সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলার ঘটনায় দেশজুড়ে বাড়ছে উদ্বেগ। ঘটনার সূত্রপাত গত ১৩ অক্টোবর কুমিল্লায়। এরপর টানা চার দিন নোয়াখালী, ফেনী, কক্সবাজার, বান্দরবান, সিলেট, চাঁদপুর, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় মন্দির, পূজাম-প ও ঘরবাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ গত রোববার রাতে রংপুরের পীরগঞ্জে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় একটি প্রশ্নই সামনে এসে দাঁড়িয়েছে _ হামলার নেপথ্যে কারা?
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে নেপথ্যের কুশীলবদের তথ্য না মিললেও অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার সোচ্চার প্রতিবাদ করছেন দেশের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। প্রতিবাদ জানিয়ে দেশের বিশিষ্টজনরা বলছেন, হামলার নেপথ্য নায়কদের খুঁজে বের করে দ্রুত কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। অপরাধীরা যে দল বা মতেরই হোক না কেন_ ঘটনার সঠিক তদন্ত ও জড়িতদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে ‘সৃষ্ট ক্ষত’ কিছুটা সারিয়ে তোলা সম্ভব হবে। অন্যথায় ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকানো যাবে না।
দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে জাতি-গোত্র-পেশার পরিচয় মুখ্য ছিল না। হতে হয়নি বিশেষ কোনো ধর্মেরও। সবাই বাংলাদেশি। একাত্তরে ব্যক্তি পরিচয়ের চেয়ে সমষ্টির মুক্তির স্বপ্ন এক করেছে মানুষকে। কিন্তু এই গৌরবের আলোর নিচে রামু, নাসিরনগর, শাল্লা কিংবা সবশেষ কুমিল্লা-নোয়াখালীর সাম্প্রদায়িক হামলা। কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হতাশ, ক্ষুব্ধ বিশিষ্টজনরা রাজনীতি ও সমাজে সূক্ষ্ম পরিবর্তনগুলোর দিকেও খেয়াল রাখার পরামর্শ দিয়েছেন।
জানতে চাইলে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, ধর্মকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে যারা উগ্রবাদ ও সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে, তারা আদৌ কোনো ধর্মীয় কাজ করছে না। ধার্মিক কোনো হিন্দু কখনোই তার মন্দিরে কোরআন শরিফ নিয়ে যাবেন না। একইভাবে ধর্মভীরু কোনো মুসলমানও এ কাজ করতে পারবেন না। এসব ন্যক্কারজনক কাজ যারা করেছে, তারা কেউই ধার্মিক নয়, সবাই দুর্বৃত্ত। এই দুর্বৃত্তদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া এই মুহূর্তে খুব জরুরি।
তিনি বলেন, কেবল কয়েকজনকে শাস্তি দিলেই কাজ হবে না। কেন এই অপ্রত্যাশিত ও অভাবনীয় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটল, তার কারণ খুঁজে বের করা প্রয়োজন। কারণ, এর শিকড় অনেক গভীরে। আমার মতে, মূলত তিনটি কারণে এসব ঘটনা ঘটছে। প্রথমত রাজনৈতিক অবস্থা, দ্বিতীয়ত আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা আর তৃতীয়ত সাংস্কৃতিক দৈন্য।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আরো বলেন, মন্দির-বাড়িঘরে হামলার ঘটনা অবশ্যই রাজনৈতিক ঘটনা। আমি মনে করি, দেশে এখন রাজনৈতিক শূন্যতা বিরাজ করছে। রাজনৈতিক অন্তঃসারশূন্যতা মানুষকে নিরাপত্তাহীন করে তুলছে। এখানে নির্বাচন হয় বটে, তবে তা অর্থবহ নির্বাচন নয়। রাজনীতির নামে ক্ষমতার কাড়াকাড়ি চলে। ধর্মীয় এমন সহিংস ঘটনার পর সরকার বলছে, এ কাজ বিএনপি ও সরকারবিরোধীরা করেছে। সরকারবিরোধীরা বলছে, এ ঘটনায় সরকার জড়িত। একে অপরের দোষ দেয়ার এই পাল্টাপাল্টিতে আসল দোষী পার পেয়ে যাবে।
তিনি আরো বলেন, এবারের সহিংসতার ঘটনায় প্রকৃতই জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা। আগের ঘটনাগুলোর কোনো বিচার না হওয়ায় এমন সন্ত্রাস, সহিংসতা বারবার ঘটছে। তাই বিচারের দৃষ্টান্ত রাখা দরকার। সঙ্গে রাজনৈতিক অবস্থা বদলাতে হবে। গণতন্ত্রের অনুশীলন ও চর্চা না বাড়ালে সহনশীলতা কমতে থাকবে। ফলে দেশে গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দরকার।
জানতে চাইলে লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ নয়া শতাব্দীকে বলেন, বেশিরভাগ মানুষই মনস্তত্ত্বের দিক দিয়ে সাম্প্রদায়িক। ১৯৭১ সালে এটি চাপা পড়েছিল। তারপর এটি আস্তে আস্তে উজ্জীবিত হচ্ছে। ১৯৭৫-এর পরে এটি আরো বেগবান হয়েছে। তিনি আরো বলেন, ক্ষমতাসীন বা বিরোধী দল_ মূলত সব রাজনৈতিক দলই সাম্প্রদায়িক। আর এর বাইরে কিছু দল আছে যেমন জামায়াতে ইসলামী, হেফাজত_ এরা হচ্ছে মৌলবাদী দল। আমি মনে করি তাদের চেতনাটা আলাদা, গুলিয়ে ফেলা যাবে না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ভোট এবং রাজনীতির জন্য ধর্মকে ব্যবহার করে। কিন্তু বাগড়ম্বর করে অনেক বেশি।
এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল নয়া শতাব্দীকে বলেন, আজ শুধু হিন্দু জনগোষ্ঠী না, যারা শুভবুদ্ধির মানুষ, যারা অসাম্প্রদায়িক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ দেখতে চেয়েছিল_ তারা প্রত্যেকে আজকে শঙ্কিত, উদ্বিগ্ন, লজ্জিত। স্বাধীন দেশে বিশেষত ১৯৭৫-এর পর থেকে এমন কোনো বছর খুঁজে পাওয়া মুশকিল যে বছর ধর্মীয়, জাতিগত পরিচয়ে হামলায় মানুষ কান্না করেনি।
তিনি বলেন, ’৬০-’৭০-এর দশকে আমরা দেখেছি শত শত মানুষ ঘটনা ঘটানোর জন্য নয়, ঘটনা বন্ধ করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সেটা না হয়ে এখন উল্টো ঘটনা ঘটছে। তার অর্থ হচ্ছে_ যারা এই সমাজটাকে বদলানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন, যারা জনগণের সুরক্ষা দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তারা সেই কাজে নিজেদের যোগ্য করে তুলতে পারেননি।
অভিনয় অঙ্গনের জ্যেষ্ঠ শিল্পী আবুল হায়াত বলেন, সম্প্রতি দেশজুড়ে যে সহিংসতা দেখলাম, তাতে আমি লজ্জিত। এসব খুবই লজ্জাজনক ঘটনা। তবে এসবে কার কী স্বার্থ, তা বের করা দরকার। যারা রাজনীতি করেন, তারাই এসব বের করতে পারেন, ভালো বুঝতে পারেন। আমরা চাই, সরকার গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টাকে দেখবে। এ ক্ষেত্রে সরকারেরই দায়িত্ব সর্বপ্রথম। রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বও কম না।
তিনি বলেন, সব রাজনৈতিক দলের উচিত সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এ ধরনের সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসা। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশের যে সুনাম ছিল, এসব সহিংসতা দিয়ে তা নষ্ট করার চেষ্টা চলছে। অনেকে বলবেন, মানুষবিদ্বেষী হয়ে উঠছে, কিন্তু আমার তো মনে হয় মানুষকে বিদ্বেষী করার চেষ্টা করা হচ্ছে। আবুল হায়াত আরো বলেন, জনসাধারণের কথা তো আমরা ভুলে গেছি। যারা ওপরতলায় থাকেন, তারা তো নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। জনসাধারণকে গণ্য করতে হবে, তাদের বুঝতে হবে। জনসাধারণের সঙ্গে রাজনৈতিক দল, সামাজিক আন্দোলনকারী সবাই যদি ঘনিষ্ঠভাবে মেশেন এবং সবাইকে বোঝান, এর চেয়ে ভালো কিছু আর হতে পারে না।
নয়া শতাব্দী/এমআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ