ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

গুজবতন্ত্রে সওয়ার কারা!

প্রকাশনার সময়: ১৬ অক্টোবর ২০২১, ০৬:১৫ | আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০২১, ১১:১০

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুক ব্যবহার করে প্রায়ই দেশে ভয়ঙ্কর রূপে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে নানা ধরনের ‘গুজব’। এর ফলে নিয়মিত বিরতিতে দেশের নানা স্থানে ঘটছে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার মতো অপ্রীতিকর ঘটনা।

রামু ট্র্যাজেডি, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, নাসিরনগরে হামলা-ভাংচুর, সিলেটের শাল্লায় হিন্দুপল্লীতে হামলা- এমন ঘটনাগুলোতে ছিল গুজবের প্রভাব। আর এসব সহিংসতায় সামাজিক সম্প্রীতি বিনষ্ট হওয়ার পাশাপাশি বহু মানুষের প্রাণহানিও ঘটেছে। সম্প্রতি কুমিল্লার একটি ঘটনার সূত্রে নতুন করে ডালপালা মেলেছে গুজবতন্ত্র।

রাষ্ট্রচিন্তকদের অভিমত, সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দিন দিন বেড়ে চলেছে। সম্প্রতি কেন এমনটা হচ্ছে- জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও গবেষক আইনুল ইসলাম নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘আফগানিস্তানের বর্তমান তালেবান পরিস্থিতির কিছুটা প্রভাব হয়তো আমাদের দেশে পড়েছে। বিভিন্ন সময়ে দেশের পোর্টালগুলোতে যে নিউজগুলো হয়, সেখানে এর কমেন্ট বক্সে বা ফেসবুকে যে ধরনের মন্তব্য চোখে পড়ে সেগুলো পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়- রেডিক্যালাইজেশন বা মৌলবাদী চিন্তা-ভাবনা একটা শ্রেণির মধ্যে বাড়ছে। এটা একদম প্রতীয়মান। এবং সংখ্যাটা অনেক বেশি।

আরেকটা কারণ হলো- বিভিন্ন ধর্মীয় দলগুলো প্রকাশ্যে তাদের কার্যক্রম চালাতে না পারায় গোপনে চলে গেছে কিনা সেটাও একটা কারণ হতে পারে। এছাড়া সামনে নির্বাচন (যদিও তা ২০২৩ সালে), কিন্তু এরই মধ্যে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। আর নির্বাচনকে সামনে রেখে অনেক কিছুই হয়। কারণ প্রত্যেক দলগুলোই ভায়োলেন্টলি হোক কিংবা নন-ভায়োলেন্টলি হোক- পারফর্ম করার চেষ্টা করছে।’

এদিকে, কুমিল্লার ঘটনায় একটি ফেসবুক লাইভ ভাইরাল হয়ে যায় মুহূর্তেই। আর এই ভাইরাল হয়ে যাওয়া ভিডিওটি সত্য না মিথ্যা- সেই কথা যাচাই না করেই শেয়ার করতে শুরু করেন অনেকে। এর ফলে নতুন করে সহিংস ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা তৈরি হয়। ইন্টারনেটে এ ধরনের সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী বক্তব্য বা গুজব ঠেকাতে ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করেছে সরকার। এই আইনের আওতায় ইন্টারনেটে আক্রমণাত্মক, মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শক তথ্য-উপাত্ত, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, মানহানিকর বক্তব্য ও আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে এমন ঘটনায় জড়িতদের শাস্তির বিধান রয়েছে।

গুজব ঠেকাতে এমন কঠোর আইন থাকার পরও কেন এ ধরনের ঘটনা কমছে না? এমন প্রশ্নে অধ্যাপক আইনুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এটা নিয়ে কাজ করছি। এখানে ঘৃণা, কলঙ্ক, মিথ্যা তত্ত্ব বা গুজব ছড়িয়ে দেওয়াকে আমরা ‘ডেঞ্জারাস কনটেন্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করেছি। সমাজের কিছু মানুষ এ ধরনের উসকানিমূলক কথাবার্তা বা মিথ্যা তত্ত্ব ছড়িয়ে দেয়। মানুষের কাছে নেগেটিভ বিষয় স্বাভাবিকভাবে আগে পৌঁছায়। এক শ্রেণির মানুষ এটা আর যাচাই করে না। তারা এ ধরনের কন্টেন্ট না বুঝেই ছড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশে আসলে এই বিষয়গুলো নিয়ে খুব একটা স্টাডি বা গবেষণা হয় না।

না করার কারণে গণতন্ত্র বা অধিকার প্রতিষ্ঠায় কীভাবে এই গুজব আমাদের ধ্বংস করে দিচ্ছে- তা আমরা বুঝতে পারি না। কুমিল্লার ঘটনা- আদৌ বিষয়টি ঘটেছে কিনা বা কারা ঘটিয়েছে- এটা এখনো কেউই জানেন না; এ রকম একটা ঘটনা এত দ্রুত কেন ছড়িয়ে দিতে হবে? শাল্লার ঘটনাটাও ছিল একই। এই ধরনের ঘটনা না বুঝেই মোল্লা বা সাধারণ মানুষ বা রাজনীতিবিদরা ছড়িয়ে দেয়।’

তিনি আরো বলেন, ‘এইগুলো হলো বাস্তববুদ্ধিজনিত সমস্যা। তাই শুধু আইন দিয়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা কিংবা গুজব বন্ধ করা যাবে না। অনেক সময় আইন অপপ্রয়োগ হয়। কিন্তু সামগ্রিকভাবে এই ধরনের সমস্যা দূর করতে হলে শিক্ষাক্ষেত্রে আমাদের পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন আনতে হবে, গবেষণা করতে হবে, সমাজে নৈতিক চর্চার জন্য বিভিন্ন প্রোগ্রাম করতে হবে। আইন আছে এটা ভালো- তবে শুধু আইনি কাঠামো নয়; স্কুল-কলেজের পাঠ্যসূচিতেও এই কনটেন্টগুলো সংযুক্ত করা দরকার।’

গুজব ঠেকাতে আইন থাকা সত্ত্বেও কেন ঠেকানো যাচ্ছে না? একই প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, ‘আমি এটাকে গুজব বলব না, কু-তথ্য বা মিথ্যা তথ্য বলব। আর এটা ঠেকানো একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া- সামাজিক পর্যায়ে প্রকৌশলের ব্যাপার। আইন দিয়ে কিছুটা দূর হবে। এছাড়া রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে অনেকটা দূর যাওয়া যেতে পারে। উপমহাদেশে তেমনটা হওয়ার কোনো রাস্তা আমি দেখছি না। তথাপি আমি বলব- এটা সময়সাপেক্ষ এবং সামাজিক পর্যায়ে প্রকৌশলের ব্যাপার।’

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ