ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

নতুন ভার্সনে ইয়াবা

প্রকাশনার সময়: ২৬ অক্টোবর ২০২১, ০৬:২৩

কারওয়ানবাজারের মাদকসেবী জুম্মন। এক সময় রাত জেগে থাকার জন্য নিয়মিত মরণ নেশা ইয়াবা সেবন করতেন। মিষ্টি স্বাদের ইয়াবা সেবনের কারণে তার স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকে। হঠাৎই পরিচয় হয় ইয়াবা বিক্রেতা সুমনের সঙ্গে। তিনি তাকে নতুন ইয়াবার সন্ধান দেন। সেটা খাওয়ার ১০ মিনিটের মধ্যেই ঘুম চলে আসে জুম্মনের। আর এ কারণে এখন তার কাছে ফেভারিট ইয়াবার এই নতুন ভার্সন। শুধু জুম্মন নয়, এ ধরনের ইয়াবা এখন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে মাদকসেবীদের কাছে। সম্প্রতি ইয়াবার কয়েকটি চালান জব্দের পর রাসায়নিক পরীক্ষায় এ ধরনের ইয়াবার সন্ধান পাওয়া যায়। নতুন এই ইয়াবায় রয়েছে মিথাইল, এমফিটামিন ও হেরোইনের উপাদান। এমন পরিস্থিতিতে বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। তাদের দাবি মাদকের নতুন ভার্সন আইস নিয়ে তারা এমনিতেই চিন্তিত। এমন অবস্থায় ইয়াবার নতুন এ ভার্সন দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জানতে চাইলে সিআইডির রসায়ন পরীক্ষাগারের প্রধান কর্মকর্তা দীলিপ কুমার জানান, গত কয়েক দিনে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন ধরনের ইয়াবার নমুনা পাঠানো হয়। সেখানে দেখা গেছে, আগে ইয়াবায় মূল উপাদান হিসেবে ম্যাথামফিটামিন ও ক্যাফেইন ব্যবহার করা হতো। কিন্তু সম্প্রতি যেসব নমুনা পাঠানো হচ্ছে সেখানে রয়েছে মিথাইল, এমফিটামিন ও হেরোইনের উপাদান। এ ধরনের উপাদান ব্যবহারের কারণে মাদকসেবীরা তা সেবনের পর দ্রুত ঘুমিয়ে যায়। আবার বেশি সেবন করলে মৃত্যুর ঝুঁকি রয়েছে।

জানা গেছে, সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে বনশ্রী, বারিধারা, উত্তরা থেকে ৫০০ গ্রাম আইস ও পাঁচ হাজার ইয়াবাসহ ১০ জনকে গ্রেফতার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (ডিএনসি)। গ্রেফতারকৃতরা হলেনÑ রুবায়াত, রোহিত হোসেন, মাসুম হান্নান, আমানুল্লাহ, মোহাইমিনুল ইসলাম ইভান, মুসা উইল বাবর, সৈয়দা আনিকা জামান ওরফে অর্পিতা জামান, লায়লা আফরোজ প্রিয়া, তানজিম আলী শাহ ও হাসিবুল ইসলাম। এর তিন দিন আগে ৫০০ গ্রাম আইস এবং ৬৩ হাজার পিস ইয়াবাসহ সাতজনকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। দুই মাসের ব্যবধানে চট্টগ্রামে চারটি আইসের চালান জব্দ করে র‌্যাব ও পুলিশ। উদ্ধারকৃত প্রায় সব চালানেই আইসের সাদা গুঁড়ো বা কাঁচামাল পাওয়া যায়। এসব মালামাল পরীক্ষার জন্য রসায়নগারে পাঠানো হলে ইয়াবার মধ্যে মিথাইল, অ্যামফিটামিন ও হেরোইনের উপাদান পাওয়া যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ক্রিস্টাল মেথ বা মেথা-অ্যামফিটামিন প্রধানত তৈরি হয় থাইল্যান্ডে। পাশাপাশি মালয়েশিয়া ও মিয়ানমারে তৈরি হচ্ছে। মূলত এই তিন দেশ থেকে এটি ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে পাচার হয়। বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করছে কারবারিরা।

আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, একসময় ইয়াবা ব্যবহার করা হতো রাত জেগে থাকার জন্য। এতে ইয়াবাসেবীরা এক ধরনের আনন্দ উপভোগ করত। কিন্তু ইয়াবা তার আগের রূপ থেকে বেরিয়ে এসেছে। বর্তমানে বাজারে যে সমস্ত ইয়াবা পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো সেবনের সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ছে ইয়াবাসেবীরা। অনেকে বিষয়টি ভালোভাবে নিলেও ইয়াবার নতুন এই ধরন দিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে সেবীদের কাছে। স্বাদে তিতা হওয়ার কারণে কিছুৃ সেবীর কাছে এটি গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। আবার অনেকে নতুন এই মাদক সাদরে গ্রহণ করেছে।

সূত্রমতে, শুরুর দিকে ওজন কমানোর জন্যও অনেকেই ইয়াবা সেবন করত। পরবর্তী সময়ে রাত জেগে থাকা শিক্ষার্থীরা, লংড্রাইভের ড্রাইভাররা এর ব্যবহার শুরু করে। অনেকেই যৌন-উত্তেজক হিসেবেও ইয়াবা সেবন করতে থাকে। ইয়াবা সেবনে সাময়িকভাবে সব দুঃখ-কষ্ট ভুলিয়ে দেয়ায় দ্রুতই তা বাজারে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে এর আসক্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে ছেড়ে দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। আগে চার ধরনের ইয়াবা পাওয়া যেত। গাঢ় লাল রঙের চম্পা, গোলাপি রঙের আর সেভেন, হালকা গোলাপি রঙের জেপি ও ডগ নামের মাটি রঙের ইয়াবা অন্যতম। এসব ইয়াবা সেবনের কারণে মাদকসেবীদের মাঝে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া শুরু হয়। শরীর নিস্তেজ হওয়া, মেজাজ খিটখিটে হওয়া, গলা মুখ শুকিয়ে যাওয়া, শরীর ঘামতে থাকা, অনবরত গরম অনুভূত হওয়া, নাড়ির গতি বৃদ্ধি পাওয়া, রক্তচাপ, দেহের তাপমাত্রা ও শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বৃদ্ধি পাওয়া, যৌন উত্তেজনা চিরতরে লোপ পাওয়া অন্যতম। এসব কারণে রক্তনালি ছিঁড়ে অনেকের ব্রেন হেমারেজ হয়, স্মৃতিশক্তি কমে যায়, মানসিক ভারসাম্য দেখা দেয়। বেশি পরিমাণ ইয়াবা সেবন শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রমের ব্যত্যয় ঘটিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে অনেকে ইয়াবা ছেড়ে আইসের দিকে ঝুঁকে পড়ে। কিন্তু আইসের দাম বেশি হওয়ায় তা সাধারণ মাদকসেবীদের কাছে সোনার হরিণ হয়ে দেখা দেয়। এ কারণে নতুন কৌশল আবিষ্কার করেছে মাদক কারবারিরা। তারা আইসের কিছু উপকরণ দিয়ে ইয়াবার নতুন এই ভার্সন চালু করে বাজারজাত করার চেষ্টা করছে।

সূত্রমতে, চার ধরনের ইয়াবা ছেড়ে এখন বাজারে শতাধিক প্রকারের ইয়াবা পাওয়া যাচ্ছে। সাদা টিস্যু, পেস্ট, পেঁপে, কমলা, গাঢ় লাল, হলুদ, মাটি, হালকা লাল রঙের আটটা দশটা করে কোয়ালিটি বাজারজাত করা হচ্ছে। ইয়াবাকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য বিভিন্ন ফলের ফ্লেভারের সংমিশ্রণ করা হয় যাতে যুব সমাজ ইয়াবার প্রতি আরো বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। ২০১৮ সালে এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মাদকসেবীদের ৫৮ ভাগ ছিল ইয়াবাসেবী। বর্তমান তার সংখ্যা ৮০ ভাগ। বাকি ২০ ভাগ বিভিন্ন ধরনের মাদকে আসক্ত। নতুন এই ইয়াবার বেশিরভাগ আসছে ভারতের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে। এর মধ্যে রয়েছে কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারী, জামালপুরের বকশীগঞ্জ, শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতি-নালিতাবাড়ী, ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট ধোবাউড়া, নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, সিলেটের সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও কক্সবাজারের টেকনাফ অন্যতম।

জানা গেছে, টেকনাফ সীমান্তে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর নজরদারির কারণে ইয়াবা পাচারের রুট পরিবর্তন করেছে মাদক কারবারিরা। তারা এখন সরাসরি দেশে ইয়াবা না পাঠিয়ে আগে ভারতে পাচার করে। তার পর এসব সীমান্ত ব্যবহার করে বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছে বলে বিভিন্ন সূত্র দাবি করেছে। আগে ১৫ থেকে ২০ টাকায় সীমান্তে পাইকারিভাবে ইয়াবা পাওয়া গেলেও বর্তমান তার দাম বেড়ে ঠেকেছে অর্ধশত টাকায়। কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে, আরো একটি রাষ্ট্র ঘুরে দেশে আসায় খরচ বেড়ে গেছে পাচারকারীদের।

নয়া শতাব্দী/জেআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ