ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে (ডিএমপি) আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে মাদকাসক্ত সদস্যের সংখ্যা। এরই মধ্যে ডোপ টেস্টে পজিটিভ হওয়ায় চাকরিচ্যুত করা হয়েছে ৯০ জনকে। চাকরি হারানোর তালিকায় রয়েছেন আরো অনেক সদস্য। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশ সদস্যদের মাদক সেবনে বিরত রাখার জন্য নিয়মিত রোলকলের ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
গত ৭ অক্টোবর ডিএমপির প্রফেশনাল স্টান্ডার্ড অ্যান্ড ইন্টারনাল ইনভেস্টিগেশনের উপপুলিশ কমিশনার মোছা. ফরিদা ইয়াসামিন স্বাক্ষরিত ওই চিঠি নয়া শতাব্দীর কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।
এ বিষয়ে সম্প্রতি পুলিশের আইজি ড. বেনজীর আহম্মেদ বলেন, পুলিশের মাদকের বিষয়ে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। কোনো পুলিশ সদস্যকে মাদক সেবন ও ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক সাসপেন্ড করে অভ্যন্তরীণ তদন্ত করে দোষী প্রমাণিত হলে চাকরিচ্যুত করা হবে। এ বিষয়ে কোনো ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই। এমনকি দোষীদের রক্ষা করতে কেউ এগিয়ে এলে তাকেও ছাড় দেয়া হবে না।
জানা গেছে, ২০২০ সালের মাঝামাঝিতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশে ডোপ টেস্ট শুরু করা হয়। প্রথম অবস্থায় ৩০ সদস্য শনাক্ত হওয়ার পর তদন্ত শেষে ১০ জনকে সাসপেন্ড করা হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে আরো একাধিক সদস্য শনাক্ত হওয়ার পর পুলিশের ভেতর এক ধরনের ডোপ টেস্ট আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। আবার পুলিশের অনেক সদস্য বিষয়টিকে সাধুবাদ জানান। তাদের দাবি হাতে গোনা কয়েকজনের কারণে পুরো বাহিনী কেন দায় বহন করবে। এরপর বিষয়টি আরো গতিশীল করতে পুলিশ সদর দফতর ও ডিএমপির পক্ষ থেকে আলাদা একটি টিম গঠন করা হয়। তারা বিভিন্ন এলাকা ঘুরে পুলিশ সদস্যদের ওপর নজরদারি শুরু করে। কাউকে সন্দেহ মনে হলেই তাকে দাফতরিক প্রক্রিয়া শেষে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গত ৭ অক্টোবর ডিএমপি কমিশনারের নির্দেশে প্রফেশনাল স্টান্ডার্ড অ্যান্ড ইন্টারনাল ইনভেস্টিগেশনের উপপুলিশ কমিশনার মোছা. ফরিদা ইয়াসমিন ৫৭টি বিভাগে একটি চিঠি পাঠান। সেখানে বলা হয় ঢাকায় কর্মরত পুলিশ/সিভিল সদস্যদের মাদকদ্রব্য সেবন এবং শৃঙ্খলাজনিত কারণে প্যাথলজিক্যাল রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে এ পর্যন্ত ৯০ পুলিশ সদস্যকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে এবং এ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। এ কারণে আপনার অধীনে কর্মরত সব পুলিশ/সিভিল সদস্যকে মাদক সেবন থেকে বিরত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করার লক্ষে নিয়মিতভাবে রোলকলের মাধ্যমে জানানো এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হলো।
ডিএমপির ডিসি পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, ডিএমপি কমিশনারের পক্ষ থেকে ওই চিঠি পাওয়ার পর তিন বেলা পুলিশ সদস্যদের মনিটরিং করা হচ্ছে এবং নিয়মিত রোলকল করা হচ্ছে। কোনো সদস্য অনুপস্থিত থাকলে তা তদন্ত করা হচ্ছে। যৌক্তিক কারণ দেখাতে না পারলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি অ্যালকোহল এনালাইজার দিয়েও টেস্ট করানো হচ্ছে। সেখানে পজিটিভ পাওয়া গেলে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে তার রক্ত পরীক্ষা করা হচ্ছে। সেখানেও পজিটিভ এলে সাসপেন্ড করে বিভাগীয় মামলা দায়ের পর চাকরিচ্যুত করার সুপারিশ করা হয়। এরপর কমিশনার চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেন। এখানে কারো বিরুদ্ধে পক্ষপাতের সুযোগ নেই।
জানা গেছে, পুলিশ সদস্যদের মধ্যে যারা মাদকাসক্ত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে শুরু হয়েছে চূড়ান্ত অ্যাকশন। পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশে ডোপ টেস্টের ফলাফলের ভিত্তিতে তাদের শনাক্ত করে চাকরিবিধি মেনে বাহিনী থেকে বরখাস্ত করে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে পুলিশের সব ইউনিটে ও সব রেঞ্জে এ পরীক্ষা ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এমন পরিস্থতিতে মাদকাসক্ত পুলিশ সদস্যদের মধ্যে দেখা দিয়েছে ডোপ টেস্ট আতঙ্ক। চাকরি রক্ষা করতে দীর্ঘদিন মাদক গ্রহণে অভ্যস্ত পুলিশ সদস্যরা গোপনে চিকিৎসকের কাছে দৌড়াচ্ছেন।
ডিএমপি সূত্র জানায়, গত এক বছরে মাদক সংশ্লিষ্টতার জন্য ডোপ টেস্টের মাধ্যমে ঢাকা মহানগর পুলিশে কর্মরত বিভিন্ন পদমর্যাদার ৩ শতাধিক পুলিশ সদস্যকে শনাক্ত করা হয়েছে। শনাক্ত হওয়া সদস্যরা প্রায় নিয়মিত মাদক সেবন করতেন। কেউ কেউ ব্যবসায়ও জড়িত ছিলেন। এদের মধ্যে চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হওয়ায় ঢাকায় কর্মরত ৯০ পুলিশ সদস্যকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এদের বেশিরভাগই এসআই, সার্জেন্ট, এএসআই, নায়েক ও কনস্টেবল। তবে কনস্টেবলের সংখ্যা বেশি বলে সূত্র দাবি করেছে। সামাজিক মর্যাদার বিষয়টি মাথায় রেখে তাদের নাম প্রকাশ করা হয়নি পুলিশের পক্ষ থেকে। তবে এর সংখ্যা বাড়তে থাকলে ভবিষ্যতে নাম প্রকাশ করারও পরিকল্পনা রয়েছে।
সূত্রমতে, সন্দেহজনক পুলিশ সদস্যদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে চলছে গোয়েন্দা কার্যক্রম। তবে ডোপ টেস্টের পর যথাযথ ব্যবস্থায় যেতে যেন প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা হয় ও সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যসহ অন্যদের মনোবল না ভাঙে সেই বিষয়েও পুলিশের ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। প্রথমে বিভিন্ন দফায় যারা পুলিশ সদস্য হয়েও ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিল বা অন্যান্য মাদক সেবনে যুক্ত ছিল তাদের সেই পথ পরিহার করতে বলা হয়। বেশ কয়েক দফায় এমন বার্তা দেয়ার পর মাদকাসক্ত সদস্যরা সুপথে না এলে তাদের চিহ্নিত করতে ডোপ টেস্টের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এজন্য ডিএমপির পক্ষ থেকে বিশেষ টিম গঠন করা হয়েছে।
প্রতিটি থানা, বিভিন্ন ইউনিট ও পুলিশ লাইন্সে এই ইউনিটের সদস্যরা কাজ করছে। কাউকে মাদকাসক্ত সন্দেহ হলে তার ওপর নজরদারি বাড়ানো হয়। এরপর তাকে ডোপ টেস্টের জন্য তালিকাভুক্ত করা হয়। কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করেই এই কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। ঢাকায় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও সিটি স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) এটি নিয়ে কাজ করছে। পাশাপাশি ডিএমপি সদর দফতরের ইন্টেলিজেন্স অ্যানালাইসিস ডিভিশন (আইএডি) সন্দেহভাজনদের তালিকা ক্রস চেক করে পুলিশ কমিশনারের কাছে তা হস্তান্তর করা হচ্ছে। এরপর কমিশনারের নির্দেশে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।
নয়া শতাব্দী/এমআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ