করোনা মহামারির প্রকোপ কিছুটা কমে এলেও বেড়েই চলছে ডেঙ্গু। হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ মারা যাচ্ছেন। চলতি বছরে এপ্রিল-জুন মাসে ডেঙ্গুর প্রভাব হঠাৎ করে বৃদ্ধি পায়। এ সময়ে এডিস মশা নিধনে তেমন কোনো কার্যক্রম ছিল না বললেই চলে। বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী বাড়তে থাকলে রাজধানীর দুই সিটি মেয়রসহ স্থানীয় সরকার বিভাগের ওপর চারদিকে সমালোচনার ঝড় ওঠে। দুই সিটি মেয়র তাৎক্ষণিক এডিস মশা নিধনে ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নেয়।
ঢাকা সিটির উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম নিজেই নেমে যান মাঠে। তার দেখাদেখি দক্ষিণের মেয়র নেমে যান এডিস নিধন অভিযানে। সড়ক, বিভিন্ন পরিত্যক্ত ও নির্মাণাধীন ভবন এবং বাসাবাড়িতে অভিযান পরিচালনা করতে থাকে দুই সিটি করপোরেশন। জরিমানাও করা হয় বেশ কিছু ভবন মালিককে। কারাগারেও পাঠানো হয় কয়েকজনকে। এরপরও কি কমেছে ডেঙ্গু রোগী, এডিস মশা ও লার্ভা পরিমাণ এমন প্রশ্ন নগরবাসীর। অনেকের অভিযোগ, মশা নিধনে কার্যকর পদক্ষেপের চেয়ে সিটি করপোরেশনের ‘গর্জন’ই বেশি লক্ষ্য করা গেছে।
এদিকে, ডেঙ্গু রোগের জীবাণুবাহী এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন মশার ওষুধ ছিটানোসহ বিভিন্ন ধরনের অভিযান চালিয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। সচেতন হওয়ার জন্য মন্ত্রী-মেয়রদের আহ্বানে সাড়া দিচ্ছেন না নগরবাসী। এ পরিস্থিতিতে বাড়ছে এডিস মশার দৌরাত্ম্য। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বশেষ প্রকাশিত এক জরিপেও এডিস মশার ঘনত্বের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। আগের জরিপের চেয়ে এবার প্রায় প্রতিটি এলাকাতেই মশার ঘনত্ব ভয়াবহভাবে বেড়েছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) বাসাবো, গোড়ান, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, এলিফ্যান্ট রোড, আর কে মিশন রোড ও টিকাটুলী এলাকায় এডিস মশার ঘনত্ব সবচেয়ে ভয়াবহ। আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মগবাজার ও নিউ ইস্কাটন এলাকায় এ মশার ঘনত্বও ব্যাপক। জরিপ চালানো ৯৮টি ওয়ার্ডের দুটি ছাড়া সবটিতেই এ মশার উদ্বেগজনক উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাশার নয়া শতাব্দীকে বলেন, আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে আমাদের বৃষ্টির সময় পরিবর্তন হচ্ছে। আর যতদিন বৃষ্টি থাকবে ততদিন এডিস মশা থাকবে। আমাদের বৃষ্টির সময় এমনটাই পরিবর্তন হয়েছে যে, অক্টোবরেও বৃষ্টি হচ্ছে। এটা যদিও হওয়ার কথা নয়। তাই এডিস মশাও নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে না। এখন থেকে সিটি করপোরেশনকে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সারা বছর কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে। কোনো নির্দিষ্ট সময় এখন আর এডিস মশা জন্মায় না। বৃষ্টি হলেই এডিস মশা জন্মাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই অবস্থা হয়েছে বলেও জানান।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্যমতে, চলতি মাসের ২৫ দিনে হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে ৪ হাজার ৬৭৩ জন। আর ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছরে ১ জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত দেশে সরকারি হিসাবে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ২২ হাজার ৮৭০ জন। এদের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন ২১ হাজার ৯৪১ জন। আর মারা গেছেন ৮৮ জন। গত ১০ আর রাজধানীর বাইরে ৪৩৭ জনসহ সারাদেশে আক্রান্ত হয়েছে এক হাজার ৭৭০ জন।
এর আগে গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে একটি অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেছিলেন, আগামী এক মাসের মধ্যে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে আসবে। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। গত ২৬ দিনের হিসাব তাই বলছে। রাজধানীতে প্রতিদিন ১৫০ জনের বেশি ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। মন্ত্রীর এই ঘোষণা বাস্তবায়ন করতে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
নগরবাসীর অভিযোগ, দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় এডিস মশা নিধনের জন্য প্রতিদিন ফগ মেশিন দিয়ে ফগার ও লার্ভিসাইড ছিটানো হয়। তবে এই কথা শুধু দুই মেয়রই বলে থাকেন। বেশিরভাগ এলাকাতেই সপ্তাহে দুই বা তিন দিনের বেশি মশা নিধনে ওষুধ বা ফগার মেশিনের আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায় না। এ অবস্থায়ও দুই সিটি মেয়রই ডেঙ্গু নিধনে কার্যকর ভূমিকা রেখেছেন। ডিএনসিসির ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের (মগবাজার) বাসিন্দা বাদল বলেন, আমি গত এক মাসের মধ্যে হাতেগোনা দুই-একদিন দেখেছি, ডেঙ্গু নিধনে ওষুধ ছিটাতে। কর্মীরা আসে না। এলেও তারা টাকা দাবি করেন। না দিলে তাদের দেখা পাওয়া যায় না।
অপরদিকে দক্ষিণ সিটির জুরাইনের বাসিন্দা মিজান রহমান বলেন, সপ্তাহে একদিনও ফগার মেশিনে মশার ওষুধ ছিটাতে দেখেন না। প্রায় প্রতিদিন এডিস মশার প্রজননের রেড জোন চিহ্নিত হচ্ছে এই ওয়ার্ড। এই সিটির বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে একই অভিযোগ পাওয়া গেছে। এরপরও ঢাকা দুই সিটি করপোরেশন খাল পরিষ্কার ও বিভিন্ন বাড়িতে নামমাত্র অভিযান চালিয়ে বলছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলেও করোনার মতো ডেঙ্গুও ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্য বিশেজ্ঞদের মতে, এডিস মশার প্রকোপ বৃদ্ধির একটি বৃত্তাকার চক্র রয়েছে। তাই আগেই সতর্ক করা হয়েছিল যে এডিস মশার প্রকোপ বেশি এবার। দুই সিটি করপোরেশনও এ ব্যাপারে সজাগ ছিল। তবে দুই করপোরেশন বিভিন্ন রকম মশক নিধন কর্মসূচি নিলেও গোড়াতেই গাফিলতি থেকে যাচ্ছে। মূলত মশা নিধনে সারা বছর কর্মসূচি চলমান থাকা উচিত। কিন্তু আমরা সেটা দেখছি না। ডেঙ্গির প্রাদুর্ভাব শুরু হলেই নড়েচড়ে বসে সংস্থাগুলো। পাশাপাশি সরকারি আরো ডজনখানেক প্রতিষ্ঠানও এর জন্য দায়ী। তবে মশা নিয়ন্ত্রণে সবাইকে সচেতন হতে হবে।
জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী নয়া শতাব্দীকে বলেন, ডেঙ্গু নিধনে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক এখনো বৃদ্ধি পায়নি। বাসাবাড়িতে এখনো লার্ভা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানুষও সচেতন হয়নি। জনগণের সম্পৃক্ততা আরো বৃদ্ধি করতে হবে। বাড়ির ছাদ, দুই বাড়ির মাঝখানে এখনো ময়লা পড়ে আছে, পানি জমে আছে। সাধারণ মানুষ ডেঙ্গুর লার্ভা তৈরি করে দিচ্ছে। আরো শক্ত হয়ে কাজ করতে হবে সিটি করপোরেশনকে। স্থানীয় জনসাধারণ-প্রশাসন-ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের আরো জনসম্পৃক্ত হতে হবে। এগুলো পারেনি বলেই এখনো ডেঙ্গু বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জুবায়দুর রহমান বলেন, জনসম্পৃক্ততা আরো বাড়াতে হবে। না হলে এডিস মশা কমবে না। যতই বৃষ্টি প্রলম্বিত হবে, ততই এডিস মশা বৃদ্ধি পাবে। মানুষ সচেতন না হলে এডিস মশা কমানো সম্ভব নয়। মোবাইল কোর্ট করছি, অভিযান চালাচ্ছি, লার্ভিসাইড ও ফগিং চলছে, গত ৯-১৪ অক্টোবর মশকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করেছি, আরো করব।
তিনি বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ একটি সামষ্টিক প্রক্রিয়া। কারণ মশার বংশবিস্তার উপযোগী পরিবেশ বাসাবাড়ির ভেতরেও থাকে, যেখানে পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের প্রবেশগম্যতা নেই। তাই এর বিস্তাররোধে নাগরিকদেরও সচেতন হতে হবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ নয়া শতাব্দীকে বলেন, ডিজি হেল্থ থেকে যে আক্রান্তের সংখ্যা গণমাধ্যমকে প্রেরণ করা হয়, এতে ঢাকা দক্ষিণে আক্রান্ত প্রতিদিন গড়ে ১০-১৪ জন। তাই আমাদের দক্ষিণে আক্রান্তের সংখ্যা কমে আসছে।
তিনি জানান, আগামী মাসে কিউলেক্স মশা বৃদ্ধি পেতে পারে। এর জন্য আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। আমাদের প্রস্তুতিও শেষ। আশা করি, দক্ষিণের বাসিন্দাদের কোনো সমস্যা হবে না। সারা বছর এডিস মশা নিধনে বিভিন্ন কার্যক্রম নেয়া হয়েছে।
ফরিদ আহাম্মদ আরো বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এডিস মশার প্রজনন সময় পরিবর্তন হয়েছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন টেকনিক্যাল কমিটির সঙ্গে আলোচনা করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েছি আমরা। ১৫ দিন আগে আমাদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তাদের মতামত অনুযায়ী আমরা বিভিন্ন ধরনের ওষুধ সংগ্রহ করে মজুদ করেছি। আগামী বছর ডেঙ্গু নিধনে ইতোমধ্যে আমরা একটা ব্যবস্থাপনা তৈরি করেছি। আমরা সারা বছর এডিস নিধনে কার্যক্রম চালাব। সেভাবেই প্রস্তুতি শেষ করেছি।
নয়া শতাব্দী/এমআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ