মাঠপর্যায়ে পুলিশ সদস্যদের অস্ত্র ব্যবহারে আরো সতর্কতা অবলম্বন করতে বলছে পুলিশ সদর দফতর। প্রথম অবস্থায় কোনোভাবেই সরাসরি গুলি না ছুড়ে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে লাঠিচার্জ, টিয়ারশেল নিক্ষেপ, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেডের ব্যবহার অন্যতম। এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার পরও জানমালের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকলে ঊর্ধ্বতনদের অনুমতি সাপেক্ষে তবেই গুলি ছোড়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এজন্য মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিতেও বলা হয়েছে।
পাশাপাশি কুমিল্লা ইস্যুতে দায়ের হওয়া সব মামলা দ্রুত নির্ভুল তদন্ত করে দোষীদের আইনের আওতায়ও আনার তাগিদ দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে জেলা পর্যায়ে কমিউনিটি পুলিশিং আরো কার্যকরের উদ্যোগ নিতে বলা হয়। গত মঙ্গলবার পুলিশ সদর দফতরে এক জরুরি বৈঠকে এসব নির্দেশনা দেন আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ। ওই বৈঠকের একটি সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
জানা গেছে, ১০ দিনের সফর শেষে ২৫ তারিখ রাতে দেশে ফেরেন আইজিপি। এরপর ২৬ তারিখ দুপুরে তিনি পুলিশ সদর দফতরে দেশের সামগ্রিক বিষয় নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসেন। ওই বৈঠকে অনলাইনে যুক্ত করা হয় পুলিশের সব ইউনিটের প্রধান, রেঞ্জের ডিআইজি, মেট্রোপলিটন কমিশনার ও জেলার এসপিদের। সেখানে আলোচনার প্রথমে কুমিল্লায় কোরআন অবমাননার বিষয় নিয়ে দেশে সৃষ্ট ঝামেলার বিষয়টি উঠে আসে।
এ বিষয়ে আইজিপি মামলার তদন্তভার সিআইডকে দিয়ে নির্ভুল তদন্ত শেষে দোষীদের আইনের আওতায় আনার তাগিদ দেন। একই সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে সরকারবিরোধী কোনো শক্তি যেন দেশকে অস্থিতিশীল করতে না পারে এ বিষয়ে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানোর পাশাপাশি সবাইকে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়। তাছাড়া ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা যেন দেশ ছেড়ে পালাতে না পারে সে বিষয়ে সীমান্তবর্তী জেলার পুলিশ সুপারদের আলাদা দিকনির্দেশনা দেয়া হয়।
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কুমিল্লা ইস্যুকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন থানায় এ পর্যন্ত ১২৩টি মামলা দায়ের হয়েছে। ওইসব মামলায় গ্রেফতার অন্তত ৭ শতাধিক ব্যক্তি রিমান্ডে কী তথ্য দিয়েছেন সে বিষয়ে জানতে চান। এ সময় জেলার পুলিশ সুপাররা তাদের বক্তব্য পেশ করেন। পরবর্তীতে আইজিপি সবার বক্তব্য ভিডিও আকারে ধারণ করার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে উসকানিদাতা ও নেপথ্যের কারিগরদের খুঁজে বের করার তাগিদ দেন। একটি জেলার এসপি এ সময় হামলা ও ভাঙচুরের সঙ্গে সরকারদলীয় কিছু লোকজনের সম্পৃক্ততার বিষয় জানান। আইজিপি এ সময় তাদেরও আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দেন।
বিএনপি ও জামায়াতের লোকজনের বিষয়ে আইজিপি শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে তাদের আইনের আওতায় না আনার জন্য বলেন। কারণ বিএনপির পক্ষ থেকে তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে বারবার অস্বীকার করার কারণে শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে কাউকে গ্রেফতার করা হবে না বলে জানান। প্রয়োজনে এসব প্রমাণ প্রকাশ করা হবে বলেও জানান তিনি।
একটি জেলার এসপি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, একটি জেলায় ঘটে যাওয়া বিষয় নিয়ে একজন পুলিশ সুপার আইজিপির কাছে বিস্তারিত তথ্য-প্রমাণ তুলে ধরেন। এ সময় আইজিপি আরো সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে না পারাকে নিজেদের ব্যর্থতা বলে জানান। একই সঙ্গে কোন পরিস্থিতিতে সেখানে গুলি ছোড়া হলো সেটা জানতে চান। ওই পুলিশ সুপার পরিস্থিতি সম্পর্কে জানান। এ সময় আইজিপি মাঠপর্যায়ে পুলিশ সদস্যদের অস্ত্র, গুলি ব্যবহারে আরো সতর্ক হওয়ার তাগিদ দেন।
একই সঙ্গে জেলা পুলিশ লাইনে সব সময় স্ট্যান্ডবাই রিজার্ভ ফোর্স প্রস্তুত রাখা এবং এ ধরনের পরিস্থিতিতে স্বল্প সময়ের মধ্যে তাদের ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর দিক-নির্দেশনা দেন। প্রয়োজনে রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেডের ব্যবহার বাড়ানোর তাগিদ দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে আগে এ ধরনের ঘটনায় সঠিক তদন্ত না হওয়া এবং দোষীদের আইনের আওতায় না আনার কারণে হামলার ঘটনা ঘটছে বলে অনেকে মত প্রকাশ করেন।
এ সময় আইজিপি এ পর্যন্ত সংখ্যালঘুর ওপর হামলার ঘটনায় কতগুলো মামলা দায়ের হয়েছিল এবং তার সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে চান। এ সময় পুলিশ সদর দফতরের গোপনীয় শাখা থেকে ২০০১ থেকে ২০২১ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত ৪ শতাধিক মামলা হয়েছিল। এর অন্তত ২৫৩টি মামলা সমঝোতার ভিত্তিতে নিষ্পত্তি হয়েছে বলে জানানো হয়। এছাড়া তদন্ত করে চার্জশিট দেয়া হয় ১৯৪টি। আর ২৭ মামলার চূড়ান্ত রিপোর্ট দেয়া হয়।
আলোচনার একপর্যায়ে পুলিশ সদর দফতরের ঊর্ধ্বতনরা ওইসব চার্জশিটে মূল নাশকতাকারীদের আসামি করা হয়নি বলে অভিযোগ করেন। মূল হোতারা চিহ্নিত না হওয়ায় আবারো এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে বলে জানানো হয়। এ সময় আইজিপি মামলাগুলো পুনঃতদন্তের ব্যবস্থা করা হবে বলে জানান। বৈঠকে দেশের অন্তত ২৬টি জেলার পুলিশ সুপারদের তিনি বিশেষ নির্দেশনা দেন। ওইসব জেলায় বিএনপি, জামায়াত ও হেফাজতের তৎপরতা রয়েছে।
জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে_ ঝিনাইদহ, কুড়িগ্রাম, সাতক্ষীরা, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী, মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর, কক্সবাজার, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, পাবনা, বাগেরহাট, চাঁদপুর, মাগুরা, পঞ্চগড়, রংপুর, শরীয়তপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সিলেট, কুষ্টিয়া ও নরসিংদী।
এসব জেলার পুলিশ সুপারদের সাদা পোশাকে গোয়েন্দা নজরদারির পাশাপাশি কমিউনিটি পুলিশিং জোরদার করার তাগিদ দেয়া হয়। পাশাপাশি গ্রাম পুলিশের সদস্যদের কার্যক্রম আরো গতিশীল করতে নিয়মিত বৈঠকের আয়োজন করতে বলা হয়েছে। স্থানীয় সরকারদলীয় নেতাকর্মীদেরও কমিউনিটি পুলিশিং এ সম্পৃক্ত করার ওপর জোরদার করা হয়েছে।
নয়া শতাব্দী/এমআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ