ঢাকা শহরের ৯৪ দশমিক ৭৩ শতাংশ বাস চলে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসে (সিএনজি)। বাকি ৫ দশমিক ২৭ শতাংশ বাস চলে ডিজেলে। দূরপাল্লার বাসের মধ্যে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসের চলাচলও গ্যাসনির্ভর। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছাড়া দূরপাল্লার অন্য বাসের ৬০ শতাংশও চলাচল করে গ্যাসে।
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) ও বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে এমন পরিসংখ্যান মিললেও রোববার বিকেলে ডিজেলচালিত গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ানোর পর ঢাকায় সিএনজিচালিত বাস-মিনিবাস ভোজবাজির মতো উধাও হয়ে গেছে!
সিএনজিচালিত বাস-মিনিবাসে আগের ভাড়াই বহাল থাকছে, তারা বাড়তি ভাড়া আদায় করতে পারবে না সরকারের এমন ঘোষণার পর সোমবার গোটা রাজধানীতে কোনো সিএনজিচালিত বাসের দেখা (!) মেলেনি। সব বাসই ডিজেলচালিত দাবি করে পরিবহন শ্রমিকরা যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় করেছে। তবে বিআরটিএ কিংবা অন্য কোনো প্রশাসনের পক্ষ থেকে তা নজরদারি করা হয়নি।
সিএনজিচালিত গণপরিবহনে বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগে অন্তত একটি বাসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এমন একটা দৃষ্টান্তও বিআরটিএর পক্ষ থেকে তৈরি করা হয়নি।
জানা গেছে, ঢাকায় বিআরটিএর অনুমোদিত বাস রয়েছে ১২ হাজার ৫২৬টি। বুয়েটের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ঢাকায় মাত্র ৬২৬টি বাস ডিজেলে চলাচল করে। বাকি ১১ হাজার ৯০০ বাস গ্যাসে চলে। আর ঢাকা থেকে দূরপাল্লায় চলাচল করে ১৬ হাজার বাস। এর মধ্যে গ্যাসে চলে ১১ হাজার ২০০ বাস। আর ডিজেলে চলে ৪ হাজার ৮০০ বাস। অন্যদিকে সারাদেশে চলাচল করা ৭৮ হাজার বাসের মধ্যে গ্যাসে চলে ৪৬ হাজার ৮০০ বাস। আর ডিজেলে চলে ৩১ হাজার ২০০ বাস।
নগর পরিবহনের বিপুলসংখ্যক যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশিরভাগ গাড়িতে গ্যাস সিলিন্ডার দেখা গেলেও পরিবহন শ্রমিকরা ফুয়েল ট্যাংক দেখিয়ে সিএনজিচালিত বাসগুলোও ডিজেলচালিত দাবি করে বাড়তি ভাড়া আদায় করেছে। যাত্রীরা কেউ এ নিয়ে প্রতিবাদ করলে বাসটি সিএনজিচালিত কিনা পরিবহন শ্রমিকরা তা প্রমাণ করে দিতে বলেছে। বাড়তি ভাড়া না দিলে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে।
বিষয়টি ট্রাফিক পুলিশ কিংবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানিয়েও কোনো লাভ হয়নি। তাদের ভাষ্য, এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে তাদের কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি। তাই তারা এ ঝামেলায় জড়াতে চান না।
এদিকে সিএনজিচালিত বাস-মিনিবাসে গণপরিবহন শ্রমিকরা অবৈধভাবে বাড়তি ভাড়া আদায় করলেও এর নেপথ্যে মালিক সমিতির সরাসরি মদদ থাকার প্রমাণ মিলেছে। বিআরটিএর পরিসংখ্যানে নগরীর ৯৫ শতাংশ গাড়ি গ্যাসে চলার কথা জানানো হলেও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহর দাবি, এখন আর কোনো গাড়ি গ্যাসে চলে না। আর ভাড়া বাড়ানো হয়েছে শুধু ডিজেল নয় আরো অনেক কিছু বিবেচনা করে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে যতগুলো (বাস) গ্যাসে চলে সব কনভার্টেড। কনভার্শনের পর যখন গ্যাসে চালানো হয়েছে তখন দেখা গেছে ছয় মাসের ওপর ইঞ্জিন চলে না। পরে সব গাড়ি আবার ডিজেলে ফেরত গেছে। বড়জোর এক-দুই শতাংশ বাস গ্যাসচালিত থাকতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেগুলো এখন চিহ্নিত করা সম্ভব নয়।
যদিও বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ জানান, সিএনজিচালিত বাস কত এবং ডিজেলচালিত বাস কত তা চিহ্নিত করা আছে। সিএনজিচালিত বাসের ভাড়া বাড়বে না। কারণ সিএনজির দাম বাড়েনি। তবে এটা নিশ্চিত করার কোনো পদ্ধতি বা কৌশল নেয়া হয়নি- স্বীকার করেন তিনি।
পরিবহন বিশ্লেষকরা বলছেন, সিএনজিচালিত বাসে যাতে বাড়তি ভাড়া আদায় করতে না পারে এজন্য গাড়ির পৃথক রং করা যেতে পারে। অথবা গাড়ির উইনশিল্ডে বিশেষ স্টিকার লাগিয়ে তা চিহ্নিত করা সহজ। তবে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা সহজে তাতে রাজি হবেন বলে মনে করছেন না তারা।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসেন নয়া শতাব্দীকে বলেন, শুধু ডিজেলচালিত বাসের ব্যাপারে ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হলেও সব বাসই এখন ভাড়া বাড়াবে। কেউ তাদের থামাতে পারবে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘ঢাকায় চলা ৯৫ শতাংশ বাসে ভাড়া বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। এগুলো সব গ্যাসে চলে। যেসব বাস ডিজেলে চলে সেগুলো সরকারকে চিহ্নিত করতে হবে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, বাস মালিকরা ভাড়া বাড়ানোর একটা সুযোগ পেয়েছেন, সেটা তারা যেভাবেই পারেন আদায় করে ছাড়বেন। এর আগে গ্যাসের দাম বাড়লে তখন তারা তাদের অধিকাংশ গাড়ি গ্যাসে চলে এমন দাবি করেছেন। আর এখন বলছেন তাদের সব গাড়ি ডিজেলে চলে। তাদের এসব কথার মারপ্যাঁচে যাত্রীদের পকেট কাটা যাবে। ২০১৫ সাল থেকে গ্যাস ও ডিজেলচালিত গাড়িতে আলাদা স্টিকার দাবি করা হলেও সেটা মানা হচ্ছে না বলে জানান তিনি।
সোমবার সকাল থেকে বিকেল অবধি সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ঘুরে এবং যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিটি সার্ভিসের সব শ্রমিকই তাদের বাস ডিজেলচালিত বলে দাবি করছেন। বাড়তি ভাড়া কেউ না দিতে চাইলে বাসের হেলপার-কন্ডাক্টররা যাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিচ্ছেন। মিরপুর-সদরঘাট রুটের বিহঙ্গ পরিবহন এতদিন সিএনজিচালিত বাস বলে সবার জানা থাকলেও পরিবহন শ্রমিকরা দাবি করছেন তাদের বাস ডিজেলচালিত। নেয়া হচ্ছে বাড়তি ভাড়া। বিহঙ্গ বাসের কন্ডাক্টর জাহিদুল জানান, তাকে পরিবহন মালিকরা এভাবেই ভাড়া তুলতে নির্দেশনা দিয়েছেন। বাড়তি ভাড়া না দিতে চাইলে তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিতে মালিকের নির্দেশ রয়েছে।
হাতিরঝিল চক্রাকার বাসের বেশিরভাগই সিএনজিচালিত হলেও এর ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এ নিয়ে কয়েক যাত্রীর সঙ্গে পরিবহন শ্রমিকদের হাতাহাতির ঘটনাও ঘটেছে বলে জানা গেছে।
পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানান, গ্যাসে চললেও সব গাড়িতেই ফুয়েল টাংক থাকে। সাধারণত সকালে গাড়ি স্টার্ট দেয়ার সময় এবং গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করার সময় তেলের লাইন ব্যবহার করা হয়। তবে বাকি সময় এসব বাস-মিনিবাস গ্যাসেই চলে। যাত্রীরা কেউ এ নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে যে কোনো গাড়িচালকই ফুয়েল টাংক দেখিয়ে তার গাড়ি ডিজেলে চলে এটি প্রমাণ করে দিতে পারে। তাই গ্যাস ও ডিজেলচালিত গাড়ি আলাদা করা জটিল। এটি করতে হলে বিআরটিএ’র উদ্যোগ নিতে হবে।
নয়া শতাব্দী/এম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ