ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলামি দলে নীরবতা কেন

প্রকাশনার সময়: ২৩ অক্টোবর ২০২১, ০৬:১৭ | আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০২১, ০৬:১৮

কুমিল্লার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারাদেশে ২৪টি জেলায় মন্দির, পূজামণ্ডপ ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনা ঘটেছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনাও ঘটেছে। এসব অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার সোচ্চার প্রতিবাদ করছেন দেশের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। তবে এসব ঘটনায় প্রকাশ্যে প্রতিবাদ বা মাঠের কোনো কর্মসূচিতে সরব হতে দেখা যায়নি বেশিরভাগ ইসলামি দলকে। গণসংযোগও করেনি। গণমাধ্যমে বিবৃতি ও নিন্দা জানিয়ে দায় সেরেছে দলগুলো।

যদিও নয়া শতাব্দীর সঙ্গে আলাপকালে দলগুলোর দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, কুমিল্লার ঘটনা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের একটি সুগভীর ষড়যন্ত্র। এই চেষ্টা ন্যক্কারজনক। এই ধরনের ঘৃণ্য অপকর্মের চেষ্টা দলমত নির্বিশেষে রুখে দিতে হবে। দাঁড়াতে হবে শান্তি ও সম্প্রীতির পক্ষে।

তারা বলছেন, রাজপথে বড় আকারে একত্রে সংগঠিত হলে পুনরায় সরকারের রোষানলে পড়তে পারে ইসলামি দলগুলো। তাই প্রতিবাদ সোচ্চার হওয়ার কথা থাকলেও গ্রেফতার ও পুরোনো মামলা সচল হওয়ার আতঙ্কে মাঠের কোনো কর্মসূচি দেয়া হয়নি। তবে দলের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন, প্রেস বিজ্ঞপ্তি ও তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিৃবতি দেয়া হয়েছে।

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, যারা সত্যিকারের ইসলামি দল তারা তো নীরব থাকতে পারে না। সত্যি বলতে সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে দেশের ইসলামি দলগুলো নীরব। জাতি পুড়ছে, সংখ্যালঘু যারা সংখ্যা ও শক্তিতে কম, তারা অত্যাচারিত হচ্ছে, কিন্তু তারা নেই। কারণ এ দলগুলো অন্তর্গত ও বাহ্যিকভাবে সাম্প্রদায়িক। তারা সাম্প্রদায়িকতা লালন-পালন করে। কর্মীদের জিহাদে অনুপ্রেরণা, সমর্থন ও প্রশিক্ষণ দেয়। দুর্গাপূজা ঘিরে পরিকল্পিতভাবে ঘটানো হয়েছে কুমিল্লার ঘটনা। যারা ঘটনা ঘটাচ্ছে এবং এর পেছনে তাদের মূল জায়গায় ধরছে না সরকার। দেশকে সাম্প্রদায়িকতা মৌলবাদ মুক্ত করতে হলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। মাদ্রাসা শিক্ষায় পরিবর্তন আনতে হবে। এছাড়া দেশের হাজার বছরের সংস্কৃতির ওপর আঘাত প্রতিহতে আইনের কঠোরতার বিকল্প নেই। সেই সঙ্গে প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন।

জানা গেছে, বাংলাদেশে নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত সব মিলিয়ে প্রায় ৭০টির মতো ইসলামি দল আছে। কিন্তু সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে তারা প্রথম থেকেই নিশ্চুপ। চরমোনাই হাতপাখা ছাড়া কোনো ইসলামি দলই প্রকাশ্যে প্রতিবাদ জানায়নি। জাতীয় প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ ইউনাইটেড ইসলামি পার্টি সংবাদ সম্মেলন করছে। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, নেজামে ইসলাম পার্টিসহ ইসলামী ঐক্যজোট নামে অসংখ্য দল সামনে আসছে না।

জানতে চাইলে ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব প্রিন্সিপাল হাফেজ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ বলেন, কুমিল্লার নানুয়াদীঘিরপাড় পূজামণ্ডপে মূর্তির পায়ের নিচে মহাগ্রন্থ আল কোরআন রেখে অবমাননার নিন্দা ও প্রতিবাদের ভাষা আমি হারিয়ে ফেলেছি। পবিত্র কোরআনের অবমাননা করে দেশে ধর্মীয় দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধানোর চক্রান্ত সবাই মিলে রুখে দিতে হবে।

তিনি বলেন, ৯২ ভাগ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যে নিরাপত্তা ও অতিমাত্রায় নাগরিক সুবিধা ভোগ করছে বিশ্বে এমন দৃষ্টান্ত নজিরবিহীন। তারপরও কিছু স্বার্থান্বেষী চিহ্নিত মহল বারবার ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর আঘাত করে সামাজিক ও ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্ট করার পাঁয়তারা করছে। কুমিল্লার ঘটনা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে। প্রশাসন যত দ্রুত ঘটনার মূল রহস্য ও পেছনের পরিকল্পনাকারীদের বের করতে পারবে ততই দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গল হবে।

একই বিষয়ে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী নয়া শতাব্দীকে বলেন, বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। যেখানে সব ধর্মের মানুষ নির্বিঘ্নে নিজ নিজ ধর্মীয় উৎসব পালন করে। সেখানে কুমিল্লার পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআনের অবমাননাকে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা বলে উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। আমরা মনে করি, এটি মুসলমান এবং বাংলাদেশে আবহমানকাল থেকে চলে আসা ধর্মীয় সম্প্রীতির ওপর পরিকল্পিত আঘাত।

তিনি আরো বলেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে পুরো ঘটনাটি গভীর এক ষড়যন্ত্র। চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের কোথাও কোনো পূজামণ্ডপে ভাঙচুর এবং সহিংসতা করা কাম্য নয়। কোনো প্রকার ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দেয়া থেকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিরত থাকতে হবে। প্রতিবাদকারী মুসলিম জনতার প্রতিবাদ হওয়া চাই সম্পূর্ণরূপে অহিংস ও শান্তিপূর্ণ।

জানতে চাইলে ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মাওলানা আবুল হাসানাত আমিনী নয়া শতাব্দীকে বলেন, একটি অশুভ মহল দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের চক্রান্ত করছে। দক্ষিণ এশিয়া মহাদেশে বাংলাদেশ হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এখানে সব ধর্মের লোক শান্তিতে ধর্ম-কর্ম এবং বাসবাস করছে। একটি অশুভ মহলের ইন্ধনে এ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনকে বিনষ্টের চক্রান্ত করছে।

তিনি আরও বলেন, কওমি মাদরাসার আলেম-উলামা ও ছাত্ররা শান্তিপ্রিয়। তারা কোনো ধরনের দাঙ্গা-হাঙ্গামায় জড়িত নয়। বর্তমানে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষ মহল সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা করে ইসলামপন্থিদের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। তাই চলমান পরিস্থিতিতে আলেম-উলামা ও ইসলামী ঐক্যজোটের নেতাকর্মীদের কোনো ধরনের ফাঁদে পা না দিয়ে সতর্ক ও সজাগ থাকাতে দলের পক্ষ আহ্বান জানানো হয়েছে।

ইসলামি আন্দোলনের যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান নয়া শতাব্দীকে বলেন, সম্প্রতি সাম্প্রদায়িক ঘটনাগুলো পরিকল্পিত। যারা কোরআন অবমাননার ঘটনা ঘটিয়েছে তারা ধর্মীয় বিদ্বেষের কারণে নয়, এদের উদ্দেশ্য দেশকে অস্থিতিশীল করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলা। দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করা। কিন্তু হাজার বছরের সম্প্রীতি মতলববাজদের একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনায় বিনষ্ট হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।

তিনি আরো বলেন, প্রথম দিন থেকেই আমরা সোচ্চার ছিলাম। সারাদেশে দলের নেতাকর্মীরা এই ধরনের অপকর্মে থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। বাংলাদেশ সম্প্রীতির দেশ। ফলে ইসলামি আন্দোলন চায় দেশের সব ধর্মের মানুষ একত্রে মিলেমিশে সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়তে চায়।

বাংলাদেশ ইউনাইটেড ইসলামী পার্টির চেয়ারম্যান মাওলানা ইসমাইল হোসাইন বলেন, সব ধর্মের মানুষের সঙ্গে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ বজায় রেখে একে অপরের বিপদাপদে এগিয়ে আসাই আমাদের শান্তির ধর্ম ইসলাম ও রাসুলের (সা.) শিক্ষা। বিদায় হজের ভাষণে মহানবীর (সা.) সুস্পষ্ট ঘোষণা ছিল- মানুষের সঙ্গে মানুষের মাতৃতুল্য সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। কোনো প্রকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা অশান্তি সৃষ্টি করতে তিনি কঠোরভাবে বারণ করে গেছেন।

তিনি বলেন, সম্প্রতি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার যে ঘটনা ঘটানো হয়েছে তা ষড়যন্ত্র ও দেশের ভেতরে অশান্তি করার জন্য হয়েছে। সরকারকে বিপদে ফেলতে, দেশে অশান্তি তৈরি করতে এটি করা হয়েছে।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ