ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তিন আগন্তুক ঘিরে রহস্য

প্রকাশনার সময়: ২৪ অক্টোবর ২০২১, ০৬:৪১

কুমিল্লার পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন রাখার ঘটনায় পাশের মাজারে আসা তিন আগন্তুকের সন্ধানে নেমেছে গোয়েন্দারা। কক্সবাজার থেকে মূল অভিযুক্ত ইকবালকে গ্রেফতারের পর তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এ অভিযানে নেমেছে পুলিশের একাধিক ইউনিট।

ধারণা করা হচ্ছে, তারাই কোরআন রাখতে ইকবালকে প্ররোচিত করেছিল। ইকবাল সন্দেহভাজন ওই তিনজনের নাম বলতে না পারলেও তার কাছ থেকে আগন্তুকদের চেহারার বর্ণনা নিয়ে স্কেচ করা হচ্ছে। আগন্তুককে গ্রেফতার করতে পারলেই ঘটনার শিকড়ে পৌঁছানো সম্ভব হবে বলে নিশ্চিত হয়েছেন তদন্ত তদারক একাধিক সূত্র।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম রেঞ্জের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, গ্রেফতার ইকবালের কাছ থেকে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। তার কথার মাঝে কিছু অসংলগ্নতা রয়েছে। এ কারণে তাকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তবে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের সূত্র ধরে আরো কয়েকজনের সন্ধান করা হচ্ছে। তাদের গ্রেফতার সম্ভব হলে প্রকৃত রহস্য বেরিয়ে আসবে। তবে এ ঘটনায় শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে কাউকে আটক বা গ্রেফতার করা হবে না।

জানা গেছে, বৃহস্পতিবার রাতে ইকবালকে গ্রেফতারের পর তাকে প্রথমে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে। এরপর খবর পেয়ে সেখানে উপস্থিত হয় পুলিশের আরো অন্তত দুটি ইউনিটের সদস্য। সেখানে রাতভর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরপর ভোরে কুমিল্লা জেলা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কুমিল্লা জেলা পুলিশ লাইন্সের পর সেখানে নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন ও অ্যান্টি-টেররিজম ইউনিটের চৌকস কর্মকর্তারা। সেখানে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম রেঞ্জের ঊর্ধ্বতনরা।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে ইকবাল ঘটনার আদ্যোপান্ত বর্ণনা করেন। সেখানে তিনি দাবি করেন, চুরির অপবাদে ঘর ছাড়ার পর গত ২০ দিন ধরে তিনি ওই মাজারে অবস্থান করছিলেন। সেখানেই ১০-১২ দিন আগে তার সঙ্গে পরিচয় হয় তিন আগন্তুকের। তারা এলাকার পরিচিত মুখ না হওয়ার কারণে প্রথম অবস্থায় তিনি তাদের এড়িয়ে চলতে থাকেন। তবে এক পর্যায়ে নেশার জন্য তাদের সঙ্গে মিশতে থাকেন।

মাজারভক্তের বেশে থাকা ওই ব্যক্তিরা তাকে গাঁজা ও ইয়াবা সেবনের ব্যবস্থা করেন। এমনকি প্রতিদিন ভাত খাওয়ার টাকাও সরবরাহ করতে থাকেন। এরপর তাদের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব তৈরি হয়। ওই আগন্তুকরা মাজারে রাত যাপন না করলেও প্রতিদিনই সেখানে আসা-যাওয়া করতেন এবং গভীর রাত পর্যন্ত ইকবালের সঙ্গে নেশা করতেন।

পূজা শুরু হলে তারা ইকবালকে মাজারের পাশে মন্দির থাকার কারণে ইসলাম ধর্ম অবমাননা হচ্ছে বলে বিভিন্ন সময় উত্তেজিত করতে থাকে। এমনকি এ বিষয়ে ইকবালের ভূমিকা রাখা উচিত বলেও মন্তব্য করেন। ঘটনার দিন রাতে তারা একসঙ্গে মাজারের পাশে বসে গাঁজা সেবন করেন। এরপর তারাই মণ্ডপে কোরআন রাখতে বলে। এ সময় ওই আগন্তুকেদের সঙ্গে তাল মেলান মাজারের মসজিদ ও মাজারের কর্মী মো. হুমায়ুন কবির ও খাদেম মোহাম্মদ ফয়সলও।

এক পর্যায়ে তাদের কথামতো ইকবাল মাজারের একটি কোরআন নিয়ে মণ্ডপে রেখে আসেন। এমনকি ঘটনার দিন সকালে তিনি মন্দির ভাঙচুরেও অংশ নেন। বিষয়টি এ ঘটনায় গ্রেফতারকৃত মাজারের কর্মী ও খাদেমও স্বীকার করেছেন।

কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) এম তানভীর আহমেদ জানান, শনিবার ইকবাল, ৯৯৯-এ কল দেয়া ইকরাম হোসেন, নগরের দারোগা বাড়ি মসজিদ ও মাজারের কর্মী মো. হুমায়ুন কবির ও খাদেম মোহাম্মদ ফয়সালকে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হয়। আদালত তাদের সবাইকে ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

এম তানভীর আহমেদ বলেন, গতকাল শুক্রবার রাত ৯টা পর্যন্ত পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ইকবালকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। জিজ্ঞাসাবাদে তিনি পূজাম-পে পবিত্র কোরআন রাখা, পূজাম-পের প্রতিমা থেকে গদা সরিয়ে নিয়ে পুকুরে ফেলে দেয়ার কথা স্বীকার করেন। তবে কোন পুকুরে ফেলেন, সেটি বলেননি। তাকে নিয়ে পুলিশ ওই গদা উদ্ধার করবে। একই সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে অভিযানে যাবে। এ ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত তাদের খুঁজে বের করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রিমান্ডে নেয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ইকবাল হোসেন নানুয়াদীঘির পাড়ের অস্থায়ী পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন রাখেন বলে সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে নিশ্চিত করেছে পুলিশ। পরে ইকরাম হোসেন জরুরি সেবা নম্বরে (৯৯৯)-এ কল করে পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন পাওয়ার বিষয়টি পুলিশকে জানান। এদিকে হুমায়ুন ও ফয়সাল নগরের দারোগা বাড়ি মসজিদ ও মাজারের কর্মী। ওই মাজার থেকে পবিত্র কোরআন নিয়ে পূজামণ্ডপে রাখেন ইকবাল। কোরআন সরাতে ইকবালকে তারা সহায়তা করেন বলে প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে। তবে ইকবালকে গ্রেফতারের পর নতুন করে তিন আগন্তুকের বিষয়টি সামনে আসার কারণে তাদের নতুন করে রিমান্ডে আনা হচ্ছে। একই সঙ্গে কোরআন রাখা ও ৯৯৯-এ কল করার সঙ্গে কোনো যোগসূত্র রয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে ইকরামকেও রিমান্ডে নেয়া হয়।

তদন্তে সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সূত্রগুলো জানায়, ভবঘুরে ও মাদকাসক্ত ইকবালকে এ অপকর্মে ব্যবহার করা হয়েছে বলে তারা প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছেন। এরই মধ্যে এ ব্যাপারে বেশকিছু তথ্য-উপাত্তও তাদের হাতে এসেছে। এসব তথ্য পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই-বাছাই ও পর্যালোচনা করা হচ্ছে।

এছাড়া ১১ অক্টোবর দিবাগত গভীর রাতে ওই অপ্রীতিকর ঘটনার আগে তিন ব্যক্তি ১০-১২ দিন ইকবালের সঙ্গে মাজারে আসা-যাওয়া করত বলে তথ্য পেয়েছে তারা। তবে ঘটনার পর তাদের আর এলাকায় দেখা যায়নি। স্থানীয়রা তাদের পরিচয়ও জানাতে পারেনি। এতে ওই ঘটনার সঙ্গে এ তিন ব্যক্তির সম্পৃক্ততা থাকার সন্দেহ ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। তাই তাদের পরিচয় উদ্ঘাটন ও আটকের বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ওই তিন ব্যক্তিকে চিহ্নিত করতে এরই মধ্যে মাজার ও এর আশপাশের এলাকার প্রতিটি সিসি ক্যামেরার ৫ থেকে ১০ অক্টোবরের ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করেছে গোয়েন্দারা। এসব ফুটেজ পর্যালোচনা করে ইকবালের সঙ্গে মাজারে আসা-যাওয়া করা লোকজনের একটি তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। যা থেকে ঘটনার পর এলাকা থেকে সরেপড়া তিন ব্যক্তিকে চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে।

পূজামণ্ডপে কোরআন শরিফ রাখার ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত তদারককারী কর্তৃপক্ষ জানায়, স্পর্শকাতর এ বিষয়টি তদন্তে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে যাতে কোনোভাবে কোনো ভুল পদক্ষেপ নেয়া না হয় এ ব্যাপারে তারা সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছে। সরকারের ওপর মহল থেকেও তাদের এ ব্যাপারে কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাই কিছুটা ধীরে হলেও প্রতিটি বিষয় নিবিড়ভাবে খতিয়ে দেখছে তারা।

সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দাদের ধারণা, ইকবাল কিছুটা অপ্রকৃতস্থ ও মাদকাসক্ত হওয়ায় ষড়যন্ত্রকারী কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তাকে এ ভয়ঙ্কর অপকর্ম করার জন্য বেছে নিয়েছে। তাকে মাদক কিংবা অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে হয়তো এ কাজে সম্পৃক্ত করেছে। তাই কারা কিসের প্রলোভন দেখিয়ে ইকবালকে এ ধরনের ভয়ঙ্কর অপরাধে যুক্ত করেছে তা গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখছে তারা। গোয়েন্দারা আশাবাদী, কিসের বিনিময়ে ইকবালকে এ অপকর্মে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছিল তা জানা গেলে ঘটনার রহস্য অনেকটা পরিষ্কার হয়ে আসবে।

তবে ইকবালকে জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, পুজামণ্ডপে কোরআন শরিফ রেখে আসা এবং হনুমানের মূর্তির হাত থেকে গদা সরিয়ে নেয়ার কথা ইকবাল নিঃসংকোচে স্বীকার করলেও কে বা কারা তাকে দিয়ে এ কাজ করিয়েছে তা সুস্পষ্টভাবে এখনো জানায়নি। এমনকি ঘটনার আগে যে তিন ব্যক্তি তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করেছেন এবং এক সঙ্গে মাজারে যাতায়াত করেছেন তাদের ব্যাপারেও তিনি কোনো তথ্য দিচ্ছেন না। কখনো বলছেন, বহিরাগত ২/৩ জন তাকে এটা-ওটা খাইয়েছেন, গাঁজা-ইয়াবাও দিয়েছেন। তার সঙ্গে ধর্ম-অর্ধম, মাজার-মন্দির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। তবে তাদের চেহারা তার ভালো মনে নেই।

পুজামণ্ডপের ঘটনার ছায়া তদন্তে সম্পৃক্ত পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর একটি সূত্র জানায়, তারা ইকবালের কাছ থেকে ওই তিন ব্যক্তির চেহারার বর্ণনা শুনে তাদের চেহারার স্কেচ তৈরির চেষ্টা করছে। সুষ্ঠুভাবে এ কাজ সম্পন্ন করা গেলে তাদের চিহ্নিত করা যাবে। তারা স্থানীয় নাকি বহিরাগত এ বিষয়টিও পরিষ্কার হবে। এতে তদন্তের বড় এক ধাপ অগ্রগতি হবে।

এদিকে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট এ ঘটনার নেপথ্য মদদদাতারা কোনো জঙ্গি সংগঠনের সদস্য কিনা তাও খতিয়ে দেখছে। এ তৎপরতার অংশ হিসেবে তারা এ চক্রকে শনাক্ত করার চেষ্টা করছে। তাদের এ মিশনে সন্দেহভাজন ওই তিন ব্যক্তির পরিচয় নিশ্চিত করার বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভাষ্য, জঙ্গি গোষ্ঠীর বেশিরভাগ সদস্যের প্রোফাইল তাদের হাতে রয়েছে। ইন্ধনদাতাদের চিহ্নিত করা গেলে এ অপতৎপরতার নেপথ্য কারণ দ্রুত নিশ্চিত হওয়া যাবে।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ