কুমিল্লার ঘটনার বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যেমে দ্রুত ছড়িয়ে দেয়া অন্তত দুই শতাধিক ফেসবুক আইডি শনাক্ত করেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। ওই আইডিগুলো থেকে পূজামণ্ডপে হামলার জন্য অনুরোধ করা হয়। একই সঙ্গে ওইসব হামলার সঙ্গে কারা জড়িত তা খুঁজে বের করতে পুলিশের সব ইউনিটকে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে হামলায় জড়িত থাকার সন্দেহে বেশ কয়েকজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
পুলিশি তদন্তে দেশের বিভিন্নস্থানে হামলায় সম্পৃক্তদের বিষয়ে বিশদ তথ্য উদ্ঘাটন করেছে। ভাঙচুরে উসকানিদাতা ও হামলায় জড়িত শতাধিক ব্যক্তিকে শনাক্ত করেছে পুলিশসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। তাদের মধ্যে বিএনপি, জামায়াত ইসলামী ও হেফাজত ইসলামী বাংলাদেশের একাধিক নেতার নাম উঠে এসেছে। পাশাপাশি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের ইন্ধনও থাকার অভিযোগ উঠেছে। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশের সব সংস্থাই ধারাবাহিক অভিযান চালাচ্ছে। পুলিশের ঊর্ধ্বতনরা দফায় দফায় বৈঠক করছেন পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান জানিয়েছেন, পূজামণ্ডপে হামলার ঘটনায় প্রশাসন কঠোর। যারা এই হামলার সঙ্গে সরাসরি জড়িত বা উসকানি দিয়েছেন তাদের কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট তদন্ত করছে। বিভিন্নস্থানে হামলার সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার দেশ। অসাম্প্রদায়িকতা নষ্ট করার জন্যই একটি মহল এসব অপকর্ম করেছে। তদন্ত করে শিগগিরই দোষীদের চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তিনি আরো বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তা, গোয়েন্দা সংস্থাসহ সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি খুব সিরিয়াসলি দেখছেন। আমরা একটি নির্ভুল তদন্তের মাধ্যমে শিগগিরই সুখবর দিতে পারব। আমরা মনে করি, আমাদের দেশের লোক ধর্মভীরু কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
জানা গেছে, গুজব রটানোর অভিযোগে দুইশ’ ফেসবুক এডমিনের প্রোফাইল কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তাদের আইনের আওতায় আনার পরিকল্পনা নিয়েছে পুলিশ। এমনকি কয়েকজনের ভয়েস বার্তাও পেয়েছে পুলিশ। বার্তায় কেউ কেউকে হামলার কথাও বলতে শোনা গেছে বলে তদন্তকারী সংস্থার সদস্যরা জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, তালিকাভুক্ত উসকানিদাতা ও হামলাকারীরা যাতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে না পারেন সেই জন্য দেশের সব বিমানবন্দর ও সীমান্ত এলাকায় কঠোর বার্তা পাঠিয়েছে পুলিশ।
সংশ্লিষ্টরা জানায়, কুমিল্লায় একটি পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন শরিফ রাখার ঘটনার জের ধরে গত কয়েকদিন ধরে দেশের বিভিন্নস্থানে পূজামণ্ডপে একাধিক হামলার ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ শনিবার রাতে ফেনীতে বড় ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এই পর্যন্ত ৩৫টি পূজামণ্ডপে হামলা করে মূর্তি ভাঙচুর করেছে দুবৃর্ত্তরা। মণ্ডপে হামলার প্রতিরোধ করতে গিয়ে হামলাকারীদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে। এতে ৫ জন নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। এসব ঘটনার নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। সরকারের হাইকমান্ড, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতরে দফায় দফায় বৈঠক করেন কর্তাব্যক্তিরা।
হামলাকারী ও উসকানিদাতাদের ধরতে পুলিশের সব ইউনিটকে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়। নির্দেশনা পেয়ে পুলিশের সব রেঞ্জ ডিআইজি, জেলার পুলিশ সুপার ও মেট্রো পুলিশ কমিশনাররা আলাদাভাবে বৈঠক করে বেশ কিছু দিকনির্দেশনা পাঠায় থানার ওসিদের কাছে। পাশাপাশি সব গোয়েন্দা সংস্থাও মাঠে নামে দুবৃর্ত্তদের শনাক্ত করতে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ সদর দফতরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা গতকাল বলেন, হামলার আশপাশে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রতিমা ভাঙচুরে যারা যারা অংশ নিয়েছিল তা ওইসব ফুটেজে ফুটে উঠেছে। তাছাড়া আড়ালে থেকে যারা উসকানি দিয়েছেন তাদের মধ্যে অনেককেই শনাক্ত করা হয়েছে। আর যাদের শনাক্ত করা হয়েছে তার সংখ্যা শতাধিক হবে। ইতোমধ্যে তাদের পূর্ণাঙ্গ বায়োডাটা সংগ্রহ করা হয়েছে।
ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, হামলাকারী ও উসকানিদাতাদের মধ্যে বিএনপি, জামায়াত ইসলামী ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের একাধিক নেতা রয়েছে। পাশাপাশি শাসক দলের কিছু নেতা ইন্ধন দিয়েছেন বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ২শ’ ফেসবুক এডমিনের প্রোফাইল কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। তাদের শিগগির আইনের আওতায় আনা হবে। হামলাকারীদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সনীতি গ্রহণ করা হয়েছে।
কুমিল্লা জেলার পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ জানান, যারা পূজামণ্ডপে হামলার করেছে তাদের দ্রুত সময়ের মধ্যে চিহ্নিত করা হবে। বুধবার সকালে কুমিল্লা কোতোয়ালির নানুয়া দীঘির উত্তরপাড় জনসংঘ পূজামণ্ডপে ধর্মীয় অনুভূতির ওপর কে বা কারা পবিত্র কোরআন শরিফ রেখে যায়। এই ঘটনার পর শহরের বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি পূজামণ্ডপে হামলার ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে গিয়ে ৪ পুলিশ সদস্য আহত হন। তিনি বলেন, যারা মণ্ডপে কোরআন শরিফ রেখে গেছে তাদেরও ছাড় দেয়া হবে না। যে কোনো পরিস্থিতি এড়াতে বাড়তি নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে উসকানিদাতা ও হামলাকারীদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে। হামলার ঘটনায় চারটি মামলা হয়েছে।
চাঁদপুর পুলিশের অপর এক কর্মকর্তা বলেন, বুধবার রাতে হাজীগঞ্জ পৌরসভার ত্রিনয়নী সংঘ শ্রী শ্রী রাজলক্ষ্মী নারায়ণ জিউর আখড়া পূজামণ্ডপে ৫০০-৬০০ দুষ্কৃতিকারী হামলা চালায়। হামলায় ১৫ পুলিশ সদস্য মারাত্মক জখম হন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গুলি করতে বাধ্য হয় পুলিশ। এতে ৪ জন মারা যায়। তিনি অরো বলেন, যারা এই হামলার সঙ্গে জড়িত তাদের চিহ্নিত করতে ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। ওই ফুটেজে দেখা গেছে, হামলাকারীদের মধ্যে বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাও রয়েছেন। চট্টগ্রামের বাঁশখালীর চাম্বল ইউনিয়নের শ্রী শ্রী মা কালীমন্দিরে একশ থেকে দেড়শ’ লোক হামলা চালায়। হামলাকারীরা একটি প্রতিমা ভেঙে ফেলে। তাছাড়া গন্ডামারা, বাংলাবাজার ব্রিজ, চান্দনাইশ, লোহাগড়া, ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, পটিয়া এবং বোয়ালখালীসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় হামলা ভাঙচুর এবং বিক্ষোভ মিছিলের ঘটনা ঘটেছে।
কক্সবাজারের পেকুয়া কেন্দ্রীয় সার্বজনীন দুর্গামন্দির বিশ্বাসপাড়ায়ও হামলার ঘটনা ঘটেছে। ৩০০ থেকে ৪০০ দুষ্কৃতিকারী হামলা করে মন্দিরের প্রধান গেট ভাঙচুর করে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। বাধা দিলে পুলিশের সঙ্গে হামলাকারীদের সংঘর্ষ হয়।
সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন জানান, কুমিল্লার ঘটনার পর কিছু স্থানে হামলার চেষ্টা করা হয়। তবে বড় ধরনের ঘটনা ঘটেনি। যে কোনো পরিস্থিতি এড়াতে রাস্তায় রাস্তায় টহল দিচ্ছে পুলিশ। হামলার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।
র্যাবের এক কর্মকর্তা বলেন, দেশের বিভিন্নস্থানে পূজামণ্ডপে হামলার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের প্রায় শনাক্ত করা হয়েছে। শনাক্তকারীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। হামলা ও সংঘাতের ঘটনার নেপথ্যে থেকে যারা মূল ভূমিকা পালন করেছেন, তাদের শনাক্ত করতে কাজ চলছে।
তিনি আরো বলেন, ফেসবুক ও ইউটিউবে ভুল তথ্য দিয়ে উত্তেজনা ছড়ানোর অভিযোগে ২শ’ এডমিনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদেরও আইনের আওতায় আনার কাজ চলছে। আশা করি দ্রুত সময়ের মধ্যে সবাইকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে। আমাদের পাশাপাশি সিআইডিসহ আরো বেশ কয়েকটি সংস্থা এসব ঘটনার তদন্ত করছে।
নয়া শতাব্দী/এমআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ