ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১৫ কার্তিক ১৪৩১, ২৭ রবিউস সানি ১৪৪৬

কেজি দরে ভাঙ্গারিতে ভলভো

প্রকাশনার সময়: ১৫ অক্টোবর ২০২১, ০৫:২৫

প্রায় ২০ বছর আগে সুইডেন থেকে চড়া দামে ৫০টি আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসংবলিত ভলভো বাস কেনে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি)। বিলাসবহুল এই বাসগুলো প্রথম সাত থেকে আট বছর সড়ক দাপিয়ে বেড়ায়। ধীরে ধীরে সেগুলোর বিভিন্ন যন্ত্রাংশ নষ্ট হতে শুরু করে। এসব যন্ত্রাংশ মেরামতে দফায় দফায় প্রকল্প হাতেও নেয় বিআরটিসি। কিন্তু যন্ত্রাংশগুলো দেশে দুষ্প্রাপ্য ও ব্যয়বহুল হওয়ায় তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি সংস্থাটি। অকেজো বিলাসবহুল বাসগুলো বিআরটিসির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। অবশেষে বোঝা হয়ে থাকা অকেজো এসব বাস ভাঙ্গারি হিসেবে কেজি দরে বিক্রি করে দেয় বিআরটিসি। এমনটি জানিয়েছেন বিটিআরসি সংশ্লিষ্টরা।

তারা বলছেন, দীর্ঘদিন পড়ে থাকার পর ৫০টি ভলভো বাসের মধ্যে ৪৯টি বিক্রি করে দিয়েছে বিআরটিসি। রাজধানীর বিভিন্ন ডিপোতে পড়ে থাকা এসব বাস ভাঙ্গারি হিসেবে বিক্রি করা হয়েছে। সচল আছে কেবল একটি ভলভো বাস। সেটি রাজধানীর মিরপুর ডিপোর নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছে। বাসটি এখন সুপ্রিম কোর্টের স্টাফদের আনা-নেয়ার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।

বিটিআরসি সংশ্লিষ্টরা আরো বলেন, যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বাসগুলো কাক্সিক্ষত সেবা দিতে পারেনি। সড়কে নামানোর সাত-আট বছর পর বাসগুলোর যন্ত্রাংশ নষ্ট হতে শুরু করে। তখনই নতুন যন্ত্রাংশ কেনা উচিত ছিল। তা না করে একটি বাসের যন্ত্রাংশ নষ্ট হলে, আরেকটি বাস থেকে সেই অংশ খুলে লাগানো হতো। যেটি থেকে খুলে নেয়া হতো, সেটি অকেজো হয়ে পড়ে থাকত। এভাবে এক-একটি করে বাস অকেজো হতে থাকে। ফলে অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার কারণে নির্ধারিত মেয়াদের আগেই ৪৯টি বাস অকেজো হয়ে পড়ে।

এছাড়া বাসের অনেক মূল্যবান যন্ত্রাংশ চুরি ও নষ্ট হয়ে যায়। সব মিলিয়ে বোঝা হয়ে থাকা অকেজো বাসগুলো ভাঙ্গারি হিসেবে কেজি দরে বিক্রি করে দেয় বিআরটিসি। তবে পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু ভলভো নয়, এ পর্যন্ত যত বাস কেনা হয়েছে তার কোনোটিরই যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি। ফলে প্রত্যাশিত সার্ভিসও পাওয়া যায়নি। দেশে একটি বাজে সংস্কৃতি চালু রয়েছে, তা হলো রক্ষণাবেক্ষণের চেয়ে নতুন কেনায় আগ্রহ বেশি। নতুন করে কিনলে লাভ বেশি, রক্ষণাবেক্ষণে সেটি নেই।

তারা আরো বলেন, ভলভো বাসের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল ১২ বছর ধরা হয়। তবে সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারলে এসব বাস অনায়াসে ২০ বছর চলাচলের উপযোগী থাকে। অথচ ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ, সময়মতো ইঞ্জিন তেল ও মবিল না দেয়াসহ রক্ষণাবেক্ষণের সময় চুরি, দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে কোটি টাকার প্রতিটি ভলভো বাস অকালে বিকল হয়ে গেছে।

বিআরটিসি সূত্র জানায়, ২০০১ সালে সুইডেন থেকে ৭০ কোটি টাকায় এসব বাস কেনা হয়েছিল। সেই হিসাবে প্রতিটি বাসের দাম পড়ে প্রায় এক কোটি ৪০ লাখ টাকা। সরকারি তহবিল ও সুইডিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির (সিডা) যৌথ অর্থায়নে বাসগুলো কেনা হয়।

নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে, বাসগুলোর সাধারণ মেয়াদ ১২ বছর। তবে ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে চলে ২০-২৫ বছর। জানতে চাইলে পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, সরকারি দফতরগুলো সবসময় কেনাকাটা পছন্দ করে। রক্ষণাবেক্ষণ করে তাদের কী লাভ? দরদ দিয়ে কাজ করলে, তার নিজের তো লাভ নেই। কিন্ত সরকারি ক্রয়ে অনেক লাভ আছে। সেই চিন্তা মাথায় রেখে গাড়িগুলোর যত্নটা হয়তো সেভাবে নেন না তারা।

তিনি বলেন, ভলভো গাড়িগুলোর মেইনটেন্যান্স হয়তো সেভাবে হতো না। ভলভোর একটা পার্টস (যন্ত্রাংশ) না থাকলে আরেকটা থেকে খুলে নিয়ে এসে সেটি সচল রাখত। এভাবে জোড়াতালি দিতে দিতে কিছু বাস এমনিতেই অকেজো হয়ে গেছে।

অধ্যাপক সামছুল হক আরো বলেন, সবচেয়ে বড় কথা হলো- এখানে জবাবদিহিতার সিস্টেম নেই। পাশাপাশি বিআরটিসি যেটা করে, প্রাইভেট সেক্টরের মতো তারাও লিজ দেয়। অথচ মেনটেইন্যান্সটা নিজেদের ঘাড়ে রাখেন। লিজ যারা নেন, তারা তো আসেন বড় লোক হতে। নিজের গাড়ি যেভাবে দরদ দিয়ে চালান কিন্তু লিজ নেয়া গাড়িগুলোকে সেভাবে চালান না। বিআরটিসির গাড়ির অপব্যবহার করে তারা ধনী হন। ফলে শুধু ভলভো নয়, কোনো বাসই টেকসই হয়নি, হচ্ছে না।

তিনি বলেন, পুরো বিষয়টিতে সরকারের বিরাট গাফিলতি আছে। সরকার প্রকিউরমেন্টের আগে প্রশ্ন করে না, যেটা করা উচিত। গাড়িগুলোর কমার্শিয়াল লাইফ কত দিন থাকার কথা ছিল, কত দিন গেল- এ প্রশ্ন করার কারোই সময় নেই। সবাই কেনাকাটায় ব্যস্ত।

মন্ত্রী বলবেন, আমি এতগুলো বাস কিনে দিয়েছি। অর্থাৎ বাসের সংখ্যা বলায় আগ্রহ যার, তিনি তো জবাবদিহিতার দিকে যাবেন না। মাঝে মধ্যে হুঙ্কার হয়তো দেবেন যে, জিরো টলারেন্সে থাকবেন, এভাবেই চলছে। সার্বিকভাবে আমি মনে করি, যে কার্যকর ব্যবস্থা নিলে সম্পদকে টেকসইভাবে ব্যবহার করা যায়, সেটার দর্শনের ধারে কাছেও আমরা নেই। ওই কালচারটা তৈরিই হয়নি এখনো। কালচার তৈরি হয়েছে এমন, যত দ্রুত খারাপ করতে পারব, প্রকিউরমেন্টের জন্য তাড়াতাড়ি পয়সা পাব। তাতে তো কোনো অসুবিধা হয় না।

জানতে চাইলে বিআরটিসি চেয়ারম্যান মো. তাজুল ইসলাম বলেন, ভলভো বাসের বিষয় তো অনেক আগের। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে যোগ দিয়েছি আমি। এর বহু আগে থেকেই এগুলো অকেজো ছিল। অকেজো গাড়ি যত থাকবে, ততই লোকসান। কারণ দিন দিন এগুলোর ক্ষয়ক্ষতি বাড়ে, দামও কমে। এজন্য আমরা যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে প্রত্যাশিত দাম পেয়ে বিক্রি করেছি। তিনি আর বলেন, শুধু ৪৯টি ভলভো বাসই নয়, অযোগ্য ঘোষণার জন্য বিইআর (প্রস্তাবিত) ১৭৮টি গাড়ি ছিল। আগেও অকেজো এ বাসগুলো টেন্ডারে দেয়া হয়েছিল। প্রত্যাশিত দাম না পাওয়ায় বিক্রি করা যায়নি। এবার প্রত্যাশিত দাম পেয়েছি, বিক্রি করে দিয়েছি।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ