হঠাৎ করেই গত বৃহস্পতিবার সরকার ডিজেল ও কেরোসিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বাড়িয়ে দেয়। আর মুহূর্তকাল দেরি না করে ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে ধর্মঘট শুরু করে পরিবহন মালিকরা। চাকরি প্রার্থী ও সাধারণ জনগণের দুর্ভোগ লাঘবে সরকারের তরফে পরিবহন মালিকদের প্রতি আহ্বান জানানো হয় ধর্মঘট প্রত্যাহারের। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের পর্যন্ত বিশেষভাবে রোববার পর্যন্ত ধর্মঘট প্রত্যাহার আবেদন জানান। বলেন, রোববার (গতকাল) ভাড়া সমন্বয়ের বিষয়টি বিআরটিএ’র সভা থেকে সমাধান হবে। তাই বিআরটিএ’র বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত ধর্মঘট প্রত্যাহার চান তিনি। এসব অনুরোধ-আহ্বান-প্রতিশ্রুতিকে ‘থোড়াই কেয়ার’ করে পরিবহন মালিকরা ধর্মঘট অব্যাহত রাখেন। সরকার ও জনগণকে জিম্মি অবস্থায় রেখে ভাড়া সমন্বয়ে গতকাল রোববার বিআরটিএ’র সঙ্গে বৈঠকে বসেন তারা। এ বৈঠক থেকে সিদ্ধান্ত আসে কিলোমিটার প্রতি ৪৫ পয়সা করে ভাড়া বাড়ানোর। বৈঠক থেকে ‘বিশেষভাবে’ বলে দেয়া হয় বর্ধিত ভাড়া প্রযোজ্য হবে কেবল ডিজেলচালিত বাস-মিনিবাসে। সিএনজিচালিত বাস-মিনিবাসে পুরোনো ভাড়া বহাল থাকবে। ভাড়া আদায়ে ডিজেলচালিত আর সিএনজিচালিত বাস কীভাবে পৃথক করা হবে এ বিষয়ে অবশ্য কোনো পক্ষ থেকেই সুস্পষ্ট কিছু জানানো হয়নি। এদিকে, অযৌক্তিক ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি।
বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, মূলত ডিজেলের দাম বাড়ার পরিপ্রেক্ষিতেই পরিবহন মালিকদের দাবির মুখে গণপরিবহনে নতুন করে ভাড়া সমন্বয় করা হয়েছে। আজ সোমবার থেকে বর্ধিত ভাড়া কার্যকর হবে। নতুন সমন্বিত ভাড়া অনুযায়ী, দূরপাল্লার বর্তমান বাস ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৪২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১ টাকা ৮০ পয়সা করা হয়েছে। অর্থাৎ কিলোমিটার প্রতি যাত্রীকে বাড়তি ৩৮ পয়সা গুনতে হবে। এছাড়া বড় বাসে সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা, মিনিবাসে ৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তাছাড়া মহানগরে বাসের বর্তমান ভাড়া কিলোমিটারে ১ টাকা ৭০ পয়সা সেটা ২ টাকা ১৫ পয়সা করা হয়েছে। কিলোমিটারে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে ৪৫ পয়সা। মহানগরে মিনিবাসের বর্তমান ভাড়া প্রতি কিলোমিটারে ১ টাকা ৬০ পয়সা। সেটি বাড়িয়ে ২ টাকা ৫ পয়সা করা হয়েছে। কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া বাড়ানো হয়েছে ৪৫ পয়সা। তবে সিএনজিচালিত বাস ও মিনিবাসের ভাড়া বাড়ানো হবে না বলে জানিয়েছেন বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার।
ডিজেলচালিত আর সিএনজিচালিত বাসের ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান গতকাল নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘রাজধানীতে ৯৫ শতাংশ বাসই সিএনজিচালিত। মোট ৫ হাজার বাসের মধ্যে সর্বোচ্চ ২৫০ বাস হতে পারে যেগুলো ডিজেলচালিত। সুতরাং ডিজেলের দাম বাড়ায় সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এটা ইতিবাচক। আমরা ধারণা করছিলাম, হয়তো সব বাসের ভাড়াই বৃদ্ধি করবে সরকার। কিন্তু সেটা হয়নি।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিআরটিএ’র উচিত হবে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করার। কোনটা ডিজেলচালিত আর কোনটা সিএনজিচালিত সেটা তাদেরই নির্ধারণ করে দিতে হবে। সাধারণ মানুষ তো এটা পার্থক্য করতে পারবে না। তাই এই দায়িত্ব বিআরটিএকে নিতে হবে। তাহলে সমস্যা হবে না।
তিনি আরো বলেন, বিকল্প হিসেবে ইলেক্ট্রিক্যাল বাসের প্রচলন আমরা করতে পারি। এতে খরচ অনেক কম, ভাড়াও কম থাকবে। আমরা ইতোমধ্যে ইলেক্ট্রিক্যাল বাইক তৈরি করছি। ফলে আমরা ইলেক্ট্রিক্যাল বাস তৈরিতেও সক্ষম। ইলেকট্রিক্যাল বাসের প্রচলন করতে পারলে এই সেক্টরে দ্রুতই শৃঙ্খলা ফিরবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
বুয়েটের ২০১০ সালের সার্ভে প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেই সময়ে রাজধানীর ভেতরে চলাচলকারী ৭০ শতাংশ বাস-মিনিবাস সিএনজি গ্যাস চলত। প্রাইভেটকারের সংখ্যা ছিল ৮৩ শতাংশ। ২০১৬ সালের আরেক সার্ভেতে দেখা যায়, ৯০ শতাংশ প্রাইভেটকার চলছে গ্যাসে। এসব হিসাব সামনে রেখে সহজে অনুমান করা যায়, রাজধানীতে ৯৫ শতাংশের বেশি বাসই চলছে গ্যাসে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী নয়া শতাব্দীকে বলেন, ঢাকার ৯৫ শতাংশের অধিক বাসই সিএনজি গ্যাসে চলে। ঢাকার বাইরের বাসগুলো মূলত ডিজেলে চলে। ফলে রাজধানীতে বাস বন্ধ রাখা ও ভাড়া বৃদ্ধির দাবিই ছিল সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।
এদিকে, জ্বালানি তেলের দাম না কমলে ট্রাক চলবে না বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান পণ্য পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ। পরিষদের আহ্বায়ক রুস্তম আলী খান গণমাধ্যমকে জানান, জ্বালানি তেলের দাম না কমা পর্যন্ত তারা এ ধর্মঘট অব্যাহত রাখবেন। বিআরটিএ সদর দফতরে ভাড়া পুনঃনির্ধারণের বৈঠক হয়েছে। সেই বৈঠকে তারা অংশ নেননি। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ কাভার্ড ভ্যান ট্রাক-প্রাইম মুভার পণ্য পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মকবুল আহমেদ বলেন, আমরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করব না। তেলের দাম কমলেই ধর্মঘট প্রত্যাহার করব। এছাড়া আমরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করব না। জ্বালানি তেলের দাম লিটারে ১৫ টাকা করে বাড়ানোর প্রতিবাদে সারাদেশে গত তিন দিন ধরে পরিবহন ধর্মঘট চলে। পরিবহন মালিকরা শুরু থেকেই ভাড়া সমন্বয় বা ডিজেলের দাম কমানোর দাবি জানিয়ে আসছিলেন। এরই মধ্যে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ানোর কারণে গণপরিবহনের ভাড়া পুনঃনির্ধারণের বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার (৪ নভেম্বর) বিআরটিএকে চিঠি দেয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি।
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ঊর্ধ্বগতির কারণে ভারতসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ডিজেল-কেরোসিনের দাম পুনঃনির্ধারণ করে সরকার। গত ৩ নভেম্বর রাতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করে। নতুন দাম ভোক্তা পর্যায়ে ৬৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা করা হয়েছে, যা গত বৃহস্পতিবার থেকে কার্যকর হয়। ডিজেল-কেরোসিনের দাম বাড়ানোর পরদিনই পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা এ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এরপর ৫ নভেম্বর ভোর ৬টা থেকে রাজধানীসহ সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট শুরু করে বাস-ট্রাকসহ পণ্যবাহী যানবাহনের মালিকেরা। এতে সারাদেশে ব্যাপক দুর্ভোগের মধ্যে পড়ে সাধারণ মানুষ। তবে তেলের দাম বাড়ানোর পর শুরু থেকেই পরিবহন মালিক ও সংশ্লিষ্টরা বলছিলেন, ডিজেলের দাম না কমানো হলে গণপরিবহনসহ অন্যান্য পরিবহনের ভাড়া সমন্বয় করতে হবে।
ধর্মঘটে ভোগান্তিতে পড়া সাধারণ মানুষ বলছে, বাসের ভাড়া নির্ধারণের দায়িত্ব সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ)। পরিবহন মালিকরা ভাড়া বাড়াতে ধর্মঘট দিয়ে সাধারণ জনগণকে জিম্মি করলেও সরকার তাৎক্ষণিকভাবে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ভাড়া বাড়াতে চাপ তৈরির কৌশল হিসেবেই পরিবহন সিন্ডিকেট ধর্মঘট দিয়েছে।
এরই মধ্যে ধর্মঘটের প্রথম দিন গত শুক্রবার দুপুরে নিজ বাসভবনে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জনগণের দুর্ভোগের কথা বিবেচনায় নিয়ে ধর্মঘট প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু সেই আহ্বানে গত দুদিনেও সাড়া মেলেনি। ওই দিন ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, রোববার ভাড়া পুনঃনির্ধারণ কমিটির সঙ্গে বৈঠক হবে। ওই বৈঠকে ভাড়া সমন্বয় করে সাধারণ মানুষের ওপর চাপ যতটা সম্ভব সহনীয় রাখার চেষ্টা করা হবে।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ