জঙ্গি দমনে মাস্টারপ্ল্যান হাতে নিয়েছে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট ‘অ্যান্টি টেররিজম’। এরমধ্যে রয়েছে, বোম্ব ডিসপোজাল বিভাগের অধীনে দুটি গবেষণা সেল। সেখান থেকেই মনিটরিং করা হচ্ছে জঙ্গিদের গতিবিধি। পাশাপাশি অভিযানের সক্ষমতা আরো শক্তিশালী করতে সোয়াট ও কমান্ড ট্রেনিং দেয়া হয়েছে দুইশতাধিক সদস্যকে। অস্ত্র ও গোলাবারুদের সরবরাহ কমাতে রুট চিহ্নিত করে বাড়ানো হয়েছে কঠোর নজরদারি। তাছাড়া দেশের বিভিন্ন বিভাগ থেকে ১ হাজার ২১৯ জন জামিনপ্রাপ্ত, কারাবন্দি ও পলাতক জঙ্গির তথ্য সংগ্রহ করে প্রোফাইল সম্পন্ন করেছে অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ)। একই সঙ্গে এনটিএমসিতে (ন্যাশনাল টেলিকমিনিউকেশনড মনিটরিং সেন্টার) স্বতন্ত্র এজেন্সি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে দুইটি ইউইউএস (ইউনাইটেড ইউজার স্টেশন) ও একটি এলআইএমএস ও ৩৫০টি নম্বর বরাদ্দ নিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিংয়ের জন্য পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে স্থাপিত সার্ভার থেকে দুইটি ইউজার কানেকশন পেয়েছে।
এ বিষয়ে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিষয়ক বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, সেমিনার ও ডায়ালগে বিভিন্ন র্যাঙ্কের ৪৯ পুলিশ সদস্যকেও বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আনা হয়েছে। এছাড়া পূর্বাচলে নিজস্ব ভবন গড়ে তোলার পাশাপাশি ৮ বিভাগে চালু হচ্ছে এই ইউনিটের নিজস্ব অফিস। সেখানে একজন পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে কার্যক্রম চলবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
জানতে চাইলে এন্টি টেররিজম ইউনিটের অপারেশন শাখার পুলিশ সুপার সানোয়ার হোসেন নয়া শতাব্দীকে জানান, জঙ্গিদের এখন অপারেশন চালানোর মতো ক্ষমতা নেই। অনলাইনে কিছু উগ্রবাদী লোকজন সক্রিয় রয়েছেন। এছাড়া ছিন্নভিন্ন কিছু লোকজন আছে। তারা চুপ থাকলেও তাদের ওপর পুলিশের নজরদারি আছে। এজন্য অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটে দুটি গবেষণা সেল তৈরি করা হয়েছে। একটি অস্ত্র ও অপরটি বোমা বিষয়ে। তারা জঙ্গিদের এ ধরনের কার্যক্রম মনিটরিং করে। সেখান থেকে হাতে গোনা কয়েকজনকে মোস্ট ওয়ানটেড হিসেবে চিহ্নিত করে গ্রেফতারে অভিযান চালানো হয়।
তিনি বলেন, দ্রুত অভিযান পরিচালনার জন্য দেশের ৮ বিভাগে ইউনিটের আঞ্চলিক কার্যক্রম শুরু করা হচ্ছে। পাশাপাশি দ্রুতই ভাড়া বাসা থেকে পূর্বাচলে নিজস্ব ভবনে ইউনিটের কার্যক্রম শুরু করা হবে। ঢাকা মেট্রোর অফিসও থাকবে সেখানে। এছাড়া ইউনিটের অন্তত ২ শতাধিক সদস্যকে সোয়াট ও কমান্ড ট্রেনিং দেয়া হয়েছে। তারা যে কোনো ধরনের অপারেশন চালাতে সক্ষম।
অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট সূত্র জানায়, জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ দমনে আগে বেশি কাজ করত র্যাব। ২০১৩ সালের পর থেকে টার্গেট কিলিং শুরু করে জঙ্গিরা। ২০১৫ সালের দিকে টার্গেট কিলিং বেড়ে গেলে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এরপর জঙ্গিবাদ দমনে ২০১৬ সালের শুরুর দিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অধীনে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) নামে একটি নতুন ইউনিট গঠন করা হয়। ডিএমপির ইউনিট হিসেবে তাদের কার্যক্রমের পরিধিও ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে আইজিপির নির্দেশে ঢাকার বাইরেও তাদের অপারেশন চালাতে হয়েছিল। যে কারণে জাতীয়ভাবে কাজ করতে পুলিশের কাঠামোতে ‘অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট’ নামে আরেকটি ইউনিট চালুর উদ্যোগ নেয় সরকার। ২০১৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর এই ইউনিটের অনুমোদন দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। এরপর ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে এর কার্যক্রম শুরু হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে ২০১৯ সালের ১৯ নভেম্বর।
পুলিশের সাংগঠনিক কাঠামোতে এই ইউনিটের গঠন ও এর কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ৫৮১টি পদ সৃষ্টি করা হয়। এরমধ্যে স্থায়ীভাবে ৩১টি ক্যাডার পদ এবং ৫৫০টি পদ অস্থায়ীভাবে সৃষ্টি করা হয়। একজন অ্যাডিশনাল আইজি, একজন ডিআইজি, দুইজন অতিরিক্ত ডিআইজি, পাঁচজন এসপি, ১০ জন অ্যাডিশনাল এসপি, ১২ জন সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) এবং ৭৫ জন ইন্সপেক্টর, ১২৫ জন সাব ইন্সপেক্টরসহ বাকি পদগুলো কনস্টেবল পদ মর্যাদার। যানবাহন যুক্ত করা হয় ৪১টি। জঙ্গি দমনে মাস্টারপ্ল্যানের অংশ হিসেবে ৬টি শাখায় বিভক্ত করে সাজানো হয়েছে এই বিশেষ ইউনিটকে। এরমধ্যে, সোয়াট টিম, ক্রাইম সিন ইনভেস্টিগেশন টিম, বোম্ব বিস্ফোরণ ইনভেস্টিগেশন টিম, ক্রাইসিস ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম, এক্সপ্লোসিভ ডিসপোজাল টিম ও কে-নাইন স্কোয়াড (ডগ স্কোয়াড) অন্যতম। এছাড়া রয়েছে দুটি বিশেষ গবেষণা সেল।
সূত্রমতে, জঙ্গিদের দুর্বল করতে তাদের অস্ত্র ও বিস্ফোরকের উৎস বন্ধ করতে গবেষণা সেল দুটি কাজ করছে। তারা বিভিন্নস্থানে বিস্ফোরণের ধরন সম্পর্কে অনুসন্ধান করে থাকে। এরপর সেখানে ব্যবহৃত রাসায়নিক সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তার আমদানিকারকের বিষয়ে তথ্য নিয়ে ক্রেতা সম্পর্কে একটি ধারণা নিয়ে ডেটাবেজ তৈরি করে। এছাড়া ধারালো অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র সম্পর্কেও একটি গবেষণা সেল রয়েছে। ওই সেলের সদস্যরা দীর্ঘদিন তদন্ত শেষে কোন মতাদর্শের জঙ্গিরা কোন ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করে সে সম্পর্কেও একটি তথ্য রয়েছে ওই গবেষণা সেলে। সেখানে দেখা গেছে, সীমান্তের দুটি পথে এখন অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা চালাচ্ছে জঙ্গিরা।
এরমধ্যে একটি পাহাড়ি ও অন্যটি নদীপথে। নদীপথ হিসেবে তারা ব্যবহার করছে উত্তরবঙ্গের একটি জেলাকে। এবং পাহাড় হিসেবে বেছে নিয়েছে পার্বত্যাঞ্চলকে। এরপর ফেনী ও আরো একটি জেলা থেকে পর্যায়ক্রমে হাতবদল হয়ে জঙ্গিদের কাছে বিভিন্ন সময়ে এসব অস্ত্র এসেছে। এ কারণে ওইসব এলাকার ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের অপারেশন শাখার পুলিশ সুপার সানোয়ার হোসেন নয়া শতাব্দীকে জানান, আগে জঙ্গিরা পুরান ঢাকার বিভিন্ন কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে বিস্ফোরক ক্রয় করেছে। বিষয়টি তদন্তে বেরিয়ে আসার পর ব্যবসায়ী সমিতির নেতাদের ডেকে পাঠানো হয়। এরপর যাচাই না করে এসব বিস্ফোরক কারো কাছে বিক্রি করতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। সেখান থেকে জঙ্গিরা বারুদ না পেয়ে তারা এখন ম্যাচের কাঠির বারুদ বোমার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করছে। সম্প্রতি বিভিন্ন পুলিশ বক্সে বোমা হামলার ঘটনায় এ ধরনের বারুদের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এ কারণে বিভিন্ন ম্যাচ ফ্যাক্টরির কর্মকর্তাদের কাঠির মাথায় বারুদ পরিমাণ কমিয়ে তুলনামূলক দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে।
সূত্রমতে, অনলাইনে অনেক জঙ্গি সক্রিয় রয়েছেন। তারা শুধু নিজেদের ভিন্নমত পোষণ করে থাকেন। তাদের তুলনামূলক কম হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে তারা নজরদারিতে রয়েছেন। এছাড়া জঙ্গিদের আরো একটি গ্রুপ রয়েছে। তারা কথা কম বলে কাজ বেশি করে। ওই গ্রুপটিকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। জেএমবির পুরোনো ওই গ্রুপটি আইএসকে তাদের মডেল হিসেবে মান্য করে। এ কারণে তারা তাদের স্টাইলে চলতে চায়। ওই গ্রুপটি অস্ত্রবাজিতে বিশ্বাসী। এবং হত্যাকা-ে তারা ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করে থাকে। আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে শুধু নিজেদের আত্মরক্ষার্থে। এ বিষয়ে ধারালো অস্ত্র ক্রেতাদের ওপরও পুলিশের নজরদারি রয়েছে। পাশাপাশি আগ্নেয়াস্ত্র পাচারের রুটেও ইউনিটের কঠোর নজরদারি অব্যাহত রয়েছে।
এসপি সানোয়ার হোসেন বলেন, বোমাসহ বিভিন্নস্থান থেকে গ্রেফতার হওয়া জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গবেষণা সেলে পাঠানো হয়। তাদের কাছ থেকে বোমা বানাতে পারদর্শীদের সম্পর্কে একটি ধারণা নিয়ে ওই জঙ্গিদের মোস্ট ওয়ানটেড হিসেবে চিহ্নিত করে বিভিন্ন দফতরে পাঠানো হয়। হাতে গোনা ওই কয়েকজনকে গ্রেফতার করা সম্ভব হলে জঙ্গিদের একটি বিশাল গোষ্ঠী বোমার প্রযুক্তি সম্পর্কে দক্ষতা হারাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ধরনের একাধিক জঙ্গিকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। পাশাপাশি অস্ত্রের ব্যবহার রুখতে সীমান্ত এলাকায় বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়েছে। তবে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া এই মুহূর্তে জঙ্গিদের বড় ধরনের কোনো ঘটনা ঘটানার সামর্থ্য নেই।
তবে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট এখনো বেশকিছু সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। এর মধ্যে বিজ্ঞানভিত্তিক কার্যক্রম যেমন, অর্গানাইড ও সাইবার ক্রাইম এবং ফরেনসিক ও ক্রাইম সেন্স অ্যানালাইসিস শাখা চালু না হওয়া অন্যতম। এছাড়া ক্রাইমসিন ম্যানেজমেন্টসহ ফরেনসিক, বায়োমেট্রিক্স এবং বস্তুগত সাক্ষ্য সংগ্রহ করে বিজ্ঞানসম্মত তদন্তে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত কর্মকর্তার স্বল্পতা রয়েছে। লজিস্টিক সাপোর্ট তথা অপর্যাপ্ত যানবাহন, যুগোপযোগী ও আধুনিক যন্ত্রপাতি ও অস্ত্রের স্বল্পতার বিষয়টি এইউটির কার্যক্রম গতিশীল করার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট বিধিমালা অনুমোদন না হওয়ায় সার্বিকভাবে তদন্ত কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারছে না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দাবি, এসব প্রতিবন্ধকতা দ্রুত কাটিয়ে ওঠার জন্য তারা তোড়জোড় চেষ্টা চালাচ্ছে।
অন্যদিকে অপারেশনাল কার্যক্রমে গতিশীলতা আনতে মোবাইল ট্র্যাকার, আইপি ট্র্যাকার ইত্যাদি সেবা সংযোগ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বাড়ানো হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া ও অনলাইনভিত্তিক জঙ্গিবাদ মনিটরিংয়ের সক্ষমতা। আইনানুগভাবে জাতীয় পর্যায়ের সব ডাটাবেজে (এনআইডি, বিআরটিএ, এনবিআর ও ইমিগ্রেশন) এটিইউর প্রবেশাধিকার প্রতিষ্ঠাকরণের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
নয়া শতাব্দী/এসএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ