করোনা মহামারির কারণে সারাবিশ্বে ১০ কোটির বেশি মানুষ নতুন করে হতদরিদ্রের কাতারে নেমে গেছে। এর ৮০ শতাংশই বাংলাদেশের মতো মধ্যম আয়ের দেশের নাগরিক। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এ তথ্য। দেড় বছরে করোনার প্রভাবে বাংলাদেশেও দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রম ওলটপালট করে দিয়েছে।
গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসির) জরিপ বলছে, প্রতি বছর যেখানে ১ শতাংশ হারে দারিদ্র্য বিমোচন হতো, সেখানে করোনার কারণে এখন বছরে ৪ শতাংশ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হচ্ছে। করোনার কারণে দেশের কর্মসংস্থানের ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে। এই সময়ে ৩ শতাংশের বেশি শ্রমিক কর্ম হারিয়েছে। বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের হিসেব বলছে, অর্থনীতিতে শ্লথগতি দেখা দেয়ায় নতুন করে দেড় কোটির বেশি মানুষ গরিব হয়েছে। এদিকে, পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলছেন, দারিদ্র্য বিমোচন এবং সামাজিক সুরক্ষায় নানা পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার।
জানা গেছে, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে প্রতিবছরই বরাদ্দের পরিমাণ বাড়াচ্ছে সরকার। করোনার কারণে এটি আরো বেড়েছে। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দের হার মোট বাজেটের ১৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ। যা গত অর্থবছর ছিল ১৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ। টাকার অঙ্কে চলতি অর্থবছর সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সরকারের বরাদ্দ এক লাখ সাত হাজার ৬১৪ কোটি টাকা। এ অর্থ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩ দশমিক ১১ শতাংশ। গত অর্থবছর এ হার ছিল ৩ দশমিক ১০ শতাংশ। তবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে নগর দরিদ্রদের প্রতি নজর না দেয়ায় সমস্যা রয়ে গেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, সারাদেশে ১২০টির মতো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি এখনো চলমান। তবে এগুলোর সবই গ্রামীণ দরিদ্রদের লক্ষ্য করে নেয়া হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, করোনায় সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছে নগর দরিদ্ররা। অথচ এ বছর সরকারের ১২০টির বেশি কর্মসূচির মধ্যে মাত্র ১০টিতে আছে তারা। এই কর্মসূচিগুলোও বাস্তবে খুব একটা কার্যকর নয়। কেননা এগুলো বাস্তবায়নের মতো ভালো কোনো কাঠামো নেই। এ কারণে করোনাকালে প্রকৃত সুবিধাভোগীর কাছে সহায়তা পৌঁছানো যায়নি। শহরাঞ্চলে করোনার চিকিৎসা নিয়ে কী ধরনের দুর্দশায় পড়তে হয়েছে, সেটি মানুষ হয়তো কখনো ভুলবে না। গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের বড় দুই শহর ঢাকা ও চট্টগ্রামে বলার মতো কোনো সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি নেই। অন্যান্য শহরেও একই অবস্থা। শহরাঞ্চলে নিরাপত্তা কর্মসূচির যে কথা বলা হয়, সেটিও আসলে পৌরসভা পর্যন্ত। অর্থাৎ নগরকেন্দ্রিক সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি তেমন নেই।
এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ড. আবু ইউসুফ বলেন, করোনাকালে দারিদ্র্যের হার দ্রুত বাড়ার মূল কারণ আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি মানুষের কর্মহীনতা। এ অবস্থায় সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম বৃদ্ধির আহ্বান জানান তিনি।
নতুন এক জরিপে দেখা গেছে, যারা সাধারণত দারিদ্র্যসীমার ওপরেই বসবাস করেন, কিন্তু যে কোনো অভিঘাতে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে পারেন, তাদের নতুন দরিদ্র হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে জরিপে। দেখা গেছে, গ্রামাঞ্চলের তুলনায় শহরাঞ্চলে নতুন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেশি। শহরাঞ্চলে নতুন দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৫৯ শতাংশ, সেখানে গ্রামাঞ্চলে তা ৪৪ শতাংশ। গত বছরের জুনে দরিদ্র নয় কিন্তু সেই ঝুঁকিতে থাকা এই মানুষদের ৭২ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছিলেন। এদের মধ্যে ৫০ শতাংশ এখনো ঝুঁকিতেও রয়েছে। গত বছর ২৭ দশমিক ৩ শতাংশ বস্তিবাসী শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যান, যাদের ৯ দশমিক ৮ শতাংশ এখনো ফেরেনি। এ হিসাব থেকে জাতীয় পরিসরে নতুন দরিদ্রের এ হিসাব (১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ) প্রাক্কলন করা হয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিপিআরসি ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, করোনায় গ্রামের তুলনায় শহরে নতুন দরিদ্রের হার ছিল বেশি। করোনাকালে নগরের অনেক মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমায় নেমে আসে। অনেকে অতি দরিদ্রে পরিণত হয়। করোনার আঘাতে সার্বিকভাবে দেশে নতুন করে যে আড়াই কোটি মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়েছে তার বৃহদংশই নগরবাসী। কিন্তু সরকারের কার্যক্রমে নগর দারিদ্র্যের বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয়নি।
পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান নয়া শতাব্দীকে বলেন, কোভিডের আঘাত সব জায়গায় একইভাবে অনুভূত হয়নি। শহরের তুলনায় গ্রামে তার প্রভাব কমই দেখা গেছে। সে কারণে শহরের বস্তিবাসীর জীবন গ্রামের শ্রমজীবীদের তুলনায় অনেক বেশি অরক্ষিত।
তিনি আরো বলেন, ভাড়া বাড়িতে থাকা অধিকাংশ শহুরে দরিদ্রের জন্য এটি নির্মম বাস্তবতা। সবার সঞ্চয় কমেছে আশ্চর্যজনকভাবে। অরক্ষিত অদরিদ্র এবং দরিদ্র নয় এমন শ্রেণির মানুষের সঞ্চয়ের পরিমাণ কোভিড-পূর্ববর্তী অবস্থার চেয়ে নিচে নেমে গেছে। একই সঙ্গে সব শ্রেণিতেই ঋণ গ্রহণের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে। সবমিলিয়ে চরম দারিদ্র্যের হার সামগ্রিকভাবে ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম নয়া শতাব্দীকে বলেন, করোনায় দেশের প্রত্যেকটি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ধাক্কা সামলাতে না পেরে অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকে টিকে থাকার জন্য শ্রমিক ছাঁটাইসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। কমে গেছে সাধারণ মানুষের আয়। সব মিলে দেশে নতুন করে দেড় কোটির বেশি মানুষ দরিদ্র হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, করোনাকালে ৩ শতাংশ শ্রমিক চাকরি হারিয়েছে। শহরাঞ্চলে ইনফরমাল ইকোনমি থেকে ৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ মানুষ কর্ম হারিয়েছে। আর উচ্চপর্যায়ে ১ কোটি ১১ লাখ থেকে ২ কোটি ৫ লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাকরি হারিয়েছে এসএমই ও ইনফরমাল সেক্টরে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ কর্মহীন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলছেন, আমরা বিভিন্ন ধরনের প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছি। গ্রামীণ পর্যায়ে আমরা বাঁধ, সড়ক, সেতু ইত্যাদি নির্মাণের মাধ্যমে মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এই কাজগুলো এখনো চলমান রয়েছে।
নয়া শতাব্দী/এসএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ