দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ২৫ লাখ টন। ২০২০ সালে বাংলাদেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে ২৫ লাখ ৫৭ হাজার টন। উৎপাদন থেকে সংরক্ষণ পর্বে ২৫-৩০ শতাংশ পেঁয়াজই নষ্ট হয়ে যায়। ফলে ঘাটতি পূরণে বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয় কয়েক লাখ টন পেঁয়াজ।
যদিও বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সী গতকাল সোমবার স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে দেশে ৩ মাসের পেঁয়াজ মজুদ রয়েছে। তবে ‘অজ্ঞাত কোনো কারণে’ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ প্রকাশ করেছেন ‘শঙ্কা’। বলেছেন, আগামী আরো এক মাস ডাবলেরও বেশি মূল্যে কিনতে হতে পারে পেঁয়াজ। বিশেষজ্ঞদের প্রশ্ন কী কারণে কাদের স্বার্থে ৩ মাসের পেঁয়াজ মজুদ থাকার পরও ‘দাম বাড়ানোর তক্কেতক্কে থাকা’ অসৎ ব্যবসায়ীদের ইঙ্গিত দিলেন?
গতকাল দুপুরে সচিবালয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুদ, সরবরাহ, আমদানি, মূল্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে আয়োজিত সভা শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বাণিজ্য সচিব বলেন, আগামী এক মাস পেঁয়াজের দাম কিছুটা নাজুক থাকবে। তবে দাম নিয়ন্ত্রণ ও ক্রয়সীমার মধ্যে রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বিত উদ্যোগ নিয়েছে।
তিনি আরো বলেন, পেঁয়াজের বাজারে দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজ শতকরা ৮০ ভাগ, বাকি ২০ ভাগ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। মূলত ভারত থেকে বেশি আমদানি করা হয়। কিছু মিয়ানমার থেকে আসে। ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে অতিবৃষ্টির কারণে সেখানকার বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। এর প্রভাবে বাংলাদেশে পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
বাণিজ্য সচিব বলেন, ভারতের পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধি এবং সেটা অব্যাহত থাকার আশঙ্কা থেকে বাংলাদেশে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। আমরা সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষকে এরই মধ্যে চিঠি দিয়েছি। এনবিআরকে শুল্ক প্রত্যাহারের জন্য বলা হয়েছে। চাহিদা পূরণ ও বাজার স্থিতিশীল রাখতে মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আমদানি করার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, বাজার পরিস্থিতি মনিটরিংয়ের জন্য বলা হয়েছে। জেলা প্রশাসনকে চিঠি দেয়া হয়েছে, দ্রব্যমূল্য অতিমাত্রায় নেয়া হচ্ছে কিনা, সেটা নজরে রাখার জন্য। পেঁয়াজের বাজার বেশি খারাপ হবে না। তবে উৎপাদন পরিস্থিতি ও ভারতে পেঁয়াজের দাম বাড়ার কারণে আগামী এক মাস নাজুক অবস্থা থাকবে।
এদিকে, একই অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, আমরা চারদিক থেকে চেষ্টা করছি, যতটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। একমাস বাড়তি দাম থাকার কথা বলা হচ্ছে কিন্তু আমাদের দেশে ৫ লাখ টন পেঁয়াজ মজুদ আছে, যা দিয়ে আগামী আড়াই থেকে তিন মাস চলা যাবে। ভারত ছাড়াও মিয়ানমার থেকে যদি পেঁয়াজ আনা যায় তাহলে কিন্তু এত প্রেসার পড়ার কথা নয়। তবে বৃষ্টির কারণে কিছুটা দাম বেড়েছে। তারপরও আমরা দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখার চেষ্টা করব। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, আমরা চারদিক থেকে চেষ্টা করছি যাতে পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। যতদিন পর্যন্ত আমরা স্বয়ং-সম্পূর্ণ হব না ততদিন পর্যন্ত কখনো কখনো আমাদের মূল্য নিয়ে ক্রাইসিসে পড়তে হবে। আশার কথা হলো, গত বছরের তুলনায় এ বছর উৎপাদন ভালো আছে। অন্তত এক লাখ টন পেঁয়াজ বেশি উৎপাদন হয়েছে।
দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ২৫ লাখ টন। সবশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে সাড়ে ২৫ লাখ ৫৭ হাজার টন। উৎপাদিত পেঁয়াজের ২৫ শতাংশ পচে যাওয়ায় নিট উৎপাদন ১৯ লাখ টনের কিছু বেশি। অর্থাৎ বাড়তি চাহিদার মাত্র ৫ থেকে ৬ লাখ টন আমদানিনির্ভর হলেও তা নিয়েই বাজারে চলে নানা কারসাজি।
তথ্যানুযায়ী, গত ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে এক লাখ ৮৬ হাজার ২০৫ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে। যা এক মাসেরও কম সময়ের মধ্যে রেকর্ড পরিমাণ আমদানি। কিন্তু তারপরেও দাম কমার কোনো লক্ষণ নেই পেঁয়াজের। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহের তুলনায় বর্তমানে পেঁয়াজের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
জানা গেছে, বাজারে প্রয়োজনীয় সরবরাহ আছে পেঁয়াজ। দেশের বাজারে মূল্য নির্ধারণ করে আমদারিকারকরা। এখানে সরকার বা ট্যারিফ কমিশনের কোনো হাত নেই। আমদানিকারকরা যে মূল্য নির্ধারণ করেন ঠিক সেই মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য সবাই। তাই এখানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অসহায়।
চট্টগ্রামের হামিদ উল্লাহ মার্কেটের ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেন, বাজারে প্রচুর পেঁয়াজ রয়েছে যা আমদানিকারকদের নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি হয়। দেশের বিভিন্ন স্থলবন্দরে ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হয়। আমদানিকারক এবং তাদের প্রতিনিধিরা মূল্য নির্ধারণ করে দেন। আমরা সেই দামেই পেঁয়াজ বিক্রি করি।
গত শনিবার ও রোববার ভারতীয় এবং মিয়ানমারের পেঁয়াজ নিয়ে কয়েক ডজন ট্রাক চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ বাজারে প্রবেশ করেছে। শত শত শ্রমিক এসব পেঁয়াজ ট্রাক থেকে নামিয়ে গুদাম ও পাইকারদের কাছে নিয়ে যেতে ব্যস্ত ছিল।
খাতুনগঞ্জের কমিশন এজেন্ট রুহুল আমিন রিগেন বলেন, সাধারণত যখন সরবরাহ বেড়ে যায়, তখন দাম কমে যায়। কিন্তু পেঁয়াজের ক্ষেত্রে এর উল্টো। পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও যার দাম প্রতিদিন বাড়ছে। দাম বৃদ্ধির পেছনের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, পেঁয়াজের দাম আমদানিকারকরা হেরফের করে। আমরা পাইকারিভাবে বিক্রি করি, আমদানি করি না। ডিএই’র উদ্ভিদ পৃথকীকরণ ইউনিটের পরিচালক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, জুন থেকে ১.১ মিলিয়ন মেট্রিক টন পেঁয়াজ আনার অনুমতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু সেপ্টেম্বর থেকে আমদানি শুরু হয়েছে যখন ভারতে পেঁয়াজের দাম বাড়তে শুরু করেছে। ভারতে এলসি মূল্য এবং পেঁয়াজের প্রকৃত মূল্য সম্পর্কে তদন্তের পর এর প্রকৃত কারণ জানা যাবে।
গত আগস্টে, এলসির দাম ছিল প্রায় ২৬০-২৭০ ডলার। তখন ভারতীয় রফতানিকারকরা চাহিদা অনুযায়ী রফতানি করতে রাজি হননি। গত দুই বছরের মধ্যে বছরের এই সময়ে পেঁয়াজের বাজার অস্থিতিশীল রয়েছে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ভারত পেঁয়াজ রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। যার ফলে এর দাম বাংলাদেশে প্রতি কেজিতে ২০০ টাকা পর্যন্ত পৌঁছে যায়। কিন্তু যখন সরকার ২০২০ সালে বৃহৎ পরিসরে পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন দেয়, তখন ব্যবসায়ীরা বিকল্প উৎস থেকে তাদের পর্যাপ্ত পরিমাণ কিনে নেয়।
যার কারণে বাজার মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল। উদ্ভিদ পৃথকীকরণ অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালের অর্থবছরে দেশটি পাঁচ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন এবং ২০২১ সালের অর্থবছরে পাঁচ লাখ ৫২ হাজার মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি করেছে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান নয়া শতাব্দীকে বলেন, দেশের পেঁয়াজ পুরোপুরি চাহিদা পূরণ করে না। ভারত থেকে আমদানি করতে হয়। ভারতে যদি পেঁয়াজের দাম বাড়ে তাহলে আমাদের এখানেও বাড়ে। অথবা ভারত থেকে যদি আমদানি বন্ধ হয়ে যায় তাহলেও দাম বাড়ে। তাহলে প্রশ্ন হতে পারে যে ভারতের পেঁয়াজের দাম বাড়তে পারে-কিন্তু বাংলাদেশের পেঁয়াজে কেন দাম বাড়ে? এর মূলে হলো আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিচ্ছে। ফলে দাম বাড়ছে। এদের ধর্মের কথা বলে লাভ নেই।
স্থলবন্দরগুলোতে যদি কোনোভাবে ১০ টাকা বেড়ে যায় তাহলে সারাদেশের সমস্ত ব্যবসায়ী মুহূর্তেই দাম বাড়িয়ে দেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশে যে পেঁয়াজ মজুদ আছে তা সরকারের কাছে নয়, ব্যবসায়ীদের কাছে। তাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চাইলেই তারা কম দামে পেঁয়াজ বিক্রি করবে না। ব্যবসায়ীরা জানে এই পেঁয়াজ ছাড়া দেশ চলবে না।
এই থেকে উত্তরণের পথ কী এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দীর্ঘ মেয়াদি সমাধান হলো দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়ানো। যাতে ভারত থেকে আমদানি করার দরকার না হয়। আমরা আগে থেকেই বলে আসছি, পেঁয়াজের মৌসুমে অধিকহারে শুল্কারোপ করতে হবে। যাতে দেশীয় উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
আবার যখন মৌসুম শেষ হয়ে যাবে তখন শুল্ক উঠিয়ে দিতে হবে। যাতে বাজারে প্রতিযোগিতা এবং ভোক্তারা সাশ্রয়ী মূল্যে পেঁয়াজ কিনতে পারে। এবারো বলছি, শুল্ক যেন তুলে দেয়। আমাদের দেশে রাজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য ট্যাক্স যারা তোলেন তারা, কৃষকের কথা, উৎপাদকের কথা, ভোক্তার কথা ভাবেন না।
শুধু পেঁয়াজই না। বাজারের সব নিত্যপণ্যেই এখন ক্রেতাদের নাগালের বাইরে। সিদ্দিক হোসেন নামের এক ক্রেতা নয়া শতাব্দীকে বলেন, সরবরাহ থাকার পরও ঘোড়দৌড়ের মতো পেঁয়াজের দাম বাড়ছে। শুধু পেঁয়াজই নয়, বাজারের সব পণ্যের দামই এখন আকাশছোঁয়া। দিন যায় আর দামে বাড়ে। এগুলো নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। মধ্যবিত্ত আর সীমিত আয়ের মানুষের জন্য বাজারে কোনো পণ্য নেই। সব পণ্যই এখন ধনীদের জন্য। যেভাবে দাম বেড়ে চলছে তাতে আমাদের খাওয়া বন্ধ করে দিতে হবে।
নয়া শতাব্দী/এম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ