ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

হঠাৎ পরিবহন ধর্মঘটে চরম ভোগান্তি

প্রকাশনার সময়: ০৫ নভেম্বর ২০২১, ১৯:৫৮

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো প্রত্যাহার অথবা নতুন ভাড়া সমন্বয়ের দাবিতে আজ শুক্রবার থেকে সারাদেশে পরিবহন ধর্মঘট শুরু করেছে মালিক-শ্রমিকরা।

প্রথমে বিভিন্ন জেলায় বিক্ষিপ্তভাবে গণপরিবহন ধর্মঘটের ডাক দিলেও পরে সেই ডাকে একাত্মতা প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় পরিবহন মালিক সমিতি। এ জন্য সারাদেশে গণপরিবহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। ফলে ভোগান্তিতে পড়েছে যাত্রীরা। শতাব্দী প্রতিবেদক, ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:

শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করে দেখা যায়, গণপরিবহন বন্ধ থাকায় জরুরি প্রয়োজনে যারা রাস্তায় বের হয়েছেন, তাদের যেতে হচ্ছে সিএনজি, রিকশা ও বাইকে চড়ে। তাই রাজধানীর সড়কগুলোতে ছিল সিএনজি ও রিকশার দাপট। আর এই সুযোগে এসব পরিবহনের ভাড়া হয়ে গেছে তিন থেকে চারগুণ। ২০ টাকার ভাড়া যেতে হচ্ছে ১০০ টাকা দিয়ে।

এছাড়াও শুক্রবার ঢাকায় সরকারি-বেসরকারি বেশ কয়েকটি নিয়োগ পরীক্ষা থাকায় সারাদেশ থেকে পরীক্ষার্থীরা ঢাকায় এসেছেন। কিন্তু, সকালে পরীক্ষা কেন্দ্রে যাওয়ার পথে তারা বিপাকে পড়েন। রিকশা, অটোরিকশা ও বাইক পাওয়া গেলেও ভাড়া গুনতে হয়েছে চারগুণ বলে অভিযোগ করেন পরীক্ষার্থীরা।

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় সাধারণ মানুষের এমন ভোগান্তিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরাও। তারা বলেছেন, হুট করেই এক লাফে জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দিয়ে জনগণের ভোগান্তি সৃষ্টি করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের ভাড়া বিষয়ে দ্রুতই সমাধান করা দরকার।

রাজধানীর কারওয়ান বাজার থেকে সদরঘাট যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন ওমর ফারুক নামের এক যাত্রী। তিনি বলেন, বাস না পেয়ে বাইকে যাওয়ার জন্য দাম জিজ্ঞেস করলে বাইক চালক ৩০০ টাকা ভাড়া দাবি করেন। কারওয়ান বাজার থেকে সদরঘাটের পথ মাত্র ২০ মিনিটের, সেখানে সর্বোচ্চ ১৫০ টাকা ভাড়া হতে পারে। কিন্তু তিনি ৩০০ টাকা ভাড়া দাবি করছেন। অথচ বাসে মাত্র ২০ থেকে ২৫ টাকায় যাওয়া যেত।

শাহজাদপুরের সুবাস্তুর সামনে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা রহমতউল্লাহ বলেন, তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। শুক্রবার সরকারি বন্ধ থাকলেও তার অফিস খোলা। তিনি অফিস করতে যাবেন, কিন্তু গণপরিবহন নেই। এদিকে, সড়কে চলমান অটোরিকশা থাকলেও চড়া ভাড়া হাঁকছেন চালকরা। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় গণপরিবহন বন্ধ। কিন্তু, এদিকে মানুষের দুর্ভোগ ও ভোগান্তির মধ্যেও সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালকরা সুযোগ নিতে শুরু করেছে। ২০০ টাকার ভাড়া চাইছে ৫০০ টাকা। বিপদে পড়েছি। তাই রিকশাযোগে ভেঙে ভেঙে পল্টনে যাচ্ছি।

বরিশাল: জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে দেশের অন্যান্য স্থানের মতো বরিশালে শুক্রবার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য গণপরিবহন চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে বাস মালিক সমিতির নেতারা। শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে বরিশাল থেকে অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লা রুটের বাস চলাচল কেন্দ্রীয় কর্মসূচি ঘোষণা অনুযায়ী, বন্ধ করে দেয়া হয় বলে জানিয়েছেন বরিশাল-পটুয়াখালী বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাওছার হোসেন শিপন।

তিনি জানান, এর আগে বিভিন্ন সময় জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির আগে পরিবহন ভাড়া পুনঃনির্ধারণ হতো। এবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর আগে ভাড়া পুনঃনির্ধারণ করা হয়নি। বরিশাল বাস মালিক সমিতির আওতাধীন সড়কে ৩টি সেতুতে ১০ হাজার টাকার টোল রয়েছে।

এই অবস্থায় প্রতি লিটার ডিজেলে ১৫ টাকা দাম বাড়িয়ে পরিবহন খাতকে ঝুঁকিতে ফেলা হয়েছে। ভাড়া পুনঃনির্ধারণ অথবা জ্বালানি তেলের মূল্য কমানোর দাবিতে বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স এসোসিয়েশনের আহ্বানে শুক্রবার সকাল থেকে সারা দেশের মতো বরিশালেও সকল ধরনের গণপরিবহন বন্ধ রয়েছে বলে জানান কাওছার হোসেন শিপন।

অন্যদিকে, বড় প্রচার-প্রচারণা ছাড়াই হঠাৎ করে যাত্রীবাহী গণ পরিবহন ও দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল বন্ধ করে রাখার কারণে অভ্যন্তরীণ ও দূরপাল্লার যাত্রীরা বাসস্ট্যান্ডে এসে চরম দুর্র্ভোগের মধ্যে পড়ে।

রাজশাহী: জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে শুক্রবার সকাল থেকে রাজশাহীর কোনো রুটে ছেড়ে যায়নি বাস, ট্রাক, ট্যাংকলরি ও কাভার্ডভ্যান। ফলে বিপদে পড়েছেন যাত্রীরা। জনদুর্ভোগ বাড়ছে। শুক্রবার অনুষ্ঠিত খাদ্য অধিদফতরের নিয়োগ পরীক্ষা দিতে চাকরি প্রার্থীরা ঢাকায় যেতেও বিড়ম্বনায় পড়েন।

বৃহস্পতিবার রাত থেকেই বাস বন্ধে চাকরি প্রার্থীদের অনেকেই থ্রি হুইলার ও হিউম্যান হলারে ঢাকায় গিয়েছেন। চরম দুর্ভোগ নিয়ে তারা ঢাকায় গিয়েছেন বলে জানান।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির রাজশাহী বিভাগীয় সভাপতি ও রাজশাহী সড়ক পরিবহন গ্রুপের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাফকাত মঞ্জুর বিপ্লব জানান, হঠাৎ করেই তেলের দাম বৃদ্ধির ব্যাপারটি খুবই অস্বাভাবিক। এ অবস্থায় আমাদের বর্তমান ভাড়ার সঙ্গে তেলের দামের কোনো সমন্বয় হচ্ছে না। ভাড়া না বাড়ালে পরিবহন মালিকদের লোকসানের মুখে পড়তে হবে।

তিনি আরো বলেন, তেলের দামের সঙ্গে ভাড়ার সমন্বয় দাবিতে শুক্রবার থেকে রাজশাহী বিভাগের সব রুটে বাস, ট্রাক চলাচল বন্ধ থাকবে। সাময়িক এই অসুবিধার জন্য যাত্রী সাধারণের কাছে ক্ষমাও চেয়েছেন তিনি।

যাত্রীরা জানান, বৃহস্পতিবার রাত থেকে রাস্তায় বাসের সংখ্যা আগের চেয়ে কম। যেসব বাস চলাচল করে সেগুলোয় ওঠার আগেই বেশি ভাড়া দাবি করা হয়। রাজশাহী সড়ক পরিবহন গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান জানান, তেলের দাম বাড়ানোর প্রভাব বৃহস্পতিবার থেকেই রাস্তায় পড়তে শুরু করেছে। অনেক মালিক তাদের বাস বন্ধ করে দিয়েছে। তবে আমরা ভাড়া বাড়াতে চাই না। আসলে তেলের দাম যে হারে বেড়েছে, তাতে বাস চালানো মুশকিল। আগের ভাড়ায় বাস চালানো কোনোভাবেই সম্ভব না।

ময়মনসিংহ: পরিবহন শ্রমিকদের ধর্মঘটের ডাক দেয়ায় ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল ও আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল থেকে কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। এতে বেশ বিপাকে পড়েন সমন্বিত ৭ ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার পদে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিতে ইচ্ছুকরা।

পরীক্ষার্থীদের একজন সোনিয়া আক্তার বলেন, ঢাকায় যেতে ফজরের নামাজের পর বাস টার্মিনালে এসে অপেক্ষা করছি। আসার পর জানলাম, ধর্মঘটের কারণে কোনো বাস ঢাকায় যাবে না। এখন পরীক্ষায় অংশ নেব কি করে?

ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালের সুপারভাইজার শাহজাহান মিয়া জানান, শুক্রবার ফজরের নামাজের পর থেকেই ঢাকায় যাওয়ার জন্য যাত্রীরা টার্মিনালে এসে ভিড় করছেন। সাধারণ যাত্রীর তুলনায় চাকরি প্রার্থী যাত্রীর সংখ্যা ছিল বেশি। সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হয়েছেন চাকরি প্রার্থীরা। কিন্তু আমাদের করার কিছুই নেই, মালিকদের নির্দেশনা অনুযায়ী বাস চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।

সিলেট: ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে সিলেট থেকেও ছাড়েনি কোনো দূরপাল্লার বাস। আঞ্চলিক সড়কেও চলাচল করেনি কোনো বাস। বন্ধ ছিল পণ্য পরিবহন। বাস চলাচল বন্ধ থাকায় যাত্রীরা চরম ভোগান্তিতে পড়েন।

দুপুরে কদমতলি এলাকায় গিয়ে দেখা যায় অনেকেই গন্তব্যে যেতে পিকআপ, কেউ বাসে, কেউবা মোটরসাইকেলে, আবার কেউ কেউ হেঁটেই রওয়ানা হতে দেখা যায়। সে ক্ষেত্রে দিতে হয় দ্বিগুণ ভাড়া। দাঁড়িয়ে থাকতে হয় দীর্ঘ সময়। সেই সাথে কোনো পণ্য পরিবহন চলাচল না করায় ব্যবসায়ীদেরও পড়তে হয় ভোগান্তিতে। স্থানীয় বাজারগুলোতে পণ্য আনা- নেয়ার ক্ষেত্রে অটোরিকশা, লেগুনার সাহায্য নিতে হয়েছে। সে ক্ষেত্রে এসব বাহন আদায় করেছে কয়েকগুণ বেশি টাকা।

সিলেট জেলা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম জানান, পরিবহন ব্যবসা এমনিতেই ক্ষতিগ্রস্ত। এরমধ্যে করোনাভাইরাস ব্যবসা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। যখন ব্যবসাটি ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে তখনই জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। এতে ব্যবসায়ীরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আমাদের দাবি না মানলে আরো কঠোর আন্দোলন ঘোষণা করা হবে।

প্রসঙ্গত, গত বুধবার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটি গেজেটে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারপ্রতি ১৫ টাকা বাড়িয়েছে সরকার। হঠাৎ করে তেলের মূল্য বৃদ্ধি অযৌক্তিক। এই মূল্য বৃদ্ধির ফলে শুধু পরিবহন মালিকরা নয়, সারাদেশের জনগণই ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন ভুক্তভোগী যাত্রীরা।

বাংলাদেশ জ্বালানি নিয়ন্ত্রক কমিশনের এই উদ্যোগ অনেকটা দরিদ্র ও মধ্যবিত্তের ক্ষতস্থানে লবণ ঘষার মতো। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দামের সামঞ্জস্য রাখতে এপ্রিল থেকে এ নিয়ে পঞ্চমবারের মতো এলপিজির দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিল তারা।

নয়া শতাব্দী/এম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ