রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের রি-অ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল (পারমাণবিক চুল্লিপাত্র) স্থাপন কাজ শুরু হয়েছে। এ কাজ শেষে দুই ধাপে তিনটি আলাদা টেস্ট হবে। টেস্ট শেষে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরাসরি যুক্ত হবে জাতীয় গ্রিডে। এসব ধাপ শেষ হতে সময় লাগতে পারে ১২ থেকে ১৮ মাস। সব মিলিয়ে ২০২৩ সালের মধ্যেই ব্যবহারিক কাজে লাগতে শুরু করবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিদ্যুৎ।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ইউনিট-১ এর ভৌত কাঠামোর ভেতরে রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল স্থাপনের মাধ্যমে প্রায় সব ধরনের পারমাণবিক যন্ত্রাংশ স্থাপন সম্পন্ন হবে। এর ফলে এই ইউনিটের রিঅ্যাক্টর ভবনের ভেতরের কাজ প্রায় শেষ হবে। এ ইউনিট থেকে ২০২৩ সালেই ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা শুরু হবে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক ড. শৌকত আকবর বলেন, নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল বা পারমাণবিক চুল্লি স্থাপনের মাধ্যমে আরো একধাপ এগিয়ে গেল রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মাণ কাজ। এরপর স্টিম জেনারেটর বসানো হবে। তারপর পর্যায়ক্রমে কোল্ড টেস্ট, হট টেস্ট এবং সিস্টেম টেস্ট কমিশনিং- এভাবে কাজ চলতে থাকলে নির্ধারিত সময়ের (২০২৩ সালের) মধ্যেই প্রকল্প থেকে মিলবে বিদ্যুৎ।
তিনি বলেন, রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ। পারমাণবিক এ চুল্লিতে থাকবে মূল জ্বালানি। পারমাণবিক চুল্লি স্থাপনের মধ্য দিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মাইলফলক অর্জিত হলো। এটি একটি যুগান্তকারী ঘটনা। এর মাধ্যমে বাঙালি জাতির দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ বাস্তবে রূপ নেয়ার পথে আরেক ধাপ এগিয়ে গেল। যে যন্ত্র দিয়ে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি ইউরেনিয়াম থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে তার মূল কাঠামোকে বলা হয় রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল বা পরমাণু চুল্লি।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, রূপপুর কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের জন্য এই রিঅ্যাক্টর ভেসেলটি রাশিয়া থেকে জলপথে ১৪ হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে গত বছরের অক্টোবরে দেশে পৌঁছে। এই চুল্লি সুয়েজ ক্যানেল হয়ে মোংলায় আসে। সেখান থেকে নৌপথে পাবনার রূপপুরে নেয়া হয়। পারমাণবিক চুল্লির পাত্রটির ওজন ৩৩৩ দশমিক ৬ টন।
১৯৬১ সালে পাকিস্তান আমলে ব্যাপক জরিপের পর ঈশ^রদীর রূপপুর গ্রামকে প্রকল্পের উৎকৃষ্ট স্থান হিসেবে নির্বাচন করে। এ সময় ৫৪৬টি পরিবারকে বসতবাড়ি থেকে সরিয়ে দিয়ে ২৫৯ দশমিক ৯০ একর জমি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য হুকুম দখল করা হয়। পাকিস্তান আমল থেকে প্রকল্পের উদ্যোগ নেয়া হলেও এ সময়ে দফায় দফায় শুধু পারমাণবিক চুল্লি স্থাপনের মেগাওয়াট পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত ছাড়া বাস্তবে কাজের কোনো অগ্রগতি ছিল না।
১৯৬৩ সালে ৭০ মেগাওয়াট পারমাণবিক চুল্লি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৯৬৪ সালে কানাডা সরকারের সঙ্গে এ চুক্তি স্থাপনের ব্যাপারে আলোচনা হয়। পরবর্তীকালে ১৪০ মেগাওয়াট পারমাণবিক চুল্লি স্থাপনের জন্য পাকিস্তান সরকার আণবিক শক্তি কমিশনে প্রস্তাব দেয়। ১৯৬৬ সালে সুইডেন কানাডা ও নরওয়ে এ প্রকল্পে অর্থায়নে অক্ষমতা প্রকাশ করে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে এখানে ২০০ মেগাওয়াটের একটি পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেন। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পর প্রকল্পটি আর এগোয়নি। দীর্ঘদিন রূপপুর পারমাণিক প্রকল্প বাস্তবায়নের স্থান, বিভিন্ন সময় পরিদর্শন, ফাইল ওয়ার্ক, আলাপ-আলোচনা হয়েছে, পারমাণবিক শক্তি কমিশনের কয়েকজন চেয়ারম্যানের কাজের মেয়াদকাল সমাপ্ত হয়েছে কিন্তু রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়নি।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করে। ২০১০ সালে রাশিয়ার সঙ্গে পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার নিয়ে ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট হয়। একই বছর জাতীয় সংসদে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ২০১২ সালে বাংলাদেশ অ্যাটমিক এনার্জি রেগুলেটরি অ্যাক্ট পাস করা হয়। ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম পর্যায়ের কাজের উদ্বোধন করেন। এরপর ধাপে ধাপে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পটি এখন আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের চুল্লি স্থাপনের আগে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প শুধুই একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নয়, এর মাধ্যমে বাঙালি নিউক্লিয়ার জাতি হিসেবে বিশ্বে পরিচিত হবে। তিনি বলেন, এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি দেশে পরিচ্ছন্ন জ্বালানির (ক্লিন এনার্জি) মডেল হিসেবে বিবেচিত হবে, যা থেকে দীর্ঘমেয়াদে পাওয়া যাবে সাশ্রয়ী, নির্ভরযোগ্য ও মানসম্মত বিদ্যুৎ।
সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ভিভিইআর-১২০০ রিঅ্যাক্টর স্থাপিত হবে রূপপুরে। রিঅ্যাক্টরগুলোর কার্যকাল ৬০ বছর, যা প্রয়োজনে আরো ২০ বছর চালানো যাবে। ভিভিইআর টাইপ রিঅ্যাক্টরে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য থাকবে। মানবসৃষ্ট দুর্ঘটনা এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন- শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, বন্যা ইত্যাদি মোকাবিলায় সক্ষম এই রিঅ্যাক্টর। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে এক লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাশিয়া দিচ্ছে ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা। বাকিটা দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার।
প্রসঙ্গত, ২০৪১ সালে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা তৈরি হতে পারে ৫০ হাজার মেগাওয়াটের মতো। এর বিপরীতে সরকারের লক্ষ্য ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন। বর্তমানে দেশে দৈনিক বিদ্যুতের চাহিদা ১৩ হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি। বিপরীতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে ২১ হাজার মেগাওয়াট। এমন অবস্থায় রূপপুরের দুটি ইউনিট থেকে ১২০০+১২০০ (২৪০০) মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যোগ হলে বিদ্যুৎ উদ্বৃত্তের পরিমাণ আরো বাড়বে।
নয়া শতাব্দী/এমআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ