পটুয়াখালীর দশমিনায় আলীপুর গ্রামের বাসিন্দা কানন বালা। ২০১৭ সালের ৮ মে সকালে বিধবা কানন বালাকে হাত-পা বেঁধে নির্যাতন চালায় স্থানীয় আবুল হোসেন প্যাদা ও তার সহযোগীরা। এ ঘটনায় কানন বালার ছেলে অসীম চন্দ্র দাশ বাদী হয়ে ওই বছর ১১ মে দশমিনা থানায় ১৪ জনের নামে মামলা দায়ের করেন। এর নয়দিনের মাথায় আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদশর্ক ইউনুচ আলী হাওলাদার। দীর্ঘ চার বছরেও বিচার পাননি কানন বালা। উল্টো আসামিদের হুমকিতে তটস্থ নির্যাতিত সংখ্যালঘু পরিবারটি।
শুধু কানন বালা নন। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সারাদেশে ৩২টি মামলা হয়েছিল। এসব মামলার একটিতেও রহস্য বের হয়নি। যে কারণে বিচারও শেষ হয়নি। ইতোমধ্যে জামিন নিয়ে পালিয়ে গেছে এসব মামলার অনেক আসামি। এরইমধ্যে ১৭ মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে দুটিতে। অভিযোগপত্র দেয়ার পরও তিনটিতে সমঝোতা হয়েছে। ১০টি মামলার তদন্ত এখনো চলছে। এছাড়া ৯ বছর আগে কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর হামলার চাঞ্চল্যকর ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাগুলোর বিচারও থমকে আছে।
জানতে চাইলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের স্পর্শকাতর মামলাগুলোর বিচারকাজ দীর্ঘদিনেও শেষ না হওয়ার অন্যতম কারণ হলো ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন না হওয়া। আর রহস্য উদ্ঘাটন না হওয়ার মূল কারণ হলো, পরিকল্পনাকারী বা নেপথ্য নায়করা ধরা না পড়া। যারা গ্রেফতার হয় তারা প্রকৃত অপরাধীর নাম বলে না। অনেক সময় দেখা যায়, যাদের নাম বলে তারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়। এছাড়া পরিকল্পনাকারী থেকে বাস্তবায়নকারী পর্যন্ত কয়েকটি স্তর থাকে। যেসব হামলাকারী গ্রেফতার হয় তাদের কাছে পরিকল্পনাকারীদের বিষয়ে কোনো তথ্য থাকে না।
স্পর্শকাতর এসব মামলাতে কেন সমঝোতা হচ্ছে জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিনে বিচারকাজ শেষ হওয়ার কারণে বাদীপক্ষের মধ্যে এক ধরনের হতাশা থাকে। আর আসামিপক্ষ আপসের জন্য চাপ দিতে থাকে। একপর্যায়ে বাদী পক্ষ মনে করে, ‘দীর্ঘদিনেও যেহেতু বিচার হচ্ছে না, কবে বিচার পাব তার ঠিক নেই। যেহেতু এলাকায় থাকতে হবে, তাই আর তিক্ততা না বাড়িয়ে সমঝোতা করে ফেলাই ভালো।’ এ ধরনের ধারণা থেকে সমঝোতা হচ্ছে বলে পুলিশ কমিশনার মনে করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রামুর ১২টি বৌদ্ধ বিহার ও বৌদ্ধপল্লীতে একযোগে অগ্নিসংযোগ ও হামলার ঘটনা ঘটে। পর দিন একই ঘটনার জের ধরে উখিয়া এবং টেকনাফে আরো ৭টি বৌদ্ধ বিহার পুড়িয়ে দেয়া হয়। এসব ঘটনায় রামু, উখিয়া ও টেকনাফে ১৯টি মামলা হয়। এর মধ্যে রামু থানায় আটটি, উখিয়ায় সাতটি, টেকনাফে দুটি ও কক্সবাজার সদর থানায় দুটি মামলা হয়। এসব মামলার মধ্যে রামু থানায় সুধাংশু বড়ুয়ার করা মামলাটি দুই পক্ষের আপস-মীমাংসার ভিত্তিতে খারিজ করে দেন আদালত। বাকি ১৮টি মামলার অভিযোগপত্রে ১৫ হাজার ১৮২ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। কিন্তু এখনো শেষ হয়নি বিচার কার্যক্রম। অন্যদিকে বেশিরভাগ আসামিই ইতোমধ্যে জামিন পেয়েছেন। জামিনপ্রাপ্তদের মধ্যে চার শতাধিক আসামি পলাতক।
এ বিষয়ে কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম বলেন, যথাসময়ে সাক্ষীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা সম্ভব না হওয়ায় বিচার কার্যক্রম পিছিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, বেশিরভাগ মামলার সাক্ষীদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যাদের পাওয়া যায় তাদের অনেকে আবার আসামির পক্ষে কথা বলায় চিহ্নিত হচ্ছেন ‘বৈরী সাক্ষী’ হিসেবে।
জানা যায়, ২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার চরকাঁকড়া এলাকার রাধাকৃষ্ণ সেবাশ্রমে কীর্তনানুষ্ঠানে হামলা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় তৎকালীন কোম্পানীগঞ্জ থানার এসআই সৈকত দাশ গুপ্ত বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। মামলায় ১৭ জনকে এজাহারভুক্ত ও অজ্ঞাত ৪০-৪২ জনকে আসামি করা হয়। মামলাটিতে অভিযোগপত্র দেয়া হলেও শেষ হয়নি বিচার কাজ। এরই মধ্যে সব আসামি জামিন পেয়েছেন।
সূত্র জানায়, পটুয়াখালীর দশমিনায় কানন বালা নির্যাতনের মামলার বিচার চার বছরেও শেষ হয়নি। উল্টো আসামিদের অব্যাহত হুমকিতে আছে নির্যাতিত সংখ্যালঘু পরিবারটি। উপজেলার আলীপুর গ্রামে ২০১৭ সালের ৮ মে সকালে বিধবা কানন বালাকে হাত-পা বেঁধে নির্যাতন চালায় স্থানীয় আবুল হোসেন প্যাদা ও তার সহযোগীরা। এ ঘটনায় কানন বালার ছেলে অসীম চন্দ্র দাশ বাদী হয়ে ওই বছর ১১ মে দশমিনা থানায় ১৪ জনের নামে মামলা দায়ের করেন। এর নয় দিনের মাথায় আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক ইউনুচ আলী হাওলাদার। কিন্তু এখনো বিচার পাননি কানন বালা।
জানা যায়, ২০১৫ সালের ৯ আগস্ট নীলফামারীর জলঢাকায় শিক্ষক মাধব চন্দ্রকে ফিল্মি স্টাইলে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয়। নিহতের ভাই রতন লাল জানান, স্পর্শকাতর হত্যাকাণ্ড বিবেচনায় সরকার বাদী হয়ে মামলা করেছে। এর তদন্তভার সিআইডির ওপর ন্যস্ত আছে। তদন্তের কোনো আপডেট তাকে জানানো হচ্ছে না। এ ঘটনার পর ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর ব্র্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দুদের ১৫টি মন্দির, শতাধিক বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় আটটি মামলা হয়। এর মধ্যে একটি মামলায় অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। বাকি মামলাগুলোর তদন্তই শেষ হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাসিরনগর উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি অনাথ বন্ধু দাস বলেন, বিচার না হওয়ার কারণেই আমাদের এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে হচ্ছে। আমরা নাসিরনগরের ঘটনার দ্রুত বিচার দেখতে চাই।
ঝালকাঠি থানার দায়ের হওয়ার একটি মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালের ১৬ নভেম্বর স্থানীয় কালীবাড়ি নাট মন্দিরে শ্রী শ্রী কার্তিক পূজা চলাকালে হামলার ঘটনা ঘটে। ২০১৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি পুলিশ এ মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সমাধিস্থল ভাঙচুরের অভিযোগে ২০১৬ সালে ৩০ অক্টোবর ঝালকাঠির নলছিটি থানায় একটি মামলা হয়। এ মামলায় পুলিশ অভিযোগপত্র দিলেও এতে বলা হয়, সমাধিস্থল ভাঙচুরের অভিযোগটি মিথ্যা। জমিজমার বিরোধকে ঘিরে মামলাটি হয়েছিল।
এ ঘটনার পর ২০১৭ সালের ৩ জুলাই মাধবপুরের কাশিমপুর গ্রামে এক হিন্দু বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। বাড়ির মালিক সুনীল চন্দ্র পাল বাদী হয়ে মাধবপুর থানায় একটি মামলা করেন। মামলাটি এখন হবিগঞ্জ চিফ জুডিসিয়াল আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। জানতে চাইলে মামলার বাদী সুনীল চন্দ্র পাল জানান, আমার বাড়ি দখল করতে হামলা চালানো হয়েছিল। এখন লোকমুখে শুনেছি, তারা আবার আমার বাড়ি দখল করতে পারে। তাই ভয়ে আছি।
২০১৭ সালের ১ জুন রাঙামাটির লংগদু উপজেলার যুবলীগ নেতা নুরুল ইসলাম নয়নের লাশ খাগড়াছড়ির দীঘিনালা থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। পরদিন নয়নের লাশ নিয়ে লংগদুতে মিছিল বের করা হয়। পরে আশপাশের পাহাড়িদের বাড়িঘরে হামলা ও আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে পাহাড়িদের ২১৮টি বাড়িঘর আগুনে ভস্মীভূত হয়। এ ঘটনায় তিনটি মামলা হয়। দুইটি মামলায় অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষে বাদী হয়ে কিশোর কুমার চাকমার করা মামলার তদন্ত এখনো চলছে।
কুমিল্লার চান্দিনা থানা পুলিশ জানায়, ধর্মপালনে বাধা দেয়া, মন্দিরে হামলা, মূর্তি চুরি এবং চাঁদা দাবির অভিযোগে কুমিল্লার চান্দিনা থানায় ২০১৮ সালের ১৬ মার্চ একটি মামলা হয়েছিল। অভিযোগের সত্যতা না পাওয়ায় মামলাটিতে এরই মধ্যে ফাইনাল রিপোর্ট দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে। কুমিল্লার তিতাসের আলোচিত সেই সংখ্যালঘু পরিবারের ওপর হামলা-ভাঙচুরের মামলাটি জনপ্রতিনিধিদের সহায়তায় মীমাংসা করা হয়েছে। ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে উপজেলার ভিটিকান্দি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আবুল হোসেন মোল্লার নেতৃত্বে স্থানীয় জনগণকে নিয়ে ওই ঘটনা ও মামলার মীমাংসা করা হয়। একই বছরে মহানবী হজরত মোহাম্মদকে (সা.) অবমাননার ঘটনায় ২০১৭ সালের ৬ নভেম্বর টিটু রায় নামের একজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে টিটুর ফাঁসির দাবিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ করা হয়। মামলাটিতে অভিযোগপত্র দেয়া হলেও এখনো বিচারকাজ শেষ হয়নি। অন্যদিকে ঘটনার পর গ্রেফতারকৃত ৪০ জনের সবাই জামিন পেয়ে গেছেন বলে রংপুর জেলা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আব্দুল মালেক জানিয়েছেন।
বগুড়ার শাহজাহারপুর থানার ওসি আব্দল্লাহ আল মামুন জানান, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে ভাংচুর এবং হামলার ঘটনায় তার তানা এলাকায় ২০১৫ সালে তিনটি মামলা হয়। মামলাগুলোতে এরই মধ্যে চার্জশিট দেয়া হয়েছে। সব মামলাই বিচারাধীন রয়েছে।
নয়া শতাব্দী/এমআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ