রাজধানী ও এর আশপাশজুড়ে সক্রিয় রয়েছে ভুয়া ডিবি পুলিশের ১২টি চক্র। এই চক্রে রয়েছে অর্ধশত সক্রিয় সদস্য। তারা টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে জোর করে গাড়িতে তুলে সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে নির্জনস্থানে ফেলে যাচ্ছে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা গুলি করতেও পিছপা হচ্ছে না।
মঙ্গলবার গভীর রাতে এই চক্রের ৯ সদস্যকে গ্রেফতারের পর এ ধরনের চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। এরই সূত্র ধরে বাকি সদস্যদের গ্রেফতারে অভিযান চালানো হচ্ছে বলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান জোনের ডিসি মশিউর রহমান জানান, রাজধানী ও এর আশপাশজুড়ে ভুয়া ডিবি পুলিশের ১০/১২টি চক্র সক্রিয় রয়েছে। তারা ব্যাংকপাড়ায় বেশি সময় অবস্থান করে। এই চক্রের সদস্যদের মধ্যে একজন ব্যাংকে অবস্থান করে। সেখান থেকে বেশি পরিমাণ টাকা তুলে কেউ বের হলে সেই তথ্য জানিয়ে দেয় বাইরে অবস্থানরত চক্রের অন্য সদস্যদের। এরপর টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে অনুসরণ করতে থাকে ভুয়া ডিবি পুলিশ সদস্যরা। এক পর্যায়ে সুবিধাজনক স্থানে পাওয়া মাত্রই তাকে গাড়িতে তুলে নেওয়া হয়। এরপর চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকার আসপাশের নির্জন কোন রাস্তায়। এরমাঝেই ভুক্তভোগির কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হয় সর্বস্ব। পরে তাকে রাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়।
তিনি জানান, এসব ঘটনায় অনেকে আইনের আশ্রয় নেয় আবার অনেকে ভয়ে মুখ খুলতে চায় না। এ ধরনের একাধিক অভিযোগের পর সম্প্রতি ৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য দিয়েছে। সেসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে চক্রের বাকি সদস্যদের গ্রেফতারে অভিযান চালানো হচ্ছে।
জানা গেছে, ২৬ অক্টোবর রাজধানীর মোহাম্মদপুর, মতিঝিল এলাকা থেকে ওই নয় ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করে ডিবির গুলশান বিভাগ। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, ইমদাদুল শরীফ, খোকন, মাসুদুর রহমান তুহিন, মামুন শিকদার, কমল হোসেন, ওয়াহিদুল ইসলাম, ফারুক বেপারী ও মতিউর রহমান। এ সময় তাদের কাছ থেকে একটি ওয়াকিটকি, একটি পিস্তল, এক জোড়া হাতকড়া, ট্রাভেল ব্যাগ, দুটি জ্যাকেট, চারটি নতুন গামছা, একটি প্রাইভেটকার, একটি মাইক্রোবাস ও পাঁচ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করা হয়।
ডিবির যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশীদ জানান, ঢাকা মহানগরী এবং আশপাশের এলাকায় ভুয়া র্যাব ও ভুয়া ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে ব্যাংকে টাকা জমা দিতে যাওয়া অথবা ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলনকারী ব্যক্তিদের জোরপূর্বক মাইক্রোবাসে তুলে নেয় ওই চক্রটি। তুলে নেয়া ব্যক্তিকে কখনও সাভার-আশুলিয়া, কখনও বেড়িবাঁধ, কখনো নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জে নিয়ে ব্যাপক মারধর করে। এরপর তাদের কাছ থেকে নগদ টাকা ও তাদের ডেবিট, ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে টাকা উত্তোলন করে হাতিয়ে নিতো।
গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে ডাকাতি ও মাদক আইনে মতিঝিল থানায় পৃথক মামলা হয়েছে। চক্রটির বেশিরভাগ সদস্য ঢাকার বাইরের। তারা ঢাকার বাইরে থেকে এসে কাজ করে আবার চলে যান। তারা কাঁচপুর থেকে মেঘনা পর্যন্ত সড়কটি ব্যবহার করেন। এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ডাকাতি মামলা, নারী নির্যাতন মামলা ও ধর্ষণের মামলা রয়েছে।
তিনি বলেন, এরই মধ্যে ডিবি অনেক ছিনতাইকারী ও ডাকাতদের ধরেছে, অনেককে জেলে পাঠানো হয়েছে। একটি গ্রুপ জেলে গেলেই নতুন আরেকটি গ্রুপ তৈরি হয়। মোহাম্মদপুর থেকেও এর আগে অনেক ছিনতাইকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
জানা গেছে, সম্প্রতি ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের প্রায় কোটি টাকা লুটের দুটি ঘটনায় ২২ সেপ্টম্বর গ্রেফতার করা হয় তিনজনকে। গ্রেফতারকৃতরা হচ্ছেন, জালিল মোল্লা, রিয়াজ ও দীপু। তাদের কাছ থেকে দুটি বিদেশি রিভলবার, ৫০ রাউন্ড গুলি, দুটি মোটরসাইকেল ও লুট করা ১ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। তারাও ব্যাংক পাড়ায় অবস্থান করে টার্গেকৃতদের কাছ থেকে টাকা পয়সা ছিনিয়ে নিত। ছিনতাইকাজে ব্যবহার করার জন্যই ১২ লাখ টাকা দিয়ে তারা দুটি অস্ত্র সংগ্রহ করে।
এ বিষয়ে ডিবির রমনা জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মিশু বিশ্বাস বলেন, ডাকাতির জন্য তারা সরকারি ছুটির দিন শনিবারকে বেছে নিতেন। টার্গেট করতেন মানি এক্সচেঞ্জকে। তারা সবাই পেশাদার ডাকাত দলের সদস্য। এই দলের একটি গ্রুপ মানি এক্সচেঞ্জ এলাকায় অবস্থান করে ও যারা বেশি টাকা বহন করে তাদের টার্গেট করে। মানি এক্সচেঞ্জ থেকে টাকা নিয়ে কেউ বের হলে সেই তথ্য তারা তাদের সহযোগী মোটরসাইকেলে অবস্থানকারী গ্রুপকে দেয়। এরপর সুবিধাজনক স্থানে ফাঁকা গুলি করে আতংক সৃষ্টির মাধ্যমে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে টাকা ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। আবার অনেক ক্ষেত্রে গাড়িতে তুলতে না পারলে সরাসরি ছিনতাই করে থাকে।
জানা গেছে, গত ২৮ আগস্ট একজন ব্যবসায়ী মতিঝিলের নিহন মানি এক্সচেঞ্জ থেকে ৬০ লাখ টাকা নিয়ে গাড়িযোগে রওনা দেন। ছয় জন ডাকাত মোটরসাইকেলযোগে ওই ব্যবসায়ীর গাড়ি অনুসরণ করে দুপুর ১টা ২০ মিনিটে মৌচাক ফ্লাইওভারের ওপর গাড়িটির গতিরোধ করে। ডাকাতরা আতংক সৃষ্টির জন্য ২ রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে এবং হাতুড়ি দিয়ে গাড়ির দরজার গ্লাস ভেঙে ফেলে। তারপর ওই গাড়ি থেকে ৬০ লাখ টাকা লুট করে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় গত ২৯ আগস্ট রমনা মডেল থানায় একটি মামলা হয়।
এ ছাড়াও ৪ সেপ্টেম্বর মতিঝিল থেকে ২৫ লাখ টাকা নিয়ে যাওয়ার সময় আরেক ব্যবসায়ীকে আক্রমণ করে এই ডাকাত দলের সদস্যরা। ওই ব্যবসায়ী নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড় পৌঁছালে ডাকাত দলের সদস্যরা তার গতিরোধ করে টাকা ছিনিয়ে নেয়। পথচারীরা জড়ো হয়ে ডাকাতদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলে ডাকাতরা গুলি ছোড়ে। এতে একজন পথচারী গুলিবিদ্ধ হয়। এই ঘটনায় সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় একটি মামলা হয়। চাঞ্চল্যকর এই দু’টি ঘটনার ছায়া তদন্ত শুরু করে ডিবির রমনা বিভাগ। এক পর্যায়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার জলিলের বিরুদ্ধে চারটি ও বাকি দু’জনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে।
নয়া শতাব্দী/এমআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ