৫১ বছর বয়সী নাটোরের বাসিন্দা ওমর শরীফ। স্থায়ীভাবে বসবাস করেন লন্ডনে। নাড়ির টানে প্রায় ১০ বছর পর গত ৫ অক্টোবর ভোরে লন্ডন থেকে ঢাকায় আসেন। এরপর গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য উত্তরার আজমপুর এলাকায় দেশ ট্রাভেলসের বাস কাউন্টারে যান। সেখানে শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত বাসে সিট না পেয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। একপর্যায়ে সেখানে অবস্থানরত দুই যুবক মিসর থেকে এসেছেন এবং তারাও নাটোরে যাবেন বলে ওমর শরীফকে বলেন। আলাপচারিতার একপর্যায়ে তারা একটি সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে কল্যাণপুরে যান। সেখান থেকে এসি বাসে টিকিট কেটে রওয়ানা দেন।
দুপুরে বাসটি সিরাজগঞ্জের ফুড ভিলেজে যাত্রা বিরতি করলে সেখানে তিনজন খাওয়া শেষে ডাবের পানি পান করেন। এরপর বাসে ওঠার এক সময় নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কার করেন ওমর শরীফ। এ ঘটনায় নাটোরের বড়াইগ্রামে মামলা দায়ের করেন ওমর শরীফ। শুধু ওমর শরীফই নন শতাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে একই কৌশলে অজ্ঞানের পর লুণ্ঠন করা হয়েছে মূল্যবান মালামাল। ঢাকার উত্তরা ও বিমানবন্দর কেন্দ্রিক সক্রিয় চক্রের এই সদস্যদের সন্ধানে দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করছিল মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ।
অবশেষে ৭ অক্টোবর মিসর ফেরত লিটন সরকার নামে এক যুবকের মালামাল লুটের ঘটনায় ১৫ অক্টোবর এই চক্রের মূল হোতা আমির, আপেল ও শামীমকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতাররা উত্তরবঙ্গগামী যাত্রীদের টার্গেট করে ফুড ভিলেজে নিয়ে কৌশলে অজ্ঞান করে সর্বস্ব লুটে নিত বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, একটি চক্রকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আজ রোববার এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করা হবে।
সূত্রমতে, গাইবান্ধার সাদুল্লাপুরের বাসিন্দা লিটন সরকার। ৭ অক্টোবর সকালে টার্কিশ বিমানে ঢাকায় আসেন। এরপর সকাল সাড়ে ৭টার দিকে বিমানবন্দরের সামনে ফুটওভারব্রিজের পাশে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এ সময় কয়েক ব্যক্তি তার কাছে এসে গন্তব্য সম্পর্কে জানতে চায় এবং মাক্রোবাসে পৌঁছে দেয়ার অফার দেন। লিটন এ সময় প্রয়োজন নেই জানালে তাকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে প্রায় আড়াই লাখ টাকার মালামাল লুটে নেয় অজ্ঞাত ৪/৫জন।
ওই ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় মামলা দায়ের করেন লিটন। মামলার তদন্তের এক পর্যায়ে ডিবির বিমানবন্দর জোনাল টিম এই চক্রের সদস্যকে চিহ্নিত করে। গতকাল শনিবার তাদের গ্রেফতার করা হয়। এরপর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা মূলত অজ্ঞানপার্টির সদস্য বলে স্বীকার করেন। লিটন তাদের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তারা লুটের পথে পা বাড়ান বলে জানান। ওইদিন নেশা করার জন্য তাদের টাকার বেশি প্রয়োজন ছিল বলে জানান। অজ্ঞানপার্টির বিষয়ে জানতে চাইলে তারা চলতি মাসের ৫ তারিখ ওমর শরীফের ঘটনা জানান। এরপর গোয়েন্দা পুলিশ নাটোরের বড়াইগ্রাম থানায় মামলার খোঁজ পান।
ভুক্তভোগী ওমর শরীফ জানান, বিমানবন্দর এলাকায় নামার পর বাসের জন্য আজমপুরের দেশ ট্রাভেলসের কাউন্টারে যান। সেখানে এসি বাসের টিকিট না পেয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। এক পর্যায়ে দুই যুবক এসে তারাও নাটোরে যাবেন এবং দেশের বাইরে থেকে এসেছেন বলে জানান। এরপর তারা একটি সিএনজি অটোরিকশাযোগে কল্যাণপুরে যান। সেখানে যাওয়ার পর চক্রের এক সদস্য নিজেই তিনটি টিকিট কেনেন। এরপর তারা পাশাপাশি বসে যাত্রা শুরু করেন। ব্যাগগুলো লাগেজ টোকেন রাখা হয় চক্রের অন্য সদস্যের কাছে। সিরাজগঞ্জ যাওয়ার পর তারা ফুড ভিলেজে খাওয়া-দাওয়া করেন। এরপর ওই হোটেলে বসেই তারা তিনজন তিনটি ডাব খান। এরপর তারা আবারো বাসে ওঠেন। এক দিন তিনি নিজেকে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে আবিষ্কার করেন। বাসের লোকজন তাকে ওই হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছে বলে জানতে পারেন। এ সময় তার কাছে থাকা আনুমানিক ৫ লাখ টাকার মালামাল লুট হয়।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নাটোরের বড়াইগ্রাম পৌঁছানোর আগের একটি বাস স্টপে নেমে যায় ওই চক্রের সদস্যরা। নেমে যাওয়ার সময় ওমর শরীফকে বড়াইগ্রাম নামিয়ে দেয়ার জন্য বাসের সুপারভাইজারকে অনুরোধ করেন। বড়াইগ্রাম আসার পর ওমর শরীফকে নামার জন্য ডাকা দেয়া হলে তাকে অচেতন অবস্থায় পাওয়া যায়। এরপর পুলিশের সহায়তায় তাকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করায় বাসের লোকজন। ওই ঘটনার তদন্ত শুরু করে পুলিশ। একপর্যায়ে সিরাজগঞ্জের এক এসআইয়ের সঙ্গে অজ্ঞানপার্টির দুই সদস্যের কথা বলার প্রমাণ পাওয়া যায়। এরপর ওই এসআইকে অজ্ঞানপার্টির সদস্য মনে করে তুলে আনে পুলিশ। নিজেকে পুলিশ পরিচয় দেয়ার পর নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। এরপর দেখা যায় আরো একটি অজ্ঞানের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ওই এসআই। তিনি তাদের গ্রেফতারের জন্য ছদ্মবেশে কথা বলছিলেন। বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ার পর তার কাছে ভুলের জন্য ক্ষমা চান বড়াইগ্রাম থানার ওসি।
সিরাজগঞ্জের ওই মামলায়ও এই তিনজনকে গ্রেফতার দেখানো হবে। গ্রেফতার এই তিনজনের নামে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ডজনখানেক মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। যার বেশিরভাগই অজ্ঞানপার্টি সংশ্লিষ্ট। গোয়েন্দা পুলিশের দাবি, তারা এ পর্যন্ত অন্তত শতাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে মালামাল লুট করেছেন। বিমানবন্দর থেকে টার্গেট করা ব্যক্তির পিছু নিয়ে তারা গাড়িতে ওঠেন। এরপর ফুড ভিলেজ বা অন্য কোথাও যাত্রা বিরতি দিলে কৌশলে তারা ঘুমের ওষুধ খাওয়ায়ে মালামাল লুটে নেয়। ঢাকার পুলিশ বেশি পারদর্শী বলে তারা এখন ঢাকার বাইরে এ ধরনের কর্মকা- চালাচ্ছে বলে স্বীকার করে। বিশেষ করে উত্তরবঙ্গকেন্দ্রিক তারা তৎপর। গ্রেফতারকৃত শামীমের বাড়ি বরিশালের গৌরনদীতে এবং আপেল ও আমিরের বাড়ি জামালপুরে। তাদের চক্রে আরো সদস্য রয়েছে। তাদের গ্রেফতারে অভিযান চালানো হচ্ছে। এ বিষয়ে আজ রোববার সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত জানাবেন ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার।
ফুড ভিলেজ ঘিরে অজ্ঞানপার্টির তৎপরতার বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির ডিজিএম শাহজাহান রেজা সাগর নয়া শতাব্দীকে বলেন, ফুড ভিলেজের আশপাশে নানা শ্রেণির লোকজন ঘুরে বেড়ায়, অনেক ভ্রাম্যমাণ হকাররা এখানে ব্যবসা করে, ডাবের দোকানগুলো ইজারার মাধ্যমে চলে। ফুড ভিলেজে এমন কর্মকা- চলে তা আমাদের জানা নেই।
নয়া শতাব্দী/এমআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ