ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

নতুন বাজার খোঁজার তাগিদ

প্রকাশনার সময়: ২০ অক্টোবর ২০২১, ০৩:৫৭ | আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০২১, ০৪:০৮
সংগৃহীত ছবি

হঠাৎ প্রবাসী আয় কমছে। গত তিন মাস ছিল নিম্নমুখী। সেপ্টেম্বরে যা রেমিট্যান্স আসছে, তা গত ১৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। রেমিট্যান্স প্রবাহ কমতে থাকলে অর্থনীতি বড় ধরনের সমস্যায় পড়বে। এদিকে ডলারের দাম বৃদ্ধি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়া নিয়ে চিন্তিত সরকারও। বিশ্লেষকরা বলছেন, ঘুরে দাঁড়াতে প্রয়োজন নতুন বাজার খোঁজা। পাশাপাশি শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও করোনায় চাকরি হারানো শ্রমিকদের পুনর্বাসনে জোর দেয় প্রয়োজন।

জানা গেছে, বাজারে চাহিদা ও জোগানের ব্যবধানে ডলারের সংকট তীব্র। এতে বাড়ছে ডলারের দাম। আমদানিকারকদের গুনতে হচ্ছে বাড়তি অর্থ। আর এর প্রভাব পড়ছে গ্রাহক পর্যায়েও। বাজারে ডলারের সংকট কমাতে এবং দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে প্রচুর পরিমাণে ডলার ছাড়তে শুরু করেছে। গত বছর উল্টো পরিস্থিতি ছিল। তখন বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে ডলার কিনে নিয়েছিল। ডলার নিয়ে এমন সংকটের মুহূর্তে কমছে রেমিট্যান্স প্রবাহ।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘রেমিট্যান্স কমার কথা আমি আগেও বলছিলাম। কেননা, করোনা শুরুর সময় রেমিট্যান্সের গ্রোথ অত্যন্ত ওপরে ছিল। উচ্চমাত্রা বেশি দিন বহমান থাকে না। তখন বিদেশে যারা কর্মসংস্থান হারিয়েছে তারা ফিরে চলে আসবে। তাদের সঙ্গে যে অর্থ ছিল তা একসঙ্গে দেশে পাঠিয়েছে। যে কারণে সে সময় রেমিট্যান্স ঊর্ধ্বমুখী ছিল।’

তিনি আরো বলেন, ‘এই রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর জন্য আমাদের নতুন বাজার সৃষ্টি করতে হবে। যা স্বল্প মেয়াদে সম্ভব না। মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে- আমাদের আরো দক্ষ লোক বিদেশে পাঠাতে হবে। যাতে তারা বেশি বেতন পায় এবং বেশি রেমিট্যান্স পাঠাতে পারে। মাথাপিছু রেমিট্যান্স বাংলাদেশ যেটা পায়; সেটা এশিয়ার যতটা দেশ ভালোমাত্রার রেমিট্যান্স পায় তাদের সবার থেকে কম। কারণ হলো তারা অপেক্ষাকৃত দক্ষ শ্রমিক পাঠায়। আর আমাদের সব অদক্ষ শ্রমিক যায়। কাজেই তারা আমাদের থেকে রেমিট্যান্স ভালো পাঠাতে পারে। আর অন্য দেশেও শ্রমিক পাঠানোর চেষ্টা করতে হবে। মালয়েশিয়ার বাজার তো প্রায়ই বন্ধ হয়ে আছে অনেকদিন ধরে, সেটাকে আবার ভেরিফাই করতে হবে। আর মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে দক্ষ লোক পাঠাতে হবে।’

এদিকে করোনা মহামারির সময় দেশে রেমিট্যান্স আয় অনেক বেড়েছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় আন্তর্জাতিক চলাচল শুরু হলে রেমিট্যান্স কমতে শুরু করেছে। অন্যদিকে, আমদানি ব্যয়ও বাড়তে শুরু করেছে। করোনা চলাকালীন শিল্পের কাঁচামাল ও মেশিনারিজ আমদানি কম ছিল। সম্প্রতি তা বাড়তে শুরু করেছে। মহামারি চলাকালে প্রবাসীরা বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠালেও এখন অবৈধ পথেও (হুন্ডি) কিছু আসছে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। আর আমদানির ক্ষেত্রেও এই পথের আশ্রয় নেন অনেক আমদানিকারক। এছাড়া করোনা ভ্যাকসিন আমদানির অর্থও পরিশোধ করতে হচ্ছে। প্রত্যাশা অনুযায়ী রফতানি আয়ও হচ্ছে না। সব মিলিয়ে বাজারে বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদার তুলনায় সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এসব কারণে করোনা মহামারি-পরবর্তীতে ডলারের সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। অবশ্য ডলারের বাজার স্বাভাবিক রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগ বেশ কাজে আসছে বলেও মনে করছেন বিশ্লেষক ও ব্যাংকাররা।

ধারণা করা হচ্ছে, লোকজনের যাতায়াত শুরু হওয়ায় হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ লেনদেন বাড়তে পারে। মাঝে হুন্ডি একেবারেই কমে গিয়েছিল। এ ছাড়া করোনার প্রভাবে কাজ হারিয়ে যে হারে কর্মীরা দেশে এসেছেন, তার তুলনায় কম গেছেন। রেমিট্যান্স কমার প্রভাব ইতোমধ্যে মুদ্রাবাজারে পড়েছে। ডলারের দর বেড়ে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে গতকাল ৮৫ টাকা ৫০ পয়সায় বেচাকেনা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, সদ্যসমাপ্ত সেপ্টেম্বর মাসে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ১৭২ কোটি ৬৩ লাখ (১.৭২ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশি মুদ্রায় (প্রতি ডলার ৮৫ টাকা ৫০ পয়সা ধরে) যার পরিমাণ ১৪ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ছিল ২১৫ কোটি ১০ লাখ ডলার। ফলে গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় চলতি বছর রেমিট্যান্স কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। শুধু সেপ্টেম্বরই নয়, গত তিন মাস ধরে ধারাবাহিক রেমিট্যান্স কমছে। আর আগে গত আগস্ট মাসে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৮১ কোটি ডলার। যা তার আগের মাস জুলাইয়ের চেয়ে ৬ কোটি ১৪ লাখ ডলার কম। এছাড়া আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৫ কোটি ৩৮ লাখ বা প্রায় ৮ শতাংশ কম। এর আগে চলতি বছরের জুলাইয়ে দেশে ১৮৭ কোটি ১৪ লাখ ডলার রেমিট্যান্স আসে। যা তার আগের মাস জুনের চেয়ে ৬ কোটি ৯৩ লাখ ডলার কম। এছাড়া আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ২৮ শতাংশ কম।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত বছরের শুরুতে মহামারি করোনার কারণে প্রবাসীরা এক ধরনের অনিশ্চয়তা থেকে তাদের জমানো টাকা দেশে পাঠিয়েছিলেন। অনেকে চাকরি হারিয়ে কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে সব অর্থ দেশে এনেছেন। এছাড়া গত বছরের শুরুতে করোনার স্থবিরতার কারণে হুন্ডি প্রবণতা কমে যায়। ফলে ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থ পাঠানো বেড়ে যায়। এসব কারণে মহামারির মধ্যেও রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ে। এখন করোনার পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছে। অনেক দেশের ভ্রমণ-যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য সচল হয়েছে। ফলে ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে অর্থের চাহিদা বেড়ে গেছে। ফলে বৈধ চ্যানেলে প্রবাসী আয় কমছে। এছাড়া অনেকে দেশে এসে করোনার কারণে আটকা পড়েছেন। আবার অনেক প্রবাসী নতুন করে ব্যবসা শুরু করতে গিয়ে দেশে রেমিট্যান্স পাঠানো কমিয়ে দিয়েছেন। এসব কারণে রেমিট্যান্স নেতিবাচক ধারায় রয়েছে। তবে শ্রম রফতানি শুরু হওয়ায় শিগগিরই আবার প্রবাসী আয় ইতিবাচক হবে বলে প্রত্যাশা করছেন ব্যাংকাররা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে রেমিট্যান্স আহরিত হয়েছে ৩৬ কোটি ১৪ লাখ ডলার। বিশেষায়িত দুটি ব্যাংকের মাধ্যমে ৩ কোটি ৭২ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। এছাড়া বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ১৩২ কোটি ডলার এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ৭৬ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে।

বরাবরের মতো বেসরকারি ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আহরিত হয়েছে। সেপ্টেম্বরে ব্যাংকটির মাধ্যমে রেমিট্যান্স আহরিত হয়েছে ৪৬ কোটি মার্কিন ডলার। এছাড়া ডাচ্-বাংলা ব্যাংকে এসেছে ২০ কোটি ৩৬ লাখ ডলার, অগ্রণী ব্যাংকের মাধ্যমে ১৪ কোটি ৮৮ লাখ ডলার, সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে ১১ কোটি ১২ লাখ ডলার এবং জনতার মাধ্যমে ৬ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে দুই হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স দেশে আসে। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৬ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি। এর আগে কোনো অর্থবছরে এত পরিমাণ রেমিট্যান্স আসেনি বাংলাদেশে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এক হাজার ৮২০ কোটি ডলার বা ১৮ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। অর্থবছর হিসাবে যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আহরণ। তারও আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্স আহরণের রেকর্ড হয়। ওই সময় এক হাজার ৬৪২ কোটি ডলার রেমিট্যান্স আসে দেশে।

২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। অর্থাৎ কোনো প্রবাসী ১০০ টাকা দেশে পাঠালে তার সঙ্গে আরো ২ টাকা যোগ করে মোট ১০২ টাকা পাচ্ছেন সুবিধাভোগী। এছাড়া ঈদ ও উৎসবে বিভিন্ন ব্যাংক ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান সকারের প্রণোদনার সঙ্গে বাড়তি এক শতাংশ দেয়ার অফার দিচ্ছে। এতে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহী হচ্ছেন প্রবাসীরা।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ