নির্বাচনের এখনো বাকি দুই বছরের বেশি। তবে এবার আগেভাগেই নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। পিছিয়ে নেই ইসলামি দলগুলোও। মামলা ও গ্রেফতার আতঙ্ক থাকলেও অনেকটা নীরবে ঘর গোছাচ্ছে তারা। জাতীয় ও রাজনৈতিক ইস্যুতে এসব দলের প্রকাশ্য তৎপরতা বর্তমানে নেই বললেই চলে। তবে মিডিয়ায় প্রায়ই ঘরোয়া পরিবেশে সভা-সমাবেশের সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠাচ্ছে।
অধিকাংশ দলের দাবি, মামলা-হামলার ভয়েই মূলত রাজপথে ইসলামি দলগুলোর তৎপরতা কমে গেছে। তবে সময়মতো এসব দল ও সংগঠন আবারো মাঠে নামবে। সেই লক্ষ্য সাংগঠনিকভাবেও নিজেদের নতুনভাবে সাজানো হচ্ছে। দলের দায়িত্বশীলরা বলছেন, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন তারা। সময়-সুযোগমতো রাজপথেও নামবেন।
কওমি মাদ্রাসা কেন্দ্রিক ইসলামী দলগুলোর প্রথম সারির নেতারা বলছেন, কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক ধর্মভিত্তিক দলগুলো সংগঠন গোছানোর কাজে মনোযোগ দিয়েছে। এ বছরের শেষ নাগাদ এবং ২০২২ সালে সম্মেলন ও প্রতিনিধি সভা আয়োজনে প্রস্তুতি শুরু করেছে কয়েকটি সংগঠন। কাউন্সিলের জন্য ইতোমধ্যে দিনক্ষণ চূড়ান্ত করেছে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এবং বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন। কেন্দ্রীয় অধিবেশন ডেকেছে খেলাফত মজলিস। এছাড়া ইসলামী ঐক্যজোটসহ কয়েকটি সংগঠন সম্মেলন ডাকার বিষয়ে চলছে আলোচনা।
তারা আরও বলেন, গ্রেফতার-মামলার ঝক্কি পেরিয়ে ধীরে ধীরে স্বস্তিতে ফিরছেন ইসলামি দলগুলোর নেতারা। বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনও ইস্যুতেই মাঠ গরমের কর্মসূচি পালনের সম্মতি নেই তাদের। তাই ঘরোয়াভাবেই কাজ হবে। তাদের মতে, হেফাজতে ইসলামকেন্দ্রিক ধর্মভিত্তিক দলগুলো এ বছরের শুরু থেকেই সরকারের চাপে রয়েছে। গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। সেক্ষেত্রে নেতাদের কারামুক্তি ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে যে কোনো চাপের কাছেই নতি স্বীকার করতে হচ্ছে তাদের। যে কারণে প্রেস বিজ্ঞপ্তির বাইরে অন্য যে কোনো কার্যক্রম সীমিত পরিসরে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলগুলো।
জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক খেলাফত মজলিসের একজন নায়েবে আমির বলেন, ইসলামি দলগুলোর পুনর্গঠন প্রক্রিয়া চলছে এখন। সবার সামনেই অস্তিত্বের লড়াই। বেশি চাপে পড়ায় ঘরোয়াভাবে কাজ হবে। পরিস্থিতির উন্নতি হলে প্রকাশ্য কর্মসূচিতে যেতে পারে দলগুলো।
জানা গেছে, দেশে ধর্মভিত্তিক দল ও সংগঠন কতগুলো আছে তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। নিবন্ধিত ৪০টি রাজনৈতিক দলের ১২টি ইসলামি দল। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকারে রয়েছে বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন। আর বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটে জামায়াতে ইসলামী ও বেরিয়ে যাওয়া ইসলামি দলগুলো খণ্ডিত অংশ। তবে জামায়াতের নেই নিবন্ধন। এর আগে গত ১ অক্টোবর বিএনপি জোটে থাকা সর্বশেষ নিবন্ধিত ইসলামি রাজনৈতিক দল খেলাফত মজলিশ জোট ছেড়েছে। এর আগে জোট ছাড়ে ১৪ জুলাই কওমি আলেমদের পুরোনো দল জমিয়তে উলামায়ে ইসলামী বাংলাদেশও। এর আগে জোট ছেড়েছে বাংলাদেশ মুসলিম লীগ ও ইসলামী ঐক্যজোট।
তবে বিএনপি জোট ছাড়া শরিক দলের নেতারা জানান, রাজনৈতিকভাবে চাপে আছেন তারা। কারণ ইসলামপন্থিদের দিয়ে একটি জোট তৈরি করতে কাজ চলছে। এ জন্যই ধর্মভিত্তিক দলগুলো একে একে বিএনপি ছাড়তে শুরু করেছে। আগামী বছরে এই জোট আত্মপ্রকাশ করতে পারে।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম : দল গোছানোর কার্যক্রমের অংশ হিসেবে আগামী ২৫ ডিসেম্বর সম্মেলন ডেকেছে চলতি বছরের বিএনপির ২০ দলীয় জোট ছেড়ে যাওয়া জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম। দলটির আমির ও মহাসচিব পদে থাকা দুইজনই ভারপ্রাপ্ত হওয়ায় এবারের সম্মেলনের মূল বিষয়বস্তু ‘নেতৃত্ব নির্বাচন’। হেফাজতের মামলায় কিছু দিন আগে কারাগার থেকে বেরিয়ে এসেছেন জমিয়তের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মুঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী।
তিনি বলেন, আমরা আগামী ২৫ ডিসেম্বর সম্মেলনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করেছি। তবে এখনো স্থান নির্ধারণ হয়নি। সম্মেলনের আনুষঙ্গিক কাজ অব্যাহত রয়েছে। তিনি আরো বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ইসলামি দলগুলো এখন কারো লেজুড়বৃত্তি করবে না।
খেলাফত মজলিস : দলটির কেন্দ্রীয় সাধারণ অধিবেশন হবে আগামী ২৫ ডিসেম্বর। এ বিষয়ে নায়েবে আমির মাওলানা আহমদ আলী কাশেমী জানান, আমাদের কেন্দ্রীয় সাধারণ অধিবেশন ডাকা হয়েছে। জেলায় জেলায় কীভাবে কাজ হচ্ছে, কাজের অগ্রগতি-অবনতি এসব বিষয় মতবিনিময় হবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো- পরবর্তী বছরের পরিকল্পনা গ্রহণ।
তিনি আরো জানান, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের বর্তমানে কারাগারে। কয়েকটি মামলায় এখনো তার জামিন বাকি আছে। আইনি প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।
খেলাফত আন্দোলন : দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আগামী ২৯ নভেম্বর রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর মাদ্রাসায় প্রতিনিধি সম্মেলন ডাকা হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান হামিদী বলেন, সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচি কমেছে। তবে আমরা জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন সভা-সেমিনারসহ কর্মসূচি পালন করছি। দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক হচ্ছে। দুই বছর পরপর আমাদের দলীয় কাউন্সিল হয়, সেই হিসাবে আগামী বছরের নভেম্বরে পরবর্তী কাউন্সিল হবে।
ইসলামী ঐক্যজোট : ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে একমাত্র ইসলামী আন্দোলনের স্বাভাবিক কার্যক্রম রয়েছে। দলটির নেতারা জানান, সারা বছরই তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম চলতে থাকে। আগামী ডিসেম্বর-জানুয়ারি নাগাদ ইসলামী ঐক্যজোট কাউন্সিল করতে চায়। এর আগেও চলতি বছরের ২ জানুয়ারি সম্মেলন করেছে দলটি। পাঁচ বছরের জন্য এর আমির পদে পুনরায় নির্বাচিত হয়েছেন চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম।
ঘরোয়াভাবে দলীয় কার্যক্রম পরিচালনা করছে জানিয়ে দলটির যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মঈনুদ্দিন রুহি বলেন, কিছু দিন আগে আমাদের দলের মজলিসে শূরার বৈঠক হয়েছে। অন্য রাজনৈতিক দলগুলোরও যেমন কার্যক্রম কম, আমাদেরও কম। তবে আগামী ডিসেম্বর-জানুয়ারি নাগাদ কাউন্সিল আয়োজনের বিষয়ে আলোচনা চলছে।
দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আহমদ আবদুল জানান, গত শনিবার থেকে সারাদেশের ৮৭টি সাংগঠনিক জেলায় ঝটিকা সফর চলছে। সাত দিনের এই সফরে কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা অংশ নিচ্ছেন। এছাড়া তাদের ইস্যুভিত্তিক কর্মসূচি চলমান রয়েছে।
জামায়াতে ইসলামী : জামায়াত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক দল। তবে তাদের নিবন্ধন নেই। শীর্ষ থেকে তৃণমূলের প্রায় সব নেতা-কর্মী মামলায় জর্জরিত। সম্প্রতি দলের সেক্রেটারি সহ শীর্ষ ৯ নেতা আটক হয়েছেন। গ্রেফতার ভয়ে প্রকাশ্যে হচ্ছেন অন্য নেতারা। কমবেশি সবাই আত্মগোপনে। তবে অত্যন্ত গোপনে এ দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম চলছে। আগামী সংসদ নির্বাচন ঘিরে প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
নাম না প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা মহানগরীর এক নেতা বলেন, সরকার আমাদের মাঠে নামতে দিচ্ছে না। আমরা সংগঠনকে শক্তিশালী করছি। সময়মতো রাজপথে নামব। ইসলামী দলগুলো সূত্র আরো জানায়, এছাড়া কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক অন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সংগঠনগুলো ঘরোয়া অনুষ্ঠান করলেও সম্মেলন বা শূরা অধিবেশন নিয়ে তাদের আগ্রহ কম।
নয়া শতাব্দী/এমআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ