দেশের ২৬ জেলায় নতুন করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক করা হয়েছে। এসব জেলায় পুলিশি টহলের পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে। স্থানীয় জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে এবং জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতা নিয়ে যে কোনো অপ্রীতিকর ও বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে বলা হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত-হেফাজতঅধ্যুষিত ওইসব এলাকায় কমিউনিটি পুলিশিংও জোরদার করার তাগিদ দিয়েছে সরকার।
গতকাল মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এসব হামলার পেছনে বিদেশি কোনো সংস্থার হাত রয়েছে কিনা তাও খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পুলিশের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা জানান, কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে পবিত্র গ্রন্থকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট বিবাদের জের ধরে তৃতীয় একটি পক্ষ দেশকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে গত কয়েকদিনে বিভিন্ন জায়গায় পূজামণ্ডপে হামলার পর সর্বশেষ গত রোববার রাতে রংপুরে সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি-দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে।
নতুন করে এ ধরনের হামলার আশঙ্কা না থাকলেও সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ভীতি বিরাজ করছে। বিশেষ করে হেফাজতে ইসলাম ও জামায়াত-শিবিবেরর ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত জেলাগুলোতে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা অস্বস্তিতে রয়েছে। অজানা ভয়ে সেখানে অনেকে নির্ঘুম রাত পার করছে। এসব বিষয়াদি সার্বিকভাবে পর্যালোচনা করে পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত দেশের ২৬ জেলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যাতে কেউ কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা কিংবা কোনো ধরনের ভীতি ছড়ানোর অপচেষ্টা চালানো মাত্র তাকে আইনের আওতায় আনা যায়।
এছাড়া ফেসবুক-ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা অন্য কোনোভাবে কেউ যাতে কোনো গুজব ছড়িয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে না পারে সে ব্যাপারেও পুলিশের সাইবার ইউনিটকে সতর্ক করা হয়েছে।
জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে: ঝিনাইদহ, কুড়িগ্রাম, সাতক্ষীরা, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফেনী, মুন্সীগঞ্জ, মাদারীপুর, কক্সবাজার, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, পাবনা, বাগেরহাট, চাঁদপুর, মাগুরা, পঞ্চগড়, রংপুর, শরীয়তপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সিলেট, কুষ্টিয়া ও নরসিংদী।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, আগামী ১০ দিন এ বাড়তি সতর্কতা চলমান থাকবে। এ সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলে ধাপে ধাপে আইনৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল ও গোয়েন্দা নজরদারি কমিয়ে আনা হবে। আর পরিস্থিতি স্বাভাবিক অনুমেয় না হলে বিশেষ সতর্কতার মেয়াদ আরো বাড়বে। অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক শান্তি বিনষ্টের জন্য কোনো বিশেষ চক্র বা গোষ্ঠী যাতে নতুন করে ভীতি ছড়াতে না পারে এজন্য বিভিন্ন পর্যায়ে নজরদারি বাড়াচ্ছে গোয়েন্দারা। যাতে এ ধরনের ষড়যন্ত্রের নীলনকশা তৈরি করার সময়ই তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা যায়।
পঞ্চগড় জেলার পুলিশ সুপার মো. ইউসুফ আলী জানান, পুলিশ পুরো বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়েছে। কেউ যেন কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম দিতে না পারে সেজন্য প্রতিটি থানাকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় সাদা পোশাকে গোয়েন্দারা কাজ করছেন।
একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রের তথ্যানুযায়ী, জাতীয় নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীরা তত বেশি অপতৎপরতা শুরু করেছে। সম্প্রতি জামায়াতের উচ্চপর্যায়ের কয়েক নেতা গ্রেফতার হওয়ার পর তাদের কাছ থেকে দেশে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরির বিভিন্ন পরিকল্পনার তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে, গত বুধবার থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মন্দির, স্থাপনা ও বাড়ি-ঘরে হামলার ঘটনায় মঙ্গলবার পর্যন্ত ৭১টি মামলা হয়েছে। আরো কিছু মামলা রুজু প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সোমবার রাত পর্যন্ত এসব মামলায় ৪৫০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এসব ঘটনায় জড়িত বিপুলসংখ্যক দুষ্কৃতিকারী এখনো পলাতক রয়েছে। তাদের ধরতে বিভিন্ন জেলায় সাঁড়াশি অভিযান চলছে।
এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা বিভিন্ন ধরনের উসকানিমূলক পোস্ট ও ভিডিও ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ানোর চেষ্টা করছে এসব সাইবার অপরাধীরও একটি বিশাল তালিকা তৈরি করে র্যাব-পুলিশ গ্রেফতার অভিযানে নেমেছে। পুলিশের দাবি গ্রেফতারকৃতদের রাজনৈতিক পরিচয় দেখা হচ্ছে না। ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া মাত্রই তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে। তবে তালিকাভুক্ত অনেকে বিষয়টি টের পেয়ে আত্মগোপনে চলে গেছে। তারা যেন দেশ ছাড়তে না পারে সেদিকেও খেয়াল রাখা হচ্ছে।
এদিকে রংপুরের পীরগঞ্জের জেলেপাড়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর-দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনায় মঙ্গলবার পর্যন্ত অর্ধশত ব্যক্তি গ্রেফতার হলেও আতঙ্ক কাটেনি সেখানকার বাসিন্দাদের। বড় করিমপুরের এলাকাবাসী পুলিশকে জানায়, চোখের সামনে চেনা মুখগুলো এসে পেট্রোল ঢেলে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। হাতে-পায়ে ধরেও তাদের এ কাজ বন্ধ করা যায়নি। ঘরে ঢুকে নগদ টাকা, স্বর্ণ, গরু-ছাগল লুট করে নিয়ে গেছে। তবে তারা পুলিশের কাছে হামলাকারীদের নাম স্বীকার করতে ভয় পাচ্ছে।
কুমিল্লাতেও হিন্দুঅধ্যুষিত এলাকাগুলোতে অনেকটা একই ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বিশেষ করে যে পূজাম-প থেকে কোরআন শরিফ উদ্ধার করা হয়েছে, ওই এলাকার সংখ্যালঘু অনেক পরিবার এখন বিনিদ্র রজনী পার করছেন। তাদের ভাষ্য, সন্দেহভাজন অনেক ব্যক্তি গ্রেফতার হলেও এ ঘটনার মূল ইন্ধনদাতারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাই যে কোনো সময় আবারো সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা ঘটতে পারে। পুরো ঘটনার সুষ্ঠু সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত তারা স্বস্তি পাচ্ছেন না বলে জানান তারা।
তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন, কুমিল্লার মণ্ডপে যিনি ঘটনাটি ঘটিয়েছেন, যে ঘটনার কারণে এতকিছু, তিনি শিগগিরই ধরা পড়বেন। তিনি বারবার স্থান পরিবর্তন করছেন, তাই ধরা পড়ছেন না। তবে বেশিদিন তিনি পালিয়ে থাকতে পারবেন না বলে আশা করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
আসাদুজ্জামান খান কামাল আরো জানান, পরিতোষ নামে এক তরুণ ফেসবুকে আপত্তিকর স্ট্যাটাস দিয়েছিল। তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার বাড়ি পুলিশ পাহারা দিয়েছে। তার বাড়িতে হামলা হয়নি, তার পাশের গ্রামে হামলা হয়েছে। গোয়েন্দারা হামলাকারীদের শনাক্ত করেছে। তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে। তিনি অপপ্রচারের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমকে আর সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান।
রংপুর জেলার পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার সরকার জানান, রংপুরের ঘটনায় এ পর্যন্ত শতাধিক ব্যক্তিকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ রয়েছে। দ্রুতই তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। পাশাপাশি গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকেও নাম জানার চেষ্টা চলছে।
নয়া শতাব্দী/এমআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ