইন অনুযায়ী, যতটুকু করা যায়, ততটুকু করেন। আর দেশে এলে সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন তারা।
এবি পার্টির সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, আরপিওতে বলা হয়েছে, দেশের বাইরে কোনো কমিটি থাকতে পারবে না। আবার এটাও বলা আছে যে, প্রবাসীরা রাজনৈতিক দলের সদস্য হতে পারবেন। অর্থাৎ প্রবাস কমিটি নিয়ে স্ববিরোধী বক্তব্য দিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। এর পরিবর্তন প্রয়োজন।
নয়া শতাব্দী/এমআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ