ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

তদবির চাপে বিব্রত প্রশাসন

প্রকাশনার সময়: ২৬ অক্টোবর ২০২১, ০৩:৫৫

সম্প্রতি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের এক উপসচিবকে যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতির জন্য তদবির করেছেন জাতীয় সংসদের দায়িত্বরত সরকারদলীয় প্রভাবশালী এক নেতা। গত ২৯ সেপ্টেম্বর তার স্বাক্ষরিত আধা সরকারিপত্র (ডিও লেটার) মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে দেয়া হয়। অথচ পদোন্নতির জন্য এভাবে ডিও দেয়া সরকারি চাকরি বিধিমালার পরিপন্থী।

শুধু তিনিই নন, এর আগে-পরে অনেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-এমপিও একই ধরনের ডিও লেটার দিয়েছেন। কেউ অতিরিক্ত সচিবকে সচিব কিংবা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়ার জন্য প্রশাসনে তদবির করেছেন। কেউ উপসচিবকে যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতির জন্য ডিও লেটার দিয়েছেন। এ ধরনের চাহিদাপত্রের অনুলিপি নয়া শতাব্দীর হাতে এসেছে। সম্প্রতি উপসচিব থেকে যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতির প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় মন্ত্রী-এমপিদের ডিও লেটার দিয়ে বেশি তদবির শুরু হয়েছে।

এদিকে এসব ডিও লেটার নিয়ে সংশ্লিষ্টরা নানামুখী প্রশ্ন তুলেছেন। তারা মনে করেন, এসব ডিও লেটার অনাকাক্সিক্ষত ও আইনবহির্ভূত। এতে সিভিল সার্ভিসের মধ্যে যে ঐক্যবন্ধন ও ভ্রাতৃত্ববোধ ছিল তা নষ্ট হচ্ছে। যাদের তদবির নেই, তারা সচিব হতে পারছেন না। একইভাবে উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি পেতে, পদায়ন নিতে, বদলি হতে সবকিছুতেই তদবির চলছে। সবচেয়ে বেশি তদবির হচ্ছে ভালো জায়গায় পোস্টিং নিতে। অথচ পুরো বিষয়টিই নিয়মবহির্ভূত।

এ প্রসঙ্গে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, পদোন্নতির জন্য রাজনৈতিক নেতাদের কাছে ডিও নেয়া সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার পরিপন্থী এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। রাজনৈতিক নেতারাও এ বিষয়ে তদবির করতে পারেন না।

সরকারের উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদে পদোন্নতি বিধিমালা ২০০২-এ বলা হয়েছে, অতিরিক্ত সচিব কিংবা সচিব পদে পদোন্নতি প্রদানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা সমগ্র চাকরিকালে পালনকৃত দায়িত্বের গুরুত্ব ও প্রকৃতি এবং তার ব্যক্তিগত সুনামসহ প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করা হবে। পদোন্নতি প্রদানের ভিত্তি হবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার মেধা, দক্ষতা ও জ্যেষ্ঠতা। মূল্যায়নের জন্য নির্ধারিত ১০০ নম্বরও রয়েছে। সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি) এসব মানদ- বিবেচনা করে সচিবসহ অন্যান্য পদে পদোন্নতির সুপারিশ করে। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই সুপারিশ চূড়ান্ত অনুমোদন করেন। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি উপসচিব থেকে যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতির প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় মন্ত্রী-এমপিদের ডিও লেটার দিয়ে বেশি তদবির শুরু হয়েছে। কেউ আবার সরকারের প্রভাবশালীদের দিয়ে সরাসরি জনপ্রশাসনমন্ত্রী কিংবা সচিবকে ফোনও করাচ্ছেন। এতে রাজনৈতিকভাবে যোগাযোগ না থাকা কর্মকর্তারা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। রাজনৈতিকভাবে বিবেচনা করা হলে তাদের পদোন্নতি নাও হতে পারে, অনেকে এমনটা আশঙ্কা করছেন।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এবার যুগ্মসচিব পদোন্নতির ক্ষেত্রে বিসিএস ২০তম ব্যাচ পর্যন্ত কর্মকর্তাদের বিবেচনা করা হচ্ছে। এ ব্যাচে যোগদান করা কর্মকর্তা ২৯৭ জন। এর মধ্যে ২৬৮ জন উপসচিব হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছেন। ২০তম ব্যাচে যুগ্মসচিব হওয়ার যোগ্য ২৪৮ জন।

সূত্র জানায়, এবারের পদোন্নতিতে উপসচিব পদমর্যাদার ৫৫৩ জন কর্মকর্তাকে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২০তম ব্যাচ পর্যন্ত (লেফট আউটসহ) ৩২৪ জন কর্মকর্তা রয়েছেন। ইকোনমিক ক্যাডার কর্মকর্তা রয়েছেন ৩৮ জন এবং অন্যান্য ক্যাডারের ১৯১ জন।

প্রশাসনের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, প্রত্যক কর্মকর্তার কর্মজীবনের সমস্ত নথি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। প্রয়োজনীয় নম্বর, চাকরিজীবনের শৃঙ্খলা, দুর্নীতির বিষয়সহ সামগ্রিক বিষয় পর্যালোচনা করা হচ্ছে। যোগ্যতার ভিত্তিতে পদোন্নতি দেয়া হবে।

তবে মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও এমপিসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ডিও লেটার এবং বিভিন্ন ধরনের সুপারিশ তাদের বিব্রত করছে। কেননা এমন অনেকের জন্য তদবির করা হচ্ছে যাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে। এদের কারো কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় বিভাগীয় শাস্তিও দেয়া হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা বলেন, গত ২৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের এক নেতার দেয়া ডিও লেটারে এক উপসচিবকে সৎ, নিষ্ঠাবান এবং দক্ষ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ চাকরি জীবনের বিভিন্ন সময় তিনি নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে সহকর্মী ও জ্যেষ্ঠদের সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগ রয়েছে। দেশের মন্ত্রীদের সমালোচনা করে তিনি বিভাগীয় শাস্তিরও মুখোমুখি হয়েছেন।

প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালে তিনি বাংলাদেশের মন্ত্রীদের যোগ্যতা নিয়ে ফেসবুকে একটি বিতর্কিত পোস্ট দেন। এতে তিনি লিখেন, ‘বাংলাদেশে যদি বুলগেরিয়ার মতো অপরাধের জন্য মন্ত্রীদের বহিষ্কারের রীতি প্রচলন করা হয়, তবে কোনো মন্ত্রী এক সপ্তাহের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারবে না।’ এ পোস্টকে কেন্দ্র করে তখন বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়। ওই মামলায় তাকে তিরস্কারের সাজা দেয়া হয়। এছাড়া তিনি ফেসবুকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিভিন্ন কর্মকা- ও সিদ্ধান্তের ভূয়সী প্রশংসা করে পোস্ট দেন। যা নিয়ে ওই সময়ও বিভিন্ন মহলে সমালোচনার ঝড় ওঠে।

প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, এর আগে এক অতিরিক্ত সচিবকে সচিব পদে পদোন্নতি দিতে আধা-সরকারি পত্র দেন এক প্রতিমন্ত্রী। আরেক অতিরিক্ত সচিবের জন্য ডিও লেটার দিয়ে তদবির করেন নেত্রকোনার এক এমপি। এছাড়া সিভিল সার্ভিসের প্রশাসন ক্যাডারের ১১ ব্যাচের কর্মকর্তাকে আওয়ামী লীগপন্থি কর্মকর্তা হিসেবে চিহ্নিত করে তাকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেয়ার সুপারিশ করে ডিও লেটার দিয়েছিলেন আরেক মন্ত্রী। পাশাপাশি ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তাকে যুগ্মসচিব হিসেবে পদোন্নতি দেয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নেয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন তিনি। তাছাড়া আরেক অতিরিক্ত সচিবকে সচিব পদে পদোন্নতি দেয়ার জন্য গত ২০ মে আধা-সরকারি পত্র দিয়েছিলেন প্রভাবশালী এক মন্ত্রী। তার দুই দিন আগে অর্থাৎ ১৮ মে অপর এক ডিও লেটারে এক অতিরিক্ত সচিবকে সচিব হিসেবে পদোন্নতি দেয়ার অনুরোধ করা হয়। অতিরিক্ত সচিবকে পদোন্নতি দেয়ার সুপারিশ করেছিলেন এক মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির সভাপতি। যুগ্ম সচিবকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেয়ার জন্য তদবির করেছেন আওয়ামী লীগের বাগেরহাট জেলার এক নেতা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এ ধরনের ডিও লেটার দেয়ার তালিকা বেশ দীর্ঘ। বিভিন্ন পদে পদোন্নতি দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হলেই এ ধরনের তদবিরের হিড়িক পড়ে। বিগত সময়ও এ ধারা ছিল, তবে সম্প্রতি তা অনেক বেড়েছে।

এ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, জনপ্রতিনিধিরা ডিও লেটার দিতেই পারেন। তবে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের পদোন্নতির একটা মাপকাঠি রয়েছে। যে কোনো পদোন্নতিতেই যোগ্যতা প্রধান বিবেচ্য। এ ক্ষেত্রেও এর ব্যত্যয় হওয়ার কথা নয়।

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ডিও লেটারের সত্যতা যাচাইয়ের অনুরোধ: পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন প্রেরিত যে কোনো সুপারিশ ও ডিও লেটার যাচাই করে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনুরোধ করা হয়েছে। গতকাল সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ অনুরোধ জানানো হয়।

সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর স্বাক্ষর জাল করে প্রস্তুতকৃত দুটি ভুয়া সুপারিশ ও একটি ডিও লেটার বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে পাওয়া গেছে। এ কারণে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর যে কোনো সুপারিশ ও ডিও লেটারের প্রেক্ষিতে ব্যবস্থা গ্রহণের পূর্বে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সঠিকতা যাচাই করার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থাকে অনুরোধ করা হয়েছে।

নয়া শতাব্দী/জেআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ