ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

ভয়ংকর নেশা অনলাইন জুয়া

প্রকাশনার সময়: ০৭ নভেম্বর ২০২১, ০৬:৪৩
ফাইল ছবি

ক্লাবপাড়ার ক্যাসিনো জুয়া নিয়ন্ত্রণের পর ধুন্ধুমার জুয়া চলছে অনলাইনে। রীতিমতো নিবন্ধন করে সদস্য সংগ্রহ ও সদস্যদের অধিক মাত্রায় জুয়ায় আসক্ত করতে দেয়া হচ্ছে নিত্যনতুন অফার। গেমিং, বেটিং বা বাজি খেলার সাইটে ঢুকে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট অর্থ রিচার্জে মিলছে নানা ধরনের বোনাস। ক্রেডিট কার্ড বা বিকাশের মাধ্যমে অর্থ লেনদেনের সুযোগ থাকায় পুরো বিষয়টিই সহজ হয়ে পড়েছে। কেউ জুয়ায় জয়ী হলে জুয়ার অর্থ চলে আসছে গ্রাহকের বিকাশ অ্যাকাউন্টে।

এমন সব সহজ-সুবিধা থাকায় বড়দের পাশাপাশি জুয়া খেলায় আসক্ত হয়ে পড়ছে স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও। এতে সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম উদ্বিগ্ন বাবা-মায়েরা। এমন পরিস্থিতিতে অনলাইনে জুয়া খেলা বন্ধে রাষ্ট্রীয় নজরদারির তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ভার্চুয়াল জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ছে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। এতে আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি বাড়ছে সামাজিক অবক্ষয়। অবৈধ প্রক্রিয়ায় এই ডিজিটাল মুদ্রা কেনাবেচার লেনদেনে শত শত কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে দেশের বাইরে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দ্রুতই এই জুয়া বন্ধের আহ্বান জানান তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেট ৩৬৫ ডটকম, ৮৮ স্পোর্টস ডটকম, রেবটওয়ে ডটকম, বেটফ্রিড ডটকম, ডাফাবেট ডটকম, বেটফেয়ার ডটকম, ইউনিবেট ডটকম, বেট ভিক্টর ডটকম, নেটবেট ডটকম, টাইটানবেট ডটকম, উইনার ডটকম, পেডি পাওয়ার ডটকম, বাজীগর ডটকম, প্লেবেট৩৬৫ ডটকম, লগ১০ ডট লাইভ, ৯ক্রিকেট, বিডিটি১০ডটকম, বেটবি২ডটকম, বেটস্কোর২৪ ডটকম, টাকা৬৫ ডটকম, উইনস৬৫ ডটকম, জয়টি২০ ডটকম, ভিক্টর২৬ ডটকম, ৬ক্রিকেট ডটকম, ইন্ডিতা৯৬ ডটকম, লাক বেট বিডি ডটকম, ওপেন বেট ডট লাইভ, এলবিএস২৪ ডটকম, বেট উইন ৯৬ ডটকম, স্পোর্টস ৩৩৩ ডটকম ও বেট বাটার ফ্লাই ডটকমসহ অর্ধশতাধিক জুয়ার অনলাইন সাইট রয়েছে। এসব বেটিং সাইটের মাধ্যমে শুধু শিক্ষার্থীরাই নয়, সর্বস্ব হারাচ্ছেন লাখো তরুণ। সেই সঙ্গে অল্প টাকায় অধিক লাভের নেশায় পড়ে বিপথগামীও হচ্ছেন তারা।

তথ্য বলছে, এসব বেটিং সাইট বিটিআরসির নজরে এলে বন্ধ করা হয়। তবে অত্যন্ত চালাক-চতুর হওয়ায় এসব সাইট পরিচালনাকারীরা বিদেশে বসে বন্ধ হওয়া সাইটগুলো রাতারাতি ভিন্ন ডোমেইনে হুবহু চালু করে পরিচালনা করছে। আবার কেউ কেউ ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) ব্যবহার করেই এসব সাইটে খেলছে জুয়া। এছাড়া কিছু কিছু সাইটের অ্যাপসও রয়েছে। যা সহজে বন্ধ করা যায় না। মূলত এসব সাইটে সরাসরি কেউ অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে না। এজন্য জুয়াড়িদের সহযোগিতায় রয়েছে ফেসবুক গ্রুপ। সঙ্গে ইউটিউবেও দেখানো হয় জুয়া খেলার টিউটিরিয়াল। এসব গ্রুপ ও টিউটেরিয়াল দেখে বাজি খেলায় উদ্বুদ্ধ হচ্ছে স্কুল-কলেজপড়ুয়া তরুণ-তরুণীরা।

রাজধানীর মিরপুরের একটি স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান মিশু। বয়স ১৪। পড়াশোনায় মেধাবী মিশু টানা দেড় বছর নিয়ন্ত্রণহীন মোবাইল ব্যবহারে অনলাইন জুয়ার নেশায় পড়েছে। মিশুর মা স্মৃতি জাহান বলেন, করোনায় স্কুল বন্ধ থাকায় মিশু অ্যান্ড্রয়েড ফোনে প্রায়ই গেম খেলত। একমাত্র ছেলে হওয়ায় তেমন বাধা দিতাম না। তবে অনলাইন গেমস একটা সময় সন্তানকে জুয়ার দিকে নিয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারি। যদিও ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, কীভাবে কিশোররা তিলে তিলে ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে তার অন্যতম প্রমাণ আমার ছেলে। স্কুল বন্ধ থাকায় ছেলেটা একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে। পড়াশোনাও করতে চাইছে না। বই-খাতা ছুড়ে মারে। তখন একটু নিয়ন্ত্রণে রাখতে মোবাইলে গেমস খেলতে দিতাম। তবে ওই গেমসগুলো খেলতে গিয়ে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন আসত মোবাইল স্ক্রিনে। কখনো কখনো সে সেগুলোর ক্লিক করত। এটা থেকেই সে কোনো এক সময় অনলাইনে জুয়া খেলার লিংক পায়। এভাবে কেটে যায় ৬ মাস।

স্মৃতি জাহান আরো বলেন, গত অক্টোবর মাসে সে বাবার কাছে ১০ হাজার টাকা চায়। কোনো এক বন্ধুকে টাকা ধার দিতে হবে। এটা নিয়ে তার বাবার সঙ্গে প্রচণ্ড রাগারাগি হয়। পরে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, মিশু মোবাইলে জুয়ার আসক্তিতে পড়েছে।

মিশুর বাবা মাহবুবুর রহমান বলেন, আমাদের না জানিয়ে কোনো এক ফেসবুক বন্ধুর মাধ্যমে ১ হাজার টাকা দিয়ে ১০ ডলার কিনেছিল। ওই টাকা দিয়ে সে বিদেশি কোনো এক ফুটবল ম্যাচের জয় নিয়ে বাজি ধরেছিল। এতে ২০ ডলার পায়। এভাবেই কখনো সে জিতত, আবার হারত। গত দেড় বছর ধরে চলছে এই খেলা। তবে আমরা টের পাইনি। যাদের মাধ্যমে জুয়া খেলত তারা গত মাসে জানিয়েছে সর্বনিম্ন ১০ হাজার টাকার বাজি ধরতে হবে। তাহলেই তাদের মেম্বার হতে পারবে। মেম্বার হলে ডলার না থাকলেও ক্রেডিট (লোন) নিয়ে খেলতে পারবে। মূলত এজন্যই সে টাকার জন্য পাগল হয়ে যায়। বিষয়টি জানতে পেরে ছেলের মোবাইল ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছি। এখন তাকে মানসিক ডাক্তার দেখাচ্ছি।

গত পাঁচ বছর ধরে জুয়া খেলছেন এমন একজন তরুণ নাইমুল রশিদ। রাজধানীর একটি সরকারি কলেজে ইংরেজি বিভাগে স্নাতক বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি জানান, ২০১৬ সালের জুলাইয়ের দিকে ফেসবুকে ‘বেট ৩৬৫’ নামে একটি গ্রুপ পাই। এখানে জয়েন করার পর প্রতিনিয়ত আপডেট পোস্ট দেখতাম। পোস্টগুলোতে যারা বাজি খেলত তাদের জয়ের নানান লেখা থাকতে। কেউ লিখত ১০ ডলার বাজি ধরে ৩০ ডলার জিতলাম। আজকের ম্যাচে ৫ ডলার বাজি ধরে ১৫ ডলার পেলাম।

তিনি বলেন, এসব দেখে একটা সময় আমার ভেতরেও খেলতে ইচ্ছা কাজ করতে শুরু করল। তাই এক সময় যারা পোস্ট দিত তাদের কমেন্টে আমিও খেলার আগ্রহ দেখিয়ে লিখতাম- আমাকে যেন একটা অ্যাকাউন্ট খুলে দেয়। একদিন এক ভাই ফোন দেয় হোয়াটসঅ্যাপে। তিনি অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়ে বলেন, বিকাশে ১ হাজার ২০ টাকা পাঠালে ১০ ডলার আমার অ্যাকাউন্টে পাঠাবেন। তার কথায় রাজি হয়ে টাকা পাঠালাম। ১০ মিনিটের মধ্যেই দেখি ডলার এসে গেছে আমার অ্যাকাউন্টে। এরপর থেকেই খেলা চলছে আমার।

নাইমুল রশিদ আরো বলেন, এই যে খেলা শুরু হলো এরপর থেকে এখনো খেলি। তবে বাস্তবতা হলো লাভ তো দূরের কথা_ হিসাব করলে অন্তত এক লাখ টাকার বেশি হারিয়েছি এই জুয়া খেলায়। তবুও ছাড়তে পারি না। কারণ অনেক বছর ধরে এটাতে যুক্ত থাকায় এক ধরনের নেশা হয়ে গেছে। মাঝে মধ্যে অনেক লাভও হয়। আবার একটানে সব চলে যায়। তবে লাভের চেয়ে লসটা বেশি। এটা নেশার কারণে ফিল হয় না। এখন পকেটে টাকা থাকলেই খেলি। এটা আসলে সময়-অর্থ দুটোই কেড়ে নেয়। যেমন সিগারেট স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এটা জানার পরও মানুষ সিগারেট খায়, এই বেটিং খেলাও তেমন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউবে বেটিং খেলায় উদ্বুব্ধ করতে নানান চটকদার বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। এমনকি শর্টফিল্ম বানিয়ে ভিডিওর ভেতরে বেটিং সাইটের বিজ্ঞাপন চালানো হয়। বিশেষ করে ইউটিউবে বিভিন্ন জনপ্রিয় গানের রিমেক ভিডিওতে বেটিং সাইটের চটকদার বিজ্ঞাপন দেয়া রয়েছে। এসব ভিডিও কয়েক কোটি ভিউ হচ্ছে। যার মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীরা উদ্বুদ্ধ হচ্ছে।

জানা যায়, ক্রিকেটের ভয়ঙ্কর জুয়ার নাম বেট থ্রি সিক্সটি ফাইভ। এতে, আসক্ত সারাদেশের কয়েক লাখ মানুষ। অনলাইনে এই জুয়া খেলে এরই মধ্যে নিঃস্ব হয়েছেন অনেকেই। পরিচিত বন্ধু-বান্ধব ও সহপাঠীদের ফেসবুক গ্রুপে এ ধরনের জুয়ার লিংক আপলোড দেয়া হয়। এ ছাড়া অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপে গুগল প্লে-স্টোর থেকেও এই গেম ডাউনলোড দেয়া হচ্ছে। চলতি টি২০ বিশ্বকাপে কোন দল জিতবে, কোন বোলার বেশি উইকেট পাবে, কোন ব্যাটসম্যান বেশি ছক্কা মারবে এ নিয়ে সারাদেশে চলছে হাজার হাজার টাকার জুয়া। মোবাইল ও ইন্টারনেটে ফোন, হোয়াটসআপ ও ফেসবুক মেসেঞ্জারের মাধ্যমেও বিভিন্ন অঙ্কের টাকা বাজি ধরা হয়। এ বিষয়ে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটু একটু করে বেটিং খেলা থেকেই এক সময় নেশা আসক্ত হয়ে পড়ে তরুণরা। একটা সময় বড় ধরনের জুয়াড়িতে পরিণত হয়। এতে টাকার সংকটে এক সময় পারিবারিক কলহের সৃষ্টি হয়। ফলে এটি একদিকে যেমন পারিবারিক ও সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়, অন্যদিকে তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা ক্রমেই বাড়তে থাকে। ফলে খুনের মতো ঘটনা ঘটাতেও তারা দ্বিধাবোধ করে না।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফারজানা রহমান বলেন, জুয়া খেলা নিয়ন্ত্রণে পারিবারিকভাবে যেমন সচেতনতা প্রয়োজন, তেমনি রাষ্ট্রীয়ভাবে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকেও নজরদারি আরো বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বিশেষ করে জুয়া খেলা আইনের পরিবর্তন এবং যেসব সাইটে জুয়া খেলা হয় সেগুলোর তালিকা তৈরি করে বন্ধ করা। এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার ও স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের উপ-কমিশনার শরীফুল ইসলাম বলেন, অনলাইন জুয়া নিয়ে বিভিন্ন চক্রকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে প্রতিনিয়ত অনেক চক্রের সৃষ্টি হচ্ছে। যেগুলোর বিষয়ে আমাদের গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। তবে এটার জন্য পারিবারিক সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সন্তান কোথায়, কী করছে এই খোঁজ না নিলে তারা জুয়া খেলার মতো নেশায় পড়বে। তাই এটি মোকাবিলায় আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি পারিবারিক সচেতনতা খুব জরুরি।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ