ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কুমিল্লার ঘটনা: সামনে ইকবাল পেছনে কে?

প্রকাশনার সময়: ২২ অক্টোবর ২০২১, ১৬:৫৫
অভিযুক্ত ইকবাল

কুমিল্লায় একটি পূজামণ্ডপে কোরআন রাখার ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছিল, সেই ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ দেখে প্রধান সন্দেহভাজন ইকবাল হোসেনকে কক্সবাজারের সুগন্ধা সৈকত এলাকা থেকে গ্রেফতার করে রাতেই কুমিল্লা জেলা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম।

এর আগে নানুয়া দীঘির সেই পূজামণ্ডপের আশপাশে বিভিন্ন ভবনে থাকা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে ইকবালকে শনাক্ত করা হয়।

পুলিশের ভাষ্য, এই ইকবালই মণ্ডপে পবিত্র কোরআন রেখেছিলেন। বারবার অবস্থান পাল্টানোয় গত কিছুদিন চেষ্টা করেও ইকবালকে গ্রেপ্তার করা যাচ্ছিল না। ইকবাল গ্রেপ্তার হলেও ঠিক কার মদদে তিনি মণ্ডপে পবিত্র কোরআন রেখে এসেছিলেন তা এখনো জানা যায়নি।

ইকবালের মা আমেনা বিবি জানান, গত ১৩ অক্টোবর পূজামণ্ডপে কোরআন উদ্ধারের পর থেকে তার ছেলে বাড়ি ফেরেনি। এর মধ্যে ইকবালের সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগও ছিল না। ঘটনার জন্য ইকবাল দায়ী হলে তার বিচার হোক। কয়েক বছর ধরে ইকবাল মানসিক ভারসাম্যহীন বলেও দাবি করেন তিনি।

যেভাবে ধরা পড়লো ইকবাল

কক্সবাজারের চৌমুহনী সরকারি এস এ কলেজের ব্যবস্থাপনা বিষয়ের মাস্টার্সের ছাত্র অনিক রহমান দাবি করেন, আমি, বন্ধু মেহেদী হাসান মিশু ও সাইফুল ইসলাম সাইফ মিলে ইকবালকে ধরিয়ে দিয়েছি।

ওই তিন জনকে ছাত্রলীগের কর্মী বলে নিশ্চিত করেছেন নোয়াখালী জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আসাদুজ্জামান।

এদিকে ওই তিনজন ছাত্রলীগ কর্মীর তথ্যের ভিত্তিতে কুমিল্লা ও কক্সবাজার পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে ইকবালকে ধরা হয় বলে নিশ্চিত করেছেন নোয়াখালীর (বেগমগঞ্জ সার্কেল) এএসপি শাহ ইমরান।

তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ছাত্রলীগ কর্মী অনিক ও মিশু আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে ইকবালের তথ্য দেন। তারা ইকবালকে ধরিয়ে দিতে সহায়তা চান। পরে আমি কুমিল্লা ও কক্সবাজারের পুলিশের সঙ্গে ইকবালকে গ্রেফতারের জন্য যোগাযোগ করি।

ইকবালকে গ্রেফতারের ঘটনা বলতে গিয়ে ছাত্রলীগ কর্মী অনিক বলেন, ১৯ অক্টোবর সোমবার রাতে বন্ধু মেহেদি হাসান মিশু ও ঢাকার তিন ব্যবসায়ী বন্ধু রায়হান, মামুন ও হৃদয়সহ পাঁচ জন কক্সবাজারে বেড়াতে যাই। ২০ অক্টোবর বৃহস্পতিবার সকালে সেখানে থাকা আরেক বন্ধু সাইফুল ইসলাম সাইফ আমাদের সঙ্গে যোগ দেন। এরপর বিকাল ৪টায় দরিয়ানগরে ঘুরতে বের হই। সেখানে ছয় বন্ধু মিলে সময় কাটাতে গান গাওয়ার সময় ইকবালও পাশে এসে গানে সুর মেলায়। এরপর ওই রাতে টেলিভিশনে এবং ফেসবুকে ছবি দেখে ইকবালের বিষয়ে নিশ্চিত হই।

ছাত্রলীগ কর্মী মেহেদী হাসান মিশু বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে তারা সুগন্ধা পয়েন্টে গেলে ইকবালের সঙ্গে তাদের আবার দেখা হয়। তখন আমরা তার সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলি। একপর্যায়ে সে পালিয়ে যেতে চাইলে তাকে নাশতা ও সিগারেট খাইয়ে কৌশলে আটকে রাখি। এ সময় তার নাম জানতে চাইলে সে ইকবাল বলে জানায়। তখন আমরা কৌশলে তার ছবি তুলে নোয়াখালীর এএসপির সঙ্গে যোগাযোগ করি ও ছবি পাঠাই। তিনি আমাদের কুমিল্লার পুলিশ সুপারের মোবাইল নম্বর দেন। এরপর কুমিল্লার পুলিশ সুপারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ছবি পাঠাই। তিনি কক্সবাজারের পুলিশ সুপারকে বিষয়টি অবহিত করেন। পরবর্তীতে রাত সাড়ে ১০টায় পুলিশ এসে ইকবালকে আটক করে নিয়ে যায়।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যা বললেন...

এর আগে সচিবলায়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘কুমিল্লার ঘটনাটি যে লোকটি করেছেন, তাকে সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে চিহ্নিত করা হয়েছে। তিনি মাজার লাগোয়া মসজিদে রাত ৩টার দিকে গিয়েছিলেন। একবার বা দুবার নয়, তিনবার গিয়েছিলেন। ওই মসজিদের দুজন খাদেম ছিলেন, তাদের সঙ্গে ইকবাল কথা বলেছেন।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমাদের অভিজ্ঞ টিম দীর্ঘ সময় এটা বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হয়েছে যে এই ব্যক্তি (ইকবাল) মসজিদ থেকে পবিত্র কোরআন শরিফ এনে সেখানে রেখেছেন। এরপর তিনি প্রতিমার গদাটি কাঁধে করে নিয়ে গেছেন। কাজটি পরিকল্পনামাফিক করা হয়েছে। দুই থেকে তিনবার যাওয়া-আসার মধ্য দিয়ে তিনি এই কাজটি করেছেন। কারও প্ররোচনা ছাড়া তিনি এটি করেছেন বলে তদন্তকারীরা মনে করেন না। ইকবাল হোসেন মোবাইল ব্যবহার করছেন না। যারা তাকে পাঠিয়েছিলেন, তারাও তাকে লুকিয়ে রাখতে পারেন। তবে বের করার সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে।’

তবে কুমিল্লা জেলা পুলিশ বলেছে, ইকবালের বাড়ি কুমিল্লা নগরীর উত্তর-পূর্ব দিকের সুজানগরে। তিনি ওই মহল্লার নূর আহমদের ছেলে। মাজারে মাজারে ঘোরেন। তিনি একজন ভবঘুরে প্রকৃতির মানুষ। তার কোনো রাজনৈতিক পরিচয় মেলেনি। পেশায় রং মিস্ত্রি। গ্রেপ্তারের আগে ইকবাল ঘন ঘন অবস্থান পরিবর্তন করেন। বেশিরভাগ সময় তার অবস্থান সীমান্ত এলাকায় দেখা গেছে।

ইকবাল সম্পর্কে স্থানীয়দের মতামত

অভিযুক্ত ইকবাল হোসেন সম্পর্কে স্থানীয়রা জানান, তিনি বেশিরভাগ সময় মাজারেই পড়ে থাকেন। মাজারের ভক্তদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। তাদের সঙ্গে ইকবালকে প্রায়ই দেখা যায়। পরিবারে মা-বাবা ছাড়াও দুই ভাই রয়েছে ইকবালের। ওই দুই ভাইও ভবঘুরে প্রকৃতির। রায়হান নামের এক ভাইকে স্থানীয় কাউন্সিলরের সঙ্গে দেখা যায়। ৩৫ বছর বয়সী ইকবাল দুটি বিয়ে করেছেন। প্রথম স্ত্রীর বাড়ি বরুড়ার কচুয়ায়। ওই ঘরে ইকবালের একটি ছেলে রয়েছে। প্রথম স্ত্রী চলে যাওয়ার পরে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার সুয়াগাজী এলাকায় দ্বিতীয় বিয়ে করেন ইকবাল। এই ঘরে তার একটি মেয়ে রয়েছে। স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় দ্বিতীয় স্ত্রীও বাবার বাড়ি চলে গেছেন। তিনি ইকবালের নামে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে মামলাও করেছেন।

কিছু প্রশ্ন পূজা উদ্‌যাপন পরিষদের

এদিকে বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ কুমিল্লার নানুয়া দীঘির দুর্গাপূজার মণ্ডপে হামলা, ভাঙচুরের সৃষ্ট ঘটনা নিয়ে কিছু প্রশ্ন তুলেছেন।

শুক্রবার সকালে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ পূজা উদযাপনপরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মল কুমার চ্যাটার্জী সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, কুমিল্লা নানুয়া দীঘিরপাড়ের মণ্ডপটি অস্থায়ী। ওই দিন দিবাগত রাত তিনটা থেকে চারটার দিকে কিছু সময়ের জন্য মণ্ডপ এলাকা বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কী কারণে কিছু সময়ের জন্য মণ্ডপ বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, সে বিষয়গুলো তদন্তের আওতায় আনা হয়েছে কি না? থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হনুমান মূর্তির কোলের ওপর রাখা পবিত্র কোরআন শরিফটি সরিয়ে নেওয়ার পর কেন ভিডিও করার সুযোগ দিলেন এবং কেন সে ভিডিও ভাইরাল হয়েছে? এই বিষয়টি সবার কাছে বিরাট প্রশ্ন হিসেবে দেখা দিয়েছে।

নির্মল চ্যাটার্জী আরও বলেন, ‘দুর্গাপূজার আগে ৪ অক্টোবর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ৬ অক্টোবর ডিএমপি কমিশনার, পুলিশের মহাপরিদর্শকের সঙ্গে আমাদের মতবিনিময় হয়। প্রতিটি সভায় বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বা প্রতিনিধি, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। প্রত্যেকে স্ব-স্ব অবস্থানে থেকে মতামত দিয়েছেন প্রতিটি সভায় নিরাপত্তার বিষয় নিয়ে আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছিল।’

নির্মল চ্যাটার্জী বলেন, দেশে আইন আছে। প্রকৃতই কোনো ব্যক্তি, সে যে ধর্মেরই হোক না কেন, এ ধরনের ন্যক্কারজনক অপরাধ করলে তাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে তুলে না দিয়ে একজনের কথিত অপরাধে একটি সম্প্রদায়ের ওপর হামলা প্রকারান্তরে এ দেশের হিন্দু সম্প্রদায়কে দেশান্তরি করার নীলনকশার অংশ বলে সাধারণ হিন্দুরা মনে করে।

নয়া শতাব্দী/এম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ