ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ঢাকায় প্রতিদিনই গাড়ি চুরি

প্রকাশনার সময়: ২৭ অক্টোবর ২০২১, ০৬:৫১
সংগৃহীত ছবি

রাজধানীতে আশঙ্কাজনকহারে বেড়েছে যানবাহন চুরির ঘটনা। এর মধ্যে রয়েছে পিকআপ ভ্যান, কাভার্ড ভ্যান, সিএনজি অটোরিকশা, প্রাইভেটকার, বাস, লেগুনা ও মোটরসাইকেল। ডিএমপির এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে ঢাকার বিভিন্ন থানায় ২৫৮টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে উদ্ধার হয়েছে মাত্র ৯৮টি যানবাহন।

অথচ গত বছর ৩৩২ মামলার বিপরীতে ৩৯৮টি যানবাহন উদ্ধার হয়েছিল বলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। এমন পরিস্থিতিতে চলতি বছরে যানবাহন চুরির ঘটনায় উদ্ধার কম হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে সর্বশেষ ডিএমপির অপরাধ পর্যালোচনা সভায় আলোচনা হয়। সেখান থেকে এসব যানবাহন উদ্ধার ও জড়িতদের গ্রেফতারে বিশেষ নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র দাবি করেছে।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় বলেন, প্রায় প্রতিদিনই চোরাই যানবাহন উদ্ধার হচ্ছে এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। তারপরও কিছু চুরির ঘটনা ঘটছে। এ বিষয়ে থানা পুলিশকে সতর্কাবস্থায় দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারিও। একই সঙ্গে যানবাহন ব্যবহারকারীদেরও সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন ডিএমপির এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

জানা গেছে, চলতি ৯ মাসে ২৫৮টি মামলার ঘটনায় মাত্র ৯৮ গাড়ি উদ্ধারে উদ্বিগ্ন পুলিশ। এমন পরিস্থিতিতে চোরাই গাড়ি উদ্ধার ও আসামি গ্রেফতারে নড়েচড়ে বসেছে গোয়েন্দারা। সংঘবদ্ধ চোরদের গ্রেফতারে মাঠে নেমেছে পুলিশের একাধিক টিম। বিষয়টি নিয়ে ডিএমপির অপরাধ পর্যালোচনা সভায়ও আলোচনা হয়। ওই আলোচনায় গাড়ি চুরি ঠেকাতে বিশেষ নির্দেশনা দেন ডিএমপি কমিশনার।

সূত্রমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ডিএমপির ৫০টি থানায় ২৯টি মামলা দায়ের হয়। এসব মামলায় গ্রেফতার করা হয় ১৫ জনকে। গাড়ি উদ্ধার করা হয় মাত্র ১২টি। এর মধ্যে ৩টি প্রাইভেটকার, একটি পিকআপ, ৩টি সিএনজি অটোরিকশা ও ৫টি মোটরসাইকেল। ফেব্রুয়ারি মাসে ৩২ মামলায় গ্রেফতার করা হয় ১৪ জনকে। উদ্ধার করা হয় একটি বাস, একটি ট্রাক, একটি প্রাইভেটকার, একটি মাইক্রোবাস, ২টি পিকআপ, একটি সিএনজি অটোরিকশা ও ৭টা মোটরসাইকেল। মার্চ মাসে ২২ মামলায় ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। উদ্ধার করা হয়, ২টি পিকআপ, ৭টি মোটরসাইকেল।

এপ্রিলে ৩২ মামলায় ৯ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। উদ্ধার করা হয় একটি ট্রাক, একটি প্রাইভেটকার, ৬টি মোটরসাইকেল। মে মাসে ৩২ মামলায় ৬ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। উদ্ধার করে একটি বাস, একটি মাইক্রো, একটি পিকআপ ও ৫টি মোটরসাইকেল। জুন মাসে ৩৩ মামলায় ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়। উদ্ধার করা হয়, দুটি প্রাইভেটকার, দুটি পিকআপ ও মোটরসাইকেল ৩টি। জুলাইতে ২১ মামলায় ৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়। উদ্ধার করা হয় সিএনজি ৬টি, মোটরসাইকেল ৪টি।

আগস্টে ৩৩ মামলায় ২০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। উদ্ধার করা হয়, দুটি ট্রাক, একটি প্রাইভেটকার একটি মাইক্রোবাস, একটি পিকআপ, একটি সিএনজি অটোরিকশা ও ৫ মোটরসাইকেল। আর সেপ্টেম্বরে ২৪ মামলায় ১৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়। উদ্ধার করা হয় ২টি ট্রাক, একটি মাইক্রোবাস, ৫টি প্রাইভেটকার, দুটি সিএনজি অটোরিকশা ও ৬টি মোটরসাইকেল।

ডিএমপির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, কাগজে চুরির এ পরিসংখ্যান হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। অনেক সময় চুরি হয়ে যাওয়ার পর চোরেরা নিজ থেকেই বিভিন্ন যানবাহনের মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এরপর টাকা খরচ করে গোপনে যানবাহন ছাড়িয়ে নিয়ে আসে। এসব ক্ষেত্রে তারা পুলিশের সহায়তা নিলে হয়তো চোরদের সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যেত। এতে তাদের আইনের আওতায় আনতে পারলে অধিকাংশ চুরি ঠেকানো সম্ভব হতো।

কয়েকজন ভুক্তভোগী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, যানবাহন চুরির পর থানায় গেলে বেশিরভাগ সময় সাধারণ ডায়েরি করার পরামর্শ দেয়া হয়। এরপর মালামাল উদ্ধার করা সম্ভব হলে পরে সেটি মামলা আকারে লিপিবদ্ধ করে পুলিশ। এতে মাসিক অপরাধ সভায় চুরির পরিসংখ্যান কম দেখিয়ে ঊর্ধ্বতনদের সন্তুষ্ট করে রাখেন থানার কর্মকর্তারা। বাহবা নেয়ার জন্যই পুলিশের পক্ষ থেকে এ পদ্ধতি চালু করা হয়েছে বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ।

ডিএমপির গাড়ি চোরাই প্রতিরোধ টিমের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সিএনজি অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিক রিকশা, মোটরসাইকেল ও ইজিবাইক ছিনতাইয়ে চালককে খুনের ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে তারা চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে। তারা জানতে পেরেছে, রাজধানীর প্রতিটি এলাকাতেই ভিন্ন ভিন্ন ছিনতাইকারী গ্রুপ রয়েছে। এসব গ্রুপ তিনটি দলে বিভক্ত।

প্রথম দলের সদস্যরা একজন সিএনজি অটোরিকশার চালককে টার্গেট করে তার সব খোঁজখবর নেয়। তার বাসা-বাড়ি ও গাড়ির গ্যারেজের অবস্থান রেকি করে। সংগ্রহ করে চালকের মোবাইল ফোন নম্বর। এসব তারা দ্বিতীয় দলকে বুঝিয়ে দেয়। এ দলের সদস্যরা গাড়ির গ্যারেজের আশপাশে অবস্থান নেয়। দিনভর গাড়ি চালিয়ে চালক রাতে গাড়ি গ্যারেজে জমা দিতে যাওয়ার সময় ছিনতাইকারীরা যাত্রীবেশে গাড়িতে চড়ে এবং লোভনীয় ভাড়া দেয়ার কথা বলে নির্জন এলাকায় নিয়ে যায়। সেখানে চালকের গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে কিংবা ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। লাশ রাস্তার পাশে ফেলে গাড়ি নিয়ে পালিয়ে যায়।

গাড়িটি তৃতীয় দলের হাতে পৌঁছে দিয়ে তারা তাদের কাজ শেষ করে। পরবর্তীতে তৃতীয় দলের সদস্যরা গাড়ির রংসহ আনুষঙ্গিক কিছু সাজ-সরঞ্জাম পরিবর্তন করে তা বিক্রি করে দেয়। আবার অনেক সময় গাড়ির মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকার বিনিময়ে গাড়ি ফিরিয়ে দেয়া হয়। তবে কোনো ঘটনায় চালক খুন বা আহত হলে থানায় মামলা দায়ের করা হয়। ২০১৮ সালে এ ধরনের ঘটনায় ১১টি, ২০১৯ সালে ১৯টি, ২০২০ সালে ২১টি এবং ২০২১ সালের প্রথম দুই মাসে ৭টি খুনের ঘটনা ঘটে। এসব মামলার তদন্তের দায়িত্বে রয়েছে পিবিআইয়ের হাতে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন থানায় ৩৭টি চুরির মামলা হয়। এসব মামলায় গ্রেফতার করা হয় ৯ জনকে। উদ্ধার করা হয় ৫২টি যানবাহন। একই বছরের ফেব্রুয়ারিতে ৩০ মামলায় ১৮ জনকে গ্রেফতার ও উদ্ধার করা হয় ৩৭টি যানবাহন। মার্চে ৩৭ মামলায় ২৫ জনকে গ্রেফতার ও ৫৮টি যানবাহন উদ্ধার করা হয়। এপ্রিলে ৪ মামলা ৯টি যানবাহন উদ্ধার করা হয়।

মে মাসে ৭ মামলায় ৯ জনকে গ্রেফতার ও ৪টি যানবাহন উদ্ধার করা হয়। জুনে ২৯ মামলায় ১৫ জনকে গ্রেফতার ও ২৯টি গাড়ি উদ্ধার করা হয়। জুলাই মাসে ২৩ মামলায় ১৩ জনকে গ্রেফতার ও ৩৩টি গাড়ি উদ্ধার করে পুলিশ। একইভাবে আগস্টে ৩০ মামলায় ১৩ জনকে গ্রেফতার ও ৩২টি বাহন উদ্ধার করা হয়।

সেপ্টেম্বরে ৪৯ মামলায় ১৫ জনকে গ্রেফতার ও ৫৩টি যানবাহন উদ্ধার করা হয়। অক্টোবরে ৩৫ মামলায় ১৩ জনকে গ্রেফতার করে ৫০টি যানবাহন উদ্ধার করা হয়। নভেম্বরে ২৯ মামলায় ২৮ জনকে গ্রেফতার করলেও ২৫টি যানবাহন উদ্ধার হয়। আর ডিসেম্বরে ২২ মামলায় ১৩ জনকে গ্রেফতার করে ১৬টি যানবাহন উদ্ধার করে ডিএমপির বিভিন্ন ইউনিট।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ